কয়েকদিন আগে এক প্রবাসী দীর্ঘ ৩০ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন। এয়ারপোর্টের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তিনি দেখেন, তাকে নিতে পরিবারের কেউ আসেনি। তিনি এয়ারপোর্টের ভিতর বসে আছেন দেখে ইমিগ্রেশন পুলিশ জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, পরিবারের কেউ নিতে না আসায় তিনি এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছেন না। পরে ওনার স্ত্রী ও ছেলেদের মোবাইল নাম্বার নিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশ কল করলে ওনার স্ত্রী বলেন দীর্ঘ দিন একনাগাড়ে বিদেশ থাকায় তিনি ঐ প্রবাসীকে তালাক দিয়েছেন। ছেলেদের সাথে কথা বললে তারাও বলেন তাদের মা ওনাকে তালাক দিয়েছেন, তাই তারা ওনার সাথে কোনো যোগাযোগ করছেন না। ইমিগ্রেশন পুলিশ পরে প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা একটি এনজিওর রিহাবেলিটেশন কেন্দ্রে ওনাকে পাঠিয়ে দেন। খবর পেয়ে একটি টেলিভিশন চ্যানেল ওনার সাক্ষাৎকার নেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি কেঁদে কেঁদে কষ্টের কথা বলেন। বলেন সারাজীবন পরিবারের সচ্ছলতার কথা চিন্তা করে তিনি বিদেশে ছিলেন। নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। যৌথ পরিবারে মা বাবা ভাই বোনের জন্য সাধ্যমত সাহায্য করেছেন। যা আয় করেছেন সব পরিবার, স্ত্রী সন্তানের জন্য পাঠিয়েছেন। এখন তার হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই। তিনি নিঃস্ব অসুস্থ, এই অবস্থায় কোথায় যাবেন। তার শরীরে জটিল রোগ বাসা বেঁধেছে। কাজ করার সামর্থ্য তার নেই। তাই তিনি যতদিন বাঁচেন সেই রিহেবিলিটেশন সেন্টারেই থাকবেন।
এটা শুধু তাঁর অবস্থা নয়। দীর্ঘদিন যারা স্ত্রী সন্তান ও পরিবারের সুখের জন্য বিদেশে প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে আসেন তাদের অনেকেই এই রকম করুণ অবস্থায় পতিত হন। আর এই অবস্থা বেশি হয় মধ্যপ্রাচ্য ফেরত প্রবাসীদের ক্ষেত্রে।
এটি আমার কথা নয়। প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর জরিপের তথ্য এটি। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে দেশে ফিরেছেন ১ হাজার ৮৩০ জন প্রবাসী। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৬ জন বিভিন্ন এনজিওর কাছে এসেছেন স্বাস্থ্যসেবা নিতে। যার মধ্যে ৪৮ শতাংশ এসেছেন মানসিক সমস্যা নিয়ে। যাঁদের মধ্যে ৬১ শতাংশ নারী এবং ৩৯ শতাংশ পুরুষ। মানসিক সমস্যা নিয়ে যাঁরা এসেছেন,তাদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পুরুষ।
মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকে ফেরা ১ হাজার ৯৬ জন বিদেশফেরত কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন তাঁরা। কুমিল্লা, ঢাকা, ফরিদপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ জেলায় গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত জরিপের তথ্য সংগ্রহ করেছে তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)।
রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়। ‘বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্য: আর্থসামাজিক উন্নয়নে গোপন অভিবাসন খরচের বোঝা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপের পাশাপাশি বিশদ সাক্ষাৎকার ও দলবদ্ধ আলোচনার মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ফিরে আসা প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা প্রতিবেদনটি সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করবে। তারা স্বীকার করেন, প্রবাসীদের নিয়ে সরকারের আরো অনেক কিছু করার আছে। কোথাও একটা সমন্বয়ের ঘাটতি রয়ে গেছে। তবে নিয়মিত বৈধ উপায়ে অভিবাসন নিশ্চিত করতে পারলে সমস্যার ৫০ শতাংশের বেশি সমাধান হয়ে যাবে। প্রবাসীদের তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানানোর জন্য একটা প্লাটফর্মের কথা বলেন তিনি।
গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, অধিকাংশ কর্মী গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৫ শতাংশ কর্মী ফিরে এসেছেন সৌদি আরব থেকে। প্রবাসীরা কেউ কেউ চিকিৎসার জন্য দেশ থেকে ঋণ করে টাকা নিয়েছেন। চিকিৎসা করাতে না পেরে দেশে ফিরে এসেছেন অনেকে। দীর্ঘ সময় ধরে ধার কর্জ করে চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব খরচের কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাব নেই। তাই সামাজিক খরচের বিষয়টি পুরোপুরি বের করা যায়নি। এর ফলে অভিবাসনের মোট খরচের হিসাব করা কঠিন। তবে বাংলাদেশে দৃশ্যমান অভিবাসন খরচও অনেক বেশি। নারীদের কোনো অভিবাসন খরচ না থাকার কথা। অথচ ৬৬৬ জনের মধ্যে ২১ শতাংশ নারী বলেছেন, দুই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে তাঁদের। আর ২৯ শতাংশ পুরুষ কর্মী বলেছে, ৬ লাখ টাকার বেশি খরচ করতে হয়েছে।
যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে প্রবাসীরা ফিরে এসেছেন, তার মধ্যে আছে পিঠে ব্যথা, কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনায় আঘাত, হৃদ্রোগ, কিডনি সমস্যা, ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, টিউমার, ত্বকের রোগ। মানসিক সমস্যার বেশি অভিযোগ করেছেন গৃহকর্মীরা। এরপর আছে কৃষি, নির্মাণ অবকাঠামো ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় দালালের প্রলোভনে পড়ে পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে সৌদি আরবে যান এক নারী কর্মী। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নিয়োগকর্তা কর্মক্ষেত্রে অনেক কাজ করাত, কিন্তু ঠিকমতো খাবার দিত না। শারীরিকভাবে নিপীড়ন করতেন গৃহকর্তা। যৌন নির্যাতন করার অভিযোগও করেন তিনি।
অভিযোগ করলে উল্টা মারধর করতেন। এক পর্যায়ে ওনার হাত ভেঙে দেওয়া হয়, চিকিৎসাও করানো হয়নি। পরে তিনি দেশে ফিরে আসেন। মামলা করলে স্থানীয় লোকজনের চাপে ৩০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণে দালালের সঙ্গে সমঝোতা করে মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এক দালালের মাধ্যমে কোম্পানির চাকরি করতে চার লাখ টাকায় সৌদি আরবে যান নারায়ণগঞ্জের এক নারী। তিনি বলেন, গিয়ে চাকরি পাননি। একটি কক্ষে তাঁকে ২০ থেকে ২৫ জনের সঙ্গে রাখা হয় কিছুদিন। এক মাস হাজিদের বাসায় কাজ করিয়ে বের করে দেয়া হয়। এরপর অবৈধভাবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। এক পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিডনির সমস্যা ও বহুমূত্র রোগ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি এখনো চিকিৎসাধীন। অনুষ্ঠানে বিএমইটির প্রতিনিধি বলেন, দেশে সবচেয়ে কম বাজেট ও জনবলের মন্ত্রণালয় হলো বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কিন্তু এ মন্ত্রণালয় ঘিরে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। তিনি বলেন, সীমাবদ্ধতা অনেক। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের প্রতিনিধি বলেন, বিদেশে যাওয়া কর্মীদেরও কিছুটা দায়িত্ব নিজেদেরকে নিতে হবে। যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে সচেতন হয়ে গেলে সমস্যা কমে যায়। বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিমাণ কর্মী গেছেন, সেভাবে প্রবাসী আয় বাড়েনি। তার মানে সবাই গিয়ে কাজ পাননি। নারী কর্মী তো ওখানে ঘর থেকেই বের হতে পারেন না। কল্যাণ বোর্ডের টাকা ফেলে না রেখে প্রবাসী কর্মীদের জন্য কোনো সহায়তার ব্যবস্থা করা উচিত।
গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরে ওকাপের চেয়ারপারসন বলেন, একজন কর্মীও যদি স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে দেশে ফেরত আসেন, তার মানে তাঁদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মানসিক সমস্যায় নারীদের নানা সেবা দেওয়া হলেও পুরুষদের বিষয়টা উপেক্ষিত থাকে। অথচ এ গবেষণা বলছে, পুরুষের মানসিক সমস্যা বেশি।
আসলে যারা নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, জীবন যৌবন স্বাদ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে বিদেশে দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে আসেন, দেশের অর্থনীতিকে গতি সঞ্চার করেন, তারা চান বাকি জীবন দেশে এসে একটু আরাম আয়েশে কাটাতে। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা তাদের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সরকারের উচিত এই সব দেশ প্রেমিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য বা তাদের কল্যাণে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট