ধৈর্য ইসলামের সৌন্দর্য

ফখরুল ইসলাম নোমানী

| বৃহস্পতিবার , ২৩ মার্চ, ২০২৩ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই এর মূল লক্ষ্য। এ মহান লক্ষ্যে আল্লাহরাব্বুল আলামিন আদিযুগ থেকে নবীরাসুল পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে পাঠিয়েছেন মানবতার উৎকর্ষের পূর্ণতা প্রদানের জন্য। মহানবী (সা.)-বলেন, আমাকে পাঠানো হয়েছে সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য। আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআলা বলেন, ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকিন আজিমঅর্থাৎ হে মুহাম্মদ (সা.)-নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।

 

 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতাআলা বলেছেন হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (পারা : , সূরা৩ আলে ইমরান, আয়াত : ২০০)

মানব চরিত্রের উত্তম গুণাবলির অন্যতম হলো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। পবিত্র কোরআনে মহানআল্লাহ নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরম সহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় প্রদান করেছেন। ধৈর্যের আরবি হলো ছবর। সহিষ্ণুতার আরবি হলো হিলম। ছবর ও হিলম শব্দদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ তাত্ত্বিক পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। সাধারণত ছবর

তথা ধৈর্য হলো অপারগতার কারণে বা অসমর্থ হয়ে প্রতিকারের চেষ্টা বা প্রতিরোধ না করা। আর হিলম অর্থাৎ সহিষ্ণুতার মানে হলো শক্তিসামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ না করা। এ অর্থে হিলম ছবর অপেক্ষা উন্নততর পর্যায়। তবে এ উভয় শব্দ কখনো কখনো অভিন্ন অর্থে তথা উভয় অর্থে এবং একে অন্যের স্থানে

ব্যবহৃত হয়। হিলম তথা সহিষ্ণুতা সম্পর্কে আল্লাহতাআলা বলেন এবং আল্লাহই তো সম্যক প্রজ্ঞাময় পরম সহনশীল। ছবর অর্থাৎ ধৈর্য সম্পর্কে কোরআন মজিদে আল্লাহতাআলা বলেন আমি তো তাকে পেলাম ধৈর্যশীল। কত উত্তম বান্দা সে! সে ছিল আমার অভিমুখী। নিশ্চয় এতে তো নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক পরম

ধৈর্যশীল ও পরম কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য। কোনো ব্যক্তি যদি উপরিউক্ত অর্থে ধৈর্য অবলম্বন করে তবে তার জীবনে পূর্ণতা ও সফলতা অনস্বীকার্য। কারণ প্রথমত, অন্যায় অপরাধ তথা পাপকার্য থেকে বিরত থাকা সকল প্রকার অকল্যাণ ও গানি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। দ্বিতীয়ত, ইবাদত ও সৎকর্ম সম্পাদন

করা সফলতার একমাত্র সোপান। ধৈর্যের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আলাহ পবিত্র কোরআন মজিদে বলেছেন মহাকালের শপথ মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত ; কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈযের্র উপদেশ দেয়। এই সূরার শেষে মহানআল্লাহ ধৈর্যকে সাফল্যের

নিয়ামকরূপে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহতাআলা বলেছেন হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। ধৈর্য ধারণকারীর সাফল্য সুনিশ্চিত কারণ আল্লাহতাআলা ধৈর্য ধারণকারীর সঙ্গে থাকেন; আর

আল্লাহরাব্বুল আলামিন যার সঙ্গে থাকবেন তার সফলতা অবধারিত। আল্লাহতাআলা বলেন হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। ধৈর্য মানবজীবনে পরীক্ষাস্বরূপ। আল্লাহরাব্বুল ইজ্জাত কোরআনুল আজিমে বলেন-‘তাবারকাল্লাজি

বিইয়াদিহিল মুলকু ওয়া হুওয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কদির। আল্লাজি খলাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা লিইয়াবলুওয়াকুম আইয়ুকুম আহ্‌ছানু আমালা ওয়াহুওয়াল আজিজুল গফুর’। অর্থ : মহামহিমান্বিত তিনি সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ত ; তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদিগকে

পরীক্ষা করার জন্যকে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল। (পারা : ২৯, সূরা৬৭, মুলক, আয়াত : )। ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে সফলতার সুসংবাদ। আল্লাহতাআলা বলেন আমি তোমাদিগকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ জীবন ও ফলফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব।

তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে (ইন্না লিললাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) আমরা তো আল্লাহর এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। (পারা : , সূরা২ বাকারা, আয়াত: ১৫৫১৫৭)। আজও আমরা বিপদআপদে পড়লে পড়ি ইন্নালিললাহি ওয়া

ইন্নাইলাইহি রাজিউন (নিশ্চয় আমরা তো আলাহরই এবং নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁর নিকটেই প্রত্যাবর্তনকারী)। কিন্তু এটি আমরা পড়ি অধৈর্য হয়ে পড়লে তখনই। মূলত আমরা এর দর্শন ভুলে গিয়ে এটিকে প্রথায় পরিণত করেছি।

