উত্তাল মার্চ ও বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা ভাষণ

নাসের রহমান

| বৃহস্পতিবার , ২৩ মার্চ, ২০২৩ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ এর ৭ই মার্চ, দিনটি কেমন ছিল? উত্তাল ছিল, বিস্ফোরণোম্মুখ ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণটি কেমন ছিল? অবিস্মরণীয় ভাষণ, কালজয়ী অগ্নিঝরা ভাষণ। যে ভাষণ বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের ভাষণ। এ ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর বাঙালির স্বপ্ন এক মোহনায় মিলিত হয়।

 

বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন বাঙালির মুক্তি, বাঙালির স্বাধীনতা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পায়। এ ভাষণ বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এগিয়ে চলার সোপান হয়ে পথ দেখায়। দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়, সাহস যোগায়, শক্তি যোগায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তি অর্জনের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছার দৃঢ় প্রত্যয়ে বলিয়ান করে।

দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন বাঙালির আত্মপরিচয়ের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। ভাষার অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে বাঙালি স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়। এ স্বাধিকার আন্দোলন এক সময় মানুষের মনে স্বাধীনতার বীজ

বপন করে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠা দেশটির বলয় থেকে ‘মাতৃভাষা বাংলা’ ও বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়ের মধ্যে অধিকতর মর্যাদা খুঁজে পায়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এর জন্য শুধু আন্দোলন সংগ্রাম নয়, অনেক রক্তও দিতে হয়, প্রাণ বিসর্জন দিতে

হয়। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। তিনি একজন বড় স্বপ্ন দ্রষ্টা। তিনিই বাঙালিকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। বাঙালি জাতিকে এক সূত্রে আবদ্ধ করে স্বাধীতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ছেষট্টিতে বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ঘোষণা দেন। ‘ছয় দফা বাঙালির মুক্তি সনদ’ এ শিরোনামে পত্র পত্রিকায় প্রচার করা হয়। সেসময়ের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন সভা সমাবেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ছয় দফাকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যান। ছয় দফা

সত্যিকার অর্থে মুক্তি সনদে পরিণত হয়। জেল জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন অনেক কিছু সহ্য করতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু এই ছয় দফা গণ মানুষের দাবীতে পরিণত হয়। ছয় দফার আন্দোলন এক সময়ে গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। ঊনসত্তরে গণ অভ্যূত্থান ঘটে। সামরিক সরকারের পতন হয়। সত্তরের নির্বাচন

অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ছয় দফার পক্ষে রায় দেয়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিনত হন।

নির্বাচনে জয়লাভ করেও বাঙালিদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয়নি। তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক চক্র তাদের দোসরদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। নানা রকম তাল বাহানা করে সময় ক্ষেপন করতে থাকে। একাত্তরের জানুয়ারি গিয়ে ফেব্রুয়ারি মাস এসে যায়। কিন্তু সামরিক জান্তা আর

দোসররা মিলে একের পর এক কূট কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। বাংলার মানুষ এবার আর থেমে থাকতে পারে না। তারা আবার আন্দোলন সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষা শহীদদের মাস। প্রতিবাদের মাস। এ মাসেতো ঘরে বসে থাকা যায় না। বাঙালিরা আবার রাস্তায় নেমে পড়ে। একাত্তরের

একুশে ফেব্রুয়ারিতে মানুষ আবার শপথ নেয়। যে করে হোক নিজেদের অধিকার আদায় করে নেওয়ার। বঙ্গবন্ধু আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। একই সাথে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। এবং কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন, ক্ষমতা হস্তান্তর

না করলে পরিণাম ভয়াবহ হবে বলে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, তখন আর কোন পথ খোলা থাকবে না। বাঙালিরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করবে।

একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে মানুষ যে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এলে তারা আর ফিরে যেতে চায় না। রাজপথ, শহরের অলি গলি, গ্রামে গঞ্জে তরুণ ছাত্র জনতার পদভারে, আন্দোলিত হতে থাকলো। তাদের শ্লোগানে শ্লোগানে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠলো। প্রতিবাদের ভাষা চরম রূপ ধারণ করলো।

আন্দোলন সংগ্রাম দিনে দিনে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে চললো। কোনো বাধা মানুষকে আর থামিয়ে রাখতে পারে না। দিন যত যায় ছাত্র জনতা বেপরোয়া হয়ে উঠে। লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস এমনকি গুলিও আর তাদেরকে ফেরাতে পারে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দমন পীড়ন কোনটাকে মানুষ আর পরোয়া করে না।

সারাদিন মিছিল করে, প্রতিবাদ সভায় যোগ দেয়। রাজপথ ছেড়ে যায় না। রাতদিন রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে থাকে। প্রতিবাদের মিছিল বড় হতে থাকে। অধিকার আদায় না করে ঘরে না ফেরার শপথ নেয়।

মার্চের শুরুতে দেশ উত্তাল হয়ে উঠে। প্রতিবাদী মানুষদের আর কোনোভাবে থামানো যায় না। মিটিং মিছিল আর হত্যা চলতে থাকে। আইন শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের শাসন অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। শাসক চক্রের কোনো প্রকার নির্দেশনা মানুষ মানতে চায় না। পূর্ব বাংলার অফিস

আদালত, মিল কারখানা পত্র পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে থাকে। বাংলার মানুষের ন্যায্য দাবির প্রতি সবাই সমর্থন দেয়। স্কুল কলেজ ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র শিক্ষক আন্দোলনে নেমে পড়ে। কল কারখানার শ্রমিকেরাও প্রতিদিন মিছিলে অংশ নিতে থাকে। শিল্প কলকারখানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

অফিস আদালত বিভিন্ন সংস্থার সর্বত্র আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যায়। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীও সাধারণ মানুষের সাথে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে থাকে। এভাবে মার্চের প্রথম সপ্তাহের এক একটা দিন যেন সাগরের ঢেউয়ের মত একটার উপর আরেকটা আছড়ে পড়ে। ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে যে জোয়ার

শুরু হয় তা কখনো ভাটার দিকে যায় না। জোয়ারের পর জোয়ার এসে মার্চ মাসের প্রতিটি দিনকে উত্তাল করে দেয়। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সময় সাগর যেমন করে ফুসে উঠে মার্চ মাসে বাংলার জনগণ তার চেয়ে বেশি ফুসে উঠতে থাকে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে মানুষের দীর্ঘ দিনের আশা আকাঙ্ক্ষার এক উজ্জ্বল প্রতিফলন ঘটে। জলোচ্ছ্বাসের প্রবল জোয়ারে ভেসে মানুষ দিগন্তের সন্ধান পায়। দুর্বার আন্দোলনে উদ্বেলিত উত্তাল জনতা প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পাড়ায়

মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে। যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য নিজেদের তৈরি করতে থাকে। এ ভাষণে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর ডাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, কলকারখানা সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ব বাংলার সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে।

আঠার মিনিটের এ ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি জাতিকে পরিপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করেন। অগ্নিঝরা মার্চের সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয়। এর আগে এত বিশাল সমাবেশ এদেশের কোথাও হয়নি। ঢাকা শহর ও এর আশেপাশের লোকজন সকাল থেকে আসতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সাথে

সাথে রেসকোর্স ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় অলিতে গলিতে মানুষের ঢল নামে। মানুষ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের বাণী শোনার জন্য অধীর আগ্রহ করতে থাকে। শুধু ঢাকার মানুষ নয়, সারা দেশের মানুষ অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। কখন তার ভাষণ শুনতে পারবে। অনলবর্ষী বক্তার

ভাষণ, চিরাচরিত বজ্রধ্বনির ভাষণ। আঙুলি হেলেনে গর্জে উঠার ভাষণ। বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি এক অপূর্ব ভাষণ দিলেন। সে ভাষণ যেন তরঙ্গের মত ভেসে জনসমুদ্রে ঢেউ তোলে। সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায় । অগ্নিঝরা মার্চে সবার মনে যেন আগুন লেগে যায়। এরকম অসাধারণ ভাষণ আগে কেউ দিতে পারেনি।

একেবারে নিজের ভাষায় সহজসরল, দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কথা লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যায়। প্রাণে অনুরণন তুলে বাজতে থাকে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধৈর্য ইসলামের সৌন্দর্য
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল