দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১২ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মেট্রো স্টেশনে নেমে কী পরিমাণ কাহিল যে লাগছিল বলে বুঝানো কঠিন। মাটির তিন তলা নিচে ট্রেন থেকে নেমেছি। সিঁড়ি ভেঙে সমতলে উঠতে গিয়ে শরীর ভেঙে যাচ্ছিল। এক একটি সিঁড়িকে এক একটি পাহাড়ের মতো মনে হচ্ছিল। ভারী শরীরটাকে টেনে তোলার মতো শক্তি পাচ্ছিলাম না। দিনের বেশিরভাগ সময় ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে পায়ের উপর যে ধকল গেছে তা সামলাতে এখন হিমশিম খাচ্ছি। মেলার বিভিন্ন স্টলে রকমারি নতুন জিনিস দেখার আনন্দে হাঁটার সময় খবর না হলেও এখন মনে হচ্ছে পা দুটি সাথে নেই। এক কোটি বর্গফুটেরও বেশি আয়তনের মেলা অঙ্গনের অর্ধেকও যদি ঘুরি তাহলেও ঠিক কত মাইল হাঁটা হয়েছে তা হিসেব কষতে ক্যালকুলেটর লাগবে! এছাড়া আয়োজন করে হাঁটা আর বেঘোরে হাঁটার মধ্যেও যে অনেক পার্থক্য তাও টের পাচ্ছিলাম। ক্যান্টন ফেয়ারের বিশাল এলাকায় দিনভর কেবলই ঘুরেছি। আর দিনশেষে সবকিছু যেন পায়ের উপর টের পাচ্ছি!
মেট্রো থেকে নেমে হেঁটে বাসায় পৌঁছাতে হয়েছে। মেট্রো স্টেশন বাসার কাছে হলেও একেবারে কাছে নয়। এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আমরা অনায়াসে রিক্সায় চেপে বসি, টেক্সি নিই। কিন্তু এখানে রিক্সা নেই। চীনের গুয়াংজুতে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে বাস থামানোর যেমন সুযোগ নেই, তেমনি নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া টেক্সিক্যাবে চড়ারও উপায় নেই। বেশ দূর অব্দি হাঁটার পরই কেবল নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকে বাস কিংবা ক্যাবে চড়ার সুযোগ হয়। স্টেশন ছাড়া মেট্রোর নাগাল পাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। আবার সেই স্টেশন যেতেও ঝক্কি কম নয়। তবে চীনে যে কদিন ঘুরলাম তাতে মনে হলো এখানেও পশ্চিমা বিশ্বের মতো হাঁটার কোন বিকল্প নেই। প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হয় অফিসে যাওয়ার জন্য, বাজার করার জন্য কিংবা জীবনধারণের জন্য। বেঁচে থাকার জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়। হাঁটা ছাড়া শুধু বাড়ি কিংবা অফিসের গন্তব্যই নয়, জীবনের গন্তব্যে পৌঁছাও বুঝি অসম্ভব। নিজের গাড়ি থাকলেও এই হাঁটা থেকে নিস্তার পাওয়ার সুযোগ নেই। যেখানে সেখানে গাড়ি দাঁড় করাবেন? পার্কিং করবেন? নৈব নৈব চ!
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ইউছুপ ভাই এবং ভাবীকে সারাদিনের গল্প শুনাচ্ছিলাম, ক্যান্টন ফেয়ারের গল্প। ইউছুপ ভাই বললেন, আপনার ভাগ্য ভালো। ঠিক ক্যান্টন ফেয়ারের সময়ই গুয়াংজুতে এসেছেন। দারুণ একটি জিনিস দেখে গেলেন। ইউছুপ ভাইর কথা শুনে আমার প্রিয় এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের কথা মনে পড়ে গেলো। আমেরিকার লজএঞ্জেলস থেকে সড়কপথে আমরা লাস ভেগাস যাচ্ছিলাম। দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক ছাড়াও সাথে ছিলেন বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, আমেরিকা প্রবাসী জিইএম প্ল্যান্টের সাবেক এমডি মোসলেম খান, লেখিকা জেসমিন খান। মোসলেম ভাইর পুত্র ইঞ্জিনিয়ার মিখাইল খান রাসেল গাড়ি চালাচ্ছিল। গাড়ির ভিতরে নানা বিষয়ে হুলস্থুল গল্প চলছিল আমাদের। ওই সময় কী একটা কথা প্রসঙ্গে আমার এডিটর স্যার বলেছিলেন, ‘আকবরের বেড়ানোর ভাগ্য বেশ ভালো!’ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ভাই মারা গেছেন, মারা গেছেন লেখিকা জেসমিন খান ভাবীও। আমি মনে মনে দুজনের আত্মার মাগফেরাত কামনা করলাম। আহ, কী দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছিলাম লাস ভেগাসের রঙিন দুনিয়ায়, গ্র্যান্ড কেনিয়নসহ ধারে কাছের বিস্তৃত জনপদে!
