নজরুলের কারাজীবন

রেজাউল করিম | বুধবার , ২৪ মে, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতির অহংকার। তিনি একাধারে সাম্যবাদের কবি, মানবতার কবি, বিদ্রোহের কবি, প্রেমের কবি। অসামপ্রদায়িক সমাজের প্রতিচ্ছবি তিনি। তাঁকে স্বাধীনতার কবি বললেও খুব একটা ভুল হবে না। ভারতের আজাদী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর কবিতা ও গান আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তাঁর কারাজীবন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াই করার পথ দেখিয়েছে। সব রকম শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে নির্ভীক কণ্ঠস্বর আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। করাচি থেকে ফেরার পর কলকাতায় কমিউনিস্ট নেতা মুজাফ্‌ফর আহমদ ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাহচর্য তাঁকে মানবধর্মের এক নতুন পথের সন্ধান দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি লিখিত দলিলের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। কাজী নজরুল তাঁর ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৬)-এ প্রকাশিত ধূমকেতুর পথ রচনায় লিখেছেন, ‘একটিমাত্র টুকরো ভারতীয় ভূমিও বিদেশিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। ভারতীয়দের পরিচালনার দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে থাকবে। এ বিষয়ে কোনো বিদেশির অধিকার নেই আমাদের নির্দেশ করার। যারা ভারতের রাজা বা স্বৈরশাসক হয়েছে এবং এই ভূমিকে শ্মশানে পরিণত করেছে, তাদের তল্পিতল্পাসহ সাগর পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।’

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যিক জীবনের সূচনালগ্নে ১৯২২ সালে ‘ব্যথার দান’, ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘যুগবাণী’ গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিতে তিনি ঘোষণা করলেন ‘চিরউন্নত মম শির’। এর মাধ্যমে বিদেশি শাসকদের কারণে ঘুমিয়ে থাকা বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই ২৩ নভেম্বর ১৯২২ সালে গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি আর প্রকাশিত হয়নি। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র প্রকাশিত হয়েছিল ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ এ। নিজের ‘ধুমকেতু’ পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল কবিতাটা। ‘ধুমকেতু’ তখন শুধু একটা পত্রিকা নয়, একটা ঝড়। এমনিতে ‘ধুমকেতু’র উপর তাদের নজর ছিলই। ৮ নভেম্বর পুলিশ এল ‘ধুমকেতু’র অফিসে। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা এবং এগারো বছরের বালিকা লীলা মিত্রের ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ নামের ছোট্ট প্রবন্ধটির জন্য পুলিশ ‘ধুমকেতু’র ওই তারিখের সমস্ত সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করল। নজরুলকেও ধরতে এসেছিল তারা। কিন্তু নজরুল তখন কলকাতার বাইরে। নজরুলকে পুলিশ ২৩ নভেম্বর ১৯২২ তারিখে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করল। নিয়ে এলো কলকাতায়। এক বছর জেল খাটতে হয় নজরুলকে। মামলা হল শুধু তাঁর কবিতাটার জন্যই। প্রেসিডেন্সি জেলে বিচারাধীন বন্দি হিসাবে কিছু দিন থাকার পর, ১৬ জানুয়ারি ১৯২৩, নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ হল। পরদিন, ১৭ জানুয়ারি সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসাবে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। এরপর হুগলি জেল হয়ে নজরুলকে বহরমপুর জেলে আনা হল ওই বছরের ১৮ জুন। হুগলি জেলে নজরুল প্রথমে বিশেষ শ্রেণির কয়েদির মর্যাদা পাননি, যদিও রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে তা তাঁর প্রাপ্য ছিল। হুগলি জেলে নজরুলের ৩৯ দিনের অনশন আলোড়ন তুলেছিল সারা বাংলায়। এই অনশনের পর নজরুলকে বিশেষ শ্রেণির কয়েদি হিসাবে গণ্য করার নির্দেশ আসে। কিন্তু সে নির্দেশ কার্যকর করা হয়নি।

সে দিক দিয়ে বহরমপুর জেল ছিল অনেকটাই অন্যরকম। এখানে তিনি বিশেষ শ্রেণির কয়েদি হিসাবেই আসেন। যদিও নজরুল এখানেও সাধারণ কয়েদিদের মতোই পোশাক পরতেন। জেলের ভেতরের বন্দিরা শুধু নয়, বাইরেও লোকেরা দাঁড়িয়ে নজরুলের গান শুনতে লাগল। হুগলি জেল থেকে নজরুলকে আনার কারণ ছিল, সেখানে বন্দিদের উপর নজরুলের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। বহরমপুরে এসে বাড়ল বৈ কমল না।

এ দিকে গানের সঙ্গে কবিতা লেখাও চলছে। তাঁর সব লেখাই গোপনে চলে যাচ্ছে বাইরে। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক নজরুলের ছোট বড় যে কোনও কবিতার জন্য দশ টাকা দিয়ে তাঁকে উৎসাহিত করতে লাগলেন। সেপ্টেম্বরে বের হল নজরুলের ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের ১৯টি কবিতা জেলে বসেই নজরুল লেখেন। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা বহরমপুর জেলে বসে লেখা। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ওয়ার্ডারদের সাহায্যে কবিতাগুলো বাইরে আনেন। বহরমপুর জেলে বসে নজরুলের সবচেয়ে বড় সাহিত্যি কীর্তি সহবন্দী পূর্ণ দাসের অনুরোধে একটি নাটক লেখা। পূর্ণ দাস বাইরে গিয়ে একটি চারণদল গঠন করবেন, সেই চারণ দলের অভিনয়ের উদ্দেশ্যে তিনি নজরুলকে একটা নাটক লিখে দেবার অনুরোধ করেন। তবে বহরমপুর জেলের জীবন একেবারে নিষ্কন্টক ছিল না। প্রিজন অ্যাক্ট ভাঙার অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে এখানেই আবার একটা মামলা হল। ওই বছরেরই ১০ ডিসেম্বর তাঁকে হাজির করা হল বহরমপুরের সাব ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেট এন কে সেনের আদালতে। পুলিশের অনুরোধে ১৪ ডিসেম্বর পরবর্তী মোকদ্দমার দিন পড়ল। কিন্তু সে মোকদ্দমা ১০ তারিখের কথা মনে করেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক সরকার আর চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইল না। ১৫ ডিসেম্বর মুক্তি পেলেন নজরুল। নজরুল নবযুগ ও ধূমকেতু সংবাদপত্রে জাতিকে উজ্জীবিত করার জন্য অনেক প্রবন্ধ, কবিতা লিখেছেন। যা ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। অন্যায়অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী নবযুগের সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনচেতা নজরুল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদ্রোহী নজরুল
পরবর্তী নিবন্ধ২ হাজার ৮০টি কার্তুজের খোসাসহ গ্রেপ্তার ১