হাদিস শরিফে আছে, যে ব্যক্তি বিপদেমুসিবতে এই দোয়া পড়বে আল্লাহতাআলা তার বিপদ দূর করবেন এবং তার যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে উত্তম জিনিস তাকে দান করবেন। (বুখারি ও মুসলিম)। ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক হজরত আইয়ুব (.)-১৮ বছর পর্যন্ত সহিষ্ণুতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে পরম সাফল্য

লাভ করেছিলেন। নবী হজরত ইউনুস (.)-কে সামান্য অধৈর্য হওয়ার কারণে বিক্ষুব্ধ রাতের আঁধারে উত্তাল সমুদ্রবক্ষে হিংগ্র মাছের উদরে যেতে হয়েছিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ করে কোরআন কারিমে আল্লাহতাআলা বলেন অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের

অপেক্ষায় তুমি মৎস্যসহচরের (ইউনুস আলাইহিস সালাম) ন্যায় অধৈর্য হয়ো না সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল। আমরা সাধারণত বিপদআপদ ও বালামুসিবতে বিচলিত না হওয়াকেই ধৈর্য বলে মনে করি। মূলত ধৈর্য অনেক ব্যাপক অর্থ ধারণ করে। ধৈর্য তিন প্রকার। যথা: ছবর আনিল মাছিয়াত

অর্থাৎ অন্যায়অপরাধ হতে বিরত থাকা। ছবর আলাততআত অর্থাৎ ইবাদত আলাহর আনুগত্য ও সৎকর্মে কষ্ট স্বীকার করা। ছবর আলাল মুছিবাত অর্থাৎ বিপদে অধীর না হওয়া।

কোনো ব্যক্তি যদি উপরিউক্ত অর্থে ধৈর্য অবলম্বন করে তবে তার জীবনে পূর্ণতা ও সফলতা অনস্বীকার্য। কারণ প্রথমত, অন্যায়অপরাধ তথা পাপকার্য থেকে বিরত থাকা সকল প্রকার অকল্যাণ ও গ্লানি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। দ্বিতীয়ত, ইবাদত ও সৎকর্ম সম্পাদন করা সফলতার একমাত্র সোপান।

তৃতীয়ত, প্রতিকূলতায় দৃঢ়পদ থাকা লক্ষ্যে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম। সুতরাং ‘ছবর কামিল’ বা পরিপূর্ণ ধৈর্যই মানবজীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে। আমাদের উচিত সকল অনভিপ্রেত অবস্থায় যেকোনো অযাচিত পরিবেশে ও অনাহূত পরিস্থিতিতে নিজেকে সংযত রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাওয়া। তবেই আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথি হবে আল্লাহ আমাদের সঙ্গী হবেন।

ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম। ইসলাম পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার কথা বলে। ইসলাম আমাদেরকে সবসময় সুন্দর কথা বলার নির্দেশ করে। আল্লাহ বলেন আর তোমরা মানুষকে সুন্দর কথা বলো। ইসলাম সবার মেধাবুদ্ধি ও সম্পত্তির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বহন করে। ইসলাম অন্যের বিপদে সঙ্কটে

দুঃসময়ে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের ধর্ম ইসলাম সৃষ্টির প্রতি দয়ার কথা বলে। অন্যের কল্যাণে এগিয়ে আসার কথা বলে। ইসলাম বলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বন্ধন গভীর করতে হবে। এই ইবাদত বান্দার জন্যে রিজিকের দুয়ার খুলে দেবে। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করবে। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে পিতামাতার আনুগত্য করার নির্দেশ করে।

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে মদিনা শরিফ যাওয়ার পথে গারে ছুরে (সুর পর্বতগুহায়) যখন আত্মগোপন করেছিলেন তখন তাঁর প্রিয় সাথি হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.)-কে অভয় দিয়ে এভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন। কোরআন শরিফে তা উল্লেখ হয়েছে যদি তোমরা তাকে সাহায্য না

কর তবে আল্লাহ তো তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফিরেরা তাকে বহিষ্কার করেছিল এবং সে ছিল দুজনের দ্বিতীয়জন যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল ; সে তখন তার সঙ্গীকে বলেছিল বিষণ্ন হয়ো না আল্লাহতো আমাদের সঙ্গে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর ওপর তাঁর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং শক্তিশালী করেন

এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফিরদের কথা তুচ্ছ করেন। আল্লাহর কথাই সর্বোপরি এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (পারা : ১০, সূরা৯ তাওবাহ, আয়াত : ৪০)

ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিই পৃথিবীতে। দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহনশীলতা ও ধৈর্যের বিকল্প নেই। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে ন্যায়ের পথে থেকে ধৈর্য ও সহনশীল ভূমিকা পালন করার ও কুরআনে বর্ণিত সহনশীলতা ও ধৈর্য ধারণ করার মহা পুরস্কার লাভের তাওফিক দান করুন। মহান আল্লাহর কাছে

প্রার্থনা করিতিনি আমাদেরকে হেদায়েতের সরল পথে পরিচালিত করুন। আমাদেরকে খাঁটি মুমিন হওয়ার তওফিক দিন। আলোচনার শেষপ্রান্তে এসে আরেকবার মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি। প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারসহচরবৃন্দের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবসরে বই থাক
পরবর্তী নিবন্ধউত্তাল মার্চ ও বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা ভাষণ