একজন লড়াকু সৈনিক বেগম মুশতারী শফী

রোকসানা বন্যা | শনিবার , ২০ জানুয়ারি, ২০২৪ at ১১:০০ পূর্বাহ্ণ

বেগম মুশতারী শফী (১৫ জানুয়ারি ১৯৩৮২০ ডিসেম্বর ২০২১) একজন সাহিত্যিক, উদ্যোক্তা, নারীনেত্রী, শব্দসৈনিক ও সমাজসংগঠক।

১৯৩৮ সালে জন্ম নেয়া বেগম মুশতারী শফী মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রত্যক্ষ করেন ’৫২এর ভাষা আন্দোলনের সময়গুলো। ঢাকা কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী ঐতিহাসিক ভাষা সংগ্রামের রক্তাক্ত পথ পরিক্রমাকে লালন করে নিজের জীবন গড়ার স্বপ্নে অবিচলিত থেকেছেন। ছোটবেলা থেকেই মননশীলতার সুপ্ত প্রতিভায় একটি সাংস্কৃতিক জগতে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। অর্থাৎ সব সময়ই লেখালেখির আঙ্গিনায় নিজের আদর্শিক চেতনাকে বিকশিত করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধা, শহীদজায়া ও শব্দ সৈনিক বেগম মুশতারী শফীর জন্ম তাঁর পিতার কর্মস্থল পশ্চিম বাংলায় হলেও, আদিবাড়ি ফরিদপুর জেলার গেরদা নামক গ্রামে। ১৯৪৯ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় মুকুলের মাহফিলে ছোটগল্প লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখির সূচনা। তাঁর লেখায় প্রেমভালোবাসা যতোটা না ফুটে ওঠে তারচেয়েও বেশি তিনি মানুষের গভীর সংবেদনশীল সংগ্রামের চিত্র, সমাজের বীভৎস সত্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। এর বড় কারণ এদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির কাছে তিনি দায়বদ্ধ। এতসব কিছু ছাপিয়ে আরো যে বড় পরিচয়টি রয়েছে তা হচ্ছে তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। বলা যায়, বেগম মুশতারী শফী নিজেই একটি আন্দোলনের নাম। জাহানারা ইমামকে নিয়ে ‘চিঠি’ বইটি পড়লে জানা যায় কত কাছের ছিলেন দু’জন।

এই মহীয়সী নারীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, খুব কাছ থেকে দেখার, কথা বলার সৌভাগ্য হয়। উনার কাছে শোনা, আর তথ্যের ভিত্তিতে আমার এই লেখা।

১৫ জানুয়ারি খালাম্মার জন্মদিন ছিলো। ঘরোয়া আয়োজনে কাছের মানুষগুলোর জন্য ছোট্ট আয়োজন ছিলো। উনার ছেলে মেরাজ ভাই খালাম্মার পছন্দ পিঠাপুলির ব্যবস্থা করেন জন্মদিনে। খালাম্মা কিন্তু খুব পছন্দ করতেন পিঠাপুলি। উনি মানুষকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন খুব। ছেলের বৌকে সব শিখিয়েছেন। উনি খালাম্মার সঙ্গে থাকতেন সবসময়েই, উনার পছন্দের সবকিছু আয়ত্ত করেছেন। এই বৌমাকে হঠাৎ হারিয়েছেন চিরতরে। খুব ভেঙে পড়েছিলেন সে সময়ে।

মনে পড়ে একবার খালাম্মার জন্মদিনে আমরা নারীকণ্ঠের পরিবার উনার বাসায় গিয়েছিলাম। কতরকমের পিঠার আয়োজন যে উনি করেছিলেন তা বলে শেষ করতে পারবো না। আমি পছন্দ করি, অথচ বানাতে পারি না শুনে নিজেই পাতে তুলে দিচ্ছেন খেতে। আমিও যেন মায়ের হাতের পিঠা পেট ভরে খেলাম সেদিন। উনার আদরের কাছে আমি হার মেনে যাচ্ছি, খাওয়ায়। আমার বন্ধুরা চোখ রাঙাচ্ছিল এতো খাচ্ছি বলে। সেদিনই বোধহয় এমন তৃপ্তি নিয়ে পিঠাপুলি খাওয়া হলো। আমি আর কখনও এত্তো খাইনি।

খালাম্মা গল্প করতে পছন্দ করতেন। আরো একবার উনার বাসায় গিয়েছিলাম কাজে। উনি ওনার জীবনের চড়াইউৎরাইয়ের কথাগুলো বলছিলেন আর কিছু বই থেকে খুঁজে দেখাচ্ছিলেন ছবি। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন সেসময়ের নারী লিখিয়েদের সঙ্গে। সবার নাম মুখস্থ দেখে আমি বিস্মিত হলাম।

ষাট দশকের প্রথমভাগে নারীমুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগে তিনি ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে চট্টগ্রামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সংঘের মুখপত্র হিসেবে ১৯৬৪ সাল থেকে ‘মাসিক বান্ধবী’ পত্রিকাটি এক নাগাড়ে নিয়মিত দশ বছর সম্পাদনা করেন এবং ১৯৬৯ সালে সম্পূর্ণ মেয়েদের দ্বারা পরিচালিত বান্ধবীর নিজস্ব ছাপাখানা ‘মেয়েদের প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি ১৯৭১ সালে পাক হানাদাররা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়।

১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে স্বামী দন্ত চিকিৎসক ডা. শফী, আর ছোট ভাইকে হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে মুক্তির সংগামে যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন বেগম মুশতারী শফী তা ভুলে যাবার নয়। সাত সন্তানের জননী মুশতারী শফীর পরিবারসহ সীমান্ত পাড়ি দেয়া তৎকালীন বাস্তবতায় এক লড়াকু অভিযাত্রা।

তাঁদের এনায়েত বাজারস্থ বাসভবন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র রাখার নিরাপদ জায়গা। শুধু তাই নয়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রাথমিক উদ্যোক্তাদের নির্বিঘ্ন স্থান যেখান থেকে কালুরঘাটে নিয়মিত সংযোগ স্থাপন করা হতো। সুতরাং মুক্তিসংগ্রামের এমন একটি সম্ভাবনাময় দুর্গকে আবিষ্কার করতে সে রকম কষ্ট করতে হয়নি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর। কারণ দেশীয় দালাল চক্রদের সুবাদে এটা সহজেই সম্ভব হয়েছিল। এইসব কাজে নিরলসভাবে পাশে ছিলেন তিনি।

যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিনের মধ্যে ডা. শফীর বাড়িটা কড়া নজরে পড়ে যায় সামরিকজান্তার। ৬ এপ্রিল প্রথম হানা দেয় পাকবাহিনী ডা. শফীর বাসভবনে। ওইদিন শুধু স্বামীই নন, ছোট ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এহসানকেও ধরে নিয়ে যায় সামরিক বাহিনীর লোকেরা। সেদিন অবশ্য তাঁরা ফিরে এলেও চূড়ান্তভাবে পাকবাহিনীর কব্জায় আবারও যান ৭ এপ্রিলে। এর পর ডা. শফি ও ছোট ভাই এহসানের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৭ সন্তানের জননী বেগম মুশতারী শফি হতবিহ্বল, দিশেহারা সেসময়ে।

স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ বইটিতে আছে সাত সন্তান আর তাঁর বাসায় কিছু আশ্রিতদের নিয়ে কীভাবে রাতের অন্ধকারে নিজের বাসভবন ছেড়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

লড়াকু নারীর প্রতিদিনের সংগ্রামী অভিঘাতের এক ক্ষতবিক্ষত জীবন কাহিনী এই বইটিতে লেখা হয়েছে। স্বামীহারা এক নারী তাঁর অবোধ আর কিশোরকিশোরী সন্তানদের নিয়ে কীভাবে বাড়বকুণ্ড, মিরসরাই হয়ে ভারতের আগরতলা সীমানা পাড়ি দিয়েছিলেন কখনও পায়ে হেঁটে, কোনো সময় রিকশায় এমনকি নৌকায় পর্যন্ত তাঁদের সুদীর্ঘ পথপাড়ি দিতে হয়েছিল। তারচেয়েও দুঃসহ অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল শরণার্থী শিবিরে নিজেরসহ সাত সন্তানের মানবেতর জীবনের এক করুণ অধ্যায়। ভারতে অনুপ্রবেশ করা অসংখ্য শরণার্থীর মাঝে প্রাথমিকভাবে নিজেদের স্থান করে নেয়া সত্যিই এক দুর্বিষহ অবস্থা। তার ওপর ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থা। এসব সঙ্কটকালীন সময়ের বাস্তবোচিত বর্ণনা আছে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বইটিতে। তিনি বলেছিলেন, ‘এতসব টানাপোড়নের মধ্যেও এক উদ্দীপ্ত চেতনায় শাণিত হওয়ার মতো লড়াকু মানসিকতা গড়ে উঠতেও সময় লাগলো না। বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ থেকে আরম্ভ করে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ভাষাসৈনিক, সবার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে নিজেও এক সময় হয়ে গেলাম লড়াকু যোদ্ধা।’

মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিজেকে সম্পৃক্ত করার পর পরিচিত হন আরও অনেকে বরেণ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে, বিশেষ করে দুই বাংলার স্বনামধন্য লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী, মৈত্রীয় দেবী এবং বিপ্লবী ইলা মিত্রের সঙ্গে। যারা লড়াকু অভিযাত্রায় নিরন্তর সহযোদ্ধার ভূমিকায় পাশে থেকেছেন। শুধু পাশে থাকা নয় উদ্দীপক হিসেবেও প্রয়োজনীয় অবদান রেখেছেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন বেগম মুশতারী। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকার জন্য ২০১৬ সালে শহীদজায়া মুশতারী শফীকে ফেলোশিপ দেয় বাংলা একাডেমি। ২০২০ সালে পেয়েছেন বেগম রোকেয়া পদক।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি, জাহানারা ইমামকে’ এবং ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ মুশতারী শফীর উল্লেখযোগ্য রচনা।

বেগম মুশতারী শফী মুক্তিযুদ্ধের পতাকা যখন ধর্ষিত হয়, লুণ্ঠিত হয়, অমানবিক অপঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় এমন দুঃসহ কষ্ট কখনো মেনে নিতেন পারতেন না। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, লাখো রক্তের বিনিময়ে লাল সবুজের পতাকা কখনও অপমানিত বা অসম্মানিত হতে পারে না।

একদিন এই দেশের মানুষ তার গৌরব আর অহংকার নিয়ে সসম্মানে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবে।

চট্টগ্রামে নারী অধিকার আদায় ও সুরক্ষার জন্য দীর্ঘদিন কাজ করেছেন মুশতারী শফী। প্রতিটি সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। নারী অধিকার, শ্রমিকের অধিকারের কথা, কিংবা যে কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সর্বক্ষেত্রেই একটি উজ্জ্বলতম নাম বেগম মুশতারী শফী। তাঁর লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। তিনি চাইতেন এসমাজে নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে।

স্যালুট এই লড়াকু জননীকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীদের জন্য নার্গিস সাফিয়ের কারাজীবন
পরবর্তী নিবন্ধসাউদার্ন ভার্সিটিতে পুরকৌশল বিভাগে নবীনবরণ অনুষ্ঠান