কথায় কথায় ইউছুপ আলী ভাই হংকং অফিসে কিছু একটা সমস্যা হওয়ার কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘আমাদেরকে কাল চলে যেতে হবে। আপনি যতদিন সম্ভব এখানে থাকেন, বেড়ান। চীনের অন্য কোথাও যেতে চাইলেও ঘুরে আসতে পারেন। অফিসে বললে সব ব্যবস্থা করে দেবে। আমার ইচ্ছে ছিল আপনাকে নিয়ে আরো কয়েকদিন থাকবো। কিন্তু শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। একটি দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমাকে আবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কী আছে ভাগ্যে কে জানে! দোয়া করবেন। কাল সন্ধ্যায় আমরা চলে যাবো। ট্রেনে টিকেট করা হয়ে গেছে।’
সারাদিনের আনন্দের মাঝে কেমন যেন একটি মেঘের ছায়া নেমে এলো। ইউছুপ আলী ভাই চলে যাবেন। আমার সাথে দেখা করার জন্য হংকং থেকে ছুটে এসেছিলেন তিনি। অথচ আমি জানি যে, উনার শরীরটা ভালো নয়। লিভারে বড় ধরনের অপারেশনের পর থেকে উনার শরীরটা কোনভাবেই সুস্থ হচ্ছে না। সিংগাপুরে অপারেশন করেছেন গতবছর। হংকং এ হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন অনেকদিন। তখন আমি হংকং গিয়ে ইউছুপ আলী ভাইকে দেখে এসেছিলাম। অপারেশনের পর উনার শরীর কিছুটা ভালোর দিকে গেলেও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তবুও আমার সাথে দেখার করার জন্য হংকং থেকে গুয়াংজু ছুটে এসেছেন। আহা, ইউছুপ ভাইর সাথে আবার দেখা হবে তো! পরিস্থিতি হালকা করার জন্য ইউছুপ আলী ভাই বললেন, আপনি হংকং চলে আসেন। আমি ভিসা পাঠিয়ে দেবো। ওখানে বেড়াবো। কবে যে আবার হংকং যাওয়ার সুযোগ পাবো কে জানে!
ভাবী নানা ধরনের নাস্তা তৈরি করেছেন। হাতঝাড়া পিঠা, সাথে মুরগীর মাংস। চীনা গৃহসহকারীও বেশ ভালো নাস্তা বানাতে পারেন। কী কী সব নাস্তা খেলাম, সাথে প্রচুর ফলমূল। ইউছুপ আলী ভাই টুকটাক খাচ্ছিলেন, যেন সব আয়োজন আমার জন্য। এটা নেন, এটা একটু খেয়ে দেখুন, ওটা খুবই ভালো, একেবারে ফ্রেশ ফ্রুটস- ইত্যাদি নানা কথা বলে আমাকে খেতে উদ্বুদ্ধ করছিলেন ইউছুপ ভাই এবং ভাবী।
ভাবী বললেন, আকবর ভাই বেইজিং যাবেন না? চীনে এসে বেইজিং না দেখে ফিরে যাবেন? বেইজিং চলে যান। কয়েকদিন বেড়িয়ে আসুন! ইউছুপ ভাই প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লেন, কী বলো! তোমার কী মাথা খারাপ! বেইজিং কী পাশের বাড়ি? প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে! আকবর ভাই একা একা ওখানে গিয়ে কী করবে!!
ভাবী বললেন, তোমার বন্ধু কী ঘরের বউ? একা একা সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ানো মানুষ। এখন বেইজিং একা গেলে সমস্যা কী! এসেছে যখন ঘুরে গেলেই তো ভালো। রাজধানীর মতো সুন্দর কী আর কোন শহর হয়!
বেইজিং বেড়ানোর কোন ইচ্ছে নিয়ে আমি চীনে আসিনি। আমার সাথে যারা এসেছিলেন আমার প্রিয় সেই বন্ধুরাও কেউ বেইজিং যাননি। ইতোমধ্যে তারা সবাই দেশে ফিরে গেছেন। শুধু আমিই ইউছুপ ভাইর সাথে থেকে গেছি। আমার মনে হলো, বেইজিং দেখা না হলেও যতটুকু ঘোরা হয়েছে তাও অনেক। এত ঘুরতে পারবো সেই আশা ছিলনা। তবে কেমন করে যেন বেড়ানো হয়ে গেল। ওই যে বেড়ানোর ভাগ্য ভালো! বছরের পর বছর ধরে যে সাংহাই বন্দরের কথা দৈনিক আজাদীতে লিখে আসছিলাম সেই সাংহাই দেখে আমার চীন ভ্রমণ সার্থক বলেও মনে হয়েছিল। ভাবী বেইজিং এর পোকা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়ার পর আমি একটু নড়ে চড়ে বসলাম।
ভাবী বললেন, চীনের গ্রেটওয়াল না দেখে ফিরে যাওয়া কী ঠিক হবে! আকবর ভাই বেইজিