নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক এবং স্মরণসন্ধ্যা ২০২২

দীপক চৌধুরী | সোমবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ


২০০৮ সালের ৩ জানুয়ারি সৃজনশীলতার বৈচিত্র ও ব্যাপ্তি, মনন ও মণীষার দীপ্ত এবং সেই সাথে একাধিক সাহিত্যাঙ্গিকের নান্দনিক নিরীক্ষা ও নির্মিতির মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যে খ্যাতকীর্ত হয়ে চৌধুরী জহুরুল হক আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। আজ থেকে ১৪ বছর পূর্বে মৃত্যুবরণকারী নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হকের জন্মস্থান চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া মনেয়াবাদ-এ ১ মার্চ ১৯৪৭ সালে। পিতার নাম ফজলুল হক চৌধুরী, মাতা মসউদা খানম। জহুরুল হকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এম.এ (বাংলা), পেশায় ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। চৌধুরী জহুরুল হকের সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৮ সালে সচিত্র সন্ধানীতে ‘একটি কবিতার জন্ম’ শীর্ষক ছোটগল্প রচনার মধ্য দিয়ে। এরপর চৌধুরী জহুরুল হক ১৯৬৬ সালে এসে কালী প্রসন্ন সিংহ রচিত হুতুম পেঁচার নকশার আঙ্গিকে মনোনিবেশ করেন ছোট ছোট গল্প আকারে প্রহসন রচনার, নাম দিয়েছিলেন ‘চোঙ্গাগল্প’। চৌধুরী জহুরুল হক নাট্য রচনা শুরু করেন রেডিওতে ১৯৭০ সালে গল্প থেকে নাট্যরূপ প্রদান করেন। কথা সাহিত্যিক আবুল ফজলের ‘রহস্যময় প্রকৃতি’, শাহেদ আলীর ‘মা’ কথাশিল্পী সুচরিত চৌধুরীর ‘পালকি গাড়ি’ এবং নাজমুল আলমের ‘পাণ্ডুলিপি ও গয়নার বাক্স’ গল্পগুলোর নাট্যরূপ দেন তিনি।
১৯৭২ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মৌলিক নাটক ‘পটভূমি’ রচনা করেন চৌধুরী জহুরুল হক। ‘পটভূমি’ নাটক দিয়ে বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের প্রথম নাট্যানুষ্ঠান সমপ্রচার শুরু হয়। যদিও চৌধুরী জহুরুল হকের ‘পটভূমি’ নাটকটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি তাৎপর্যময় অংশ। চৌধুরী জহুরুল হক যেহেতু ছিলেন একজন প্রচার বিমুখ অত্যন্ত নিষ্ঠাবান সাহিত্যিক ও শিক্ষক, তাই হয়তো জাতীয়ভাবে চৌধুরী জহুরুল হককে নিয়ে এখনো কোনো বৃহৎ আলোচনা কিংবা জাতীয় পুরস্কার বরাদ্দ হয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনকের হত্যার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের চাকাকে যখন উল্টো পথে ঘুড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টা ছিল, ঠিক তখনই চৌধুরী জহুরুল হক বাঙালি জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় একুশকে উপজীব্য করে রচনা করেন ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা’ শীর্ষক একটি তাৎপর্যময় নাটক। ৭৫-এর পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট অবরুদ্ধ প্রতিবেশের আত্মসর্বস্ব এক প্রচণ্ড আত্মবিধ্বংসী নান্দনিক রূপচিত্র, কালজয়ী এক রূপকাশ্রয়ী নাটক ‘কল্পিত কল্পনা’ রচনা করেন চৌধুরী জহুরুল হক। চট্টগ্রামের নাট্যদল লোক থিয়েটার মনসুর মাসুদের নির্দেশনায় ‘কল্পিত কল্পনা’ চট্টগ্রামের বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ করেছে।
চট্টগ্রামের প্রথম গ্রুপ থিয়েটার গঠন প্রক্রিয়ায় বলতে গেলে ঢাকার আরণ্যক-এর পর পরই ড. আনিসুজ্জামান, ড. মুহম্মদ ইউনুস, মমতাজউদদীন আহমদ, জিয়া হায়দার (যিনি ঢাকা নাগরিক নাট্য সমপ্রদায়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা) এবং চৌধুরী জহুরুল হক, বেগম মুশতারী শফী প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ থিয়েটার ’৭৩ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, সংগঠনটির নাম থিয়েটার ’৭৩ । সংগঠনটি ১৯৭৬ সালে চৌধুরী জহুরুল হক রচিত মিজানুর রহমান নির্দেশিত ‘কবি কাহিনী’, এবং ১৯৭৭ সালে থিয়েটার ’৭৩ নির্দেশনা পরিষদ নির্দেশিত ‘স্বর্গ উপসর্গ’ নিয়মিত মঞ্চায়ন করতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই চট্টগ্রামে শিল্প ও সাহিত্য পরিষদ গঠন, পরবর্তীতে এই পরিষদ এবং পরিষদের সম্পত্তি একত্রিভূতের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন চৌধুরী জহুরুল হক।
চৌধুরী জহুরুল হক সৃজনশীল সাহিত্যকে মূল্যবান জ্ঞান করতেন এটি যেমন সত্য, তেমনি গবেষণাকর্মকে কখনই তুচ্ছজ্ঞান করেননি। বরং অন্য অনেকের চেয়ে চৌধুরী জহুরুল হক গবেষণা কর্মে ছিলেন এগিয়ে। বাংলা নাট্য ও গল্প-সাহিত্যে ইতিহাসের এক আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলজ্বল করবেন চৌধুরী জহুরুল হক। তিনি নিরলস অধ্যয়ন ও গবেষণা করে উদ্ধার করেন বাংলা সাহিত্যে প্রথম কাব্য নাটক ‘একশৃঙ্গ নাটক বা ভগবান বুদ্ধের পূর্বজীবনী’। ১৮৯৭ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত নাটকটি রচনা করেন চট্টগ্রাম কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক কৃষ্ণপদ বিদ্যারত্ন (কৃষ্ণপদ শর্ম্মা)। চৌধুরী জহুরুল হকের একনিষ্ঠ গবেষণা ও প্রচেষ্টায় উদ্ধার হয় একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস থেকে প্রকাশিত কবিতাটির রচয়িতা চট্টগ্রামেরই কৃতী সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী।
প্রতি বছরের মতো ৩ জানুয়ারি সোমবার সন্ধ্যা ৬ টায় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে চতুর্থবারের মতো নাট্যপত্রিকা নাট্যমঞ্চ, নাট্যমঞ্চ রেপার্টরি যৌথভাবে নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক স্মরণসন্ধ্যার আয়োজন করেছে। এবার যে দু’জন ব্যক্তিকে নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হবে, তাঁরা হলেন নাট্যকার-নির্দেশক মিলন চৌধুরী ও নাট্যজন সাবিরা সুলতানা বীণা। তথ্যসূত্র: ড. ইলু ইলিয়াস রচিত ‘চৌধুরী জহুরুল হকের নাট্যকৃতি’।
লেখক : নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা এবং নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক সম্মাননা ২০১৯’-প্রাপ্ত নাট্যজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজামদানি: আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য, বুননে অকৃত্রিম প্রেম
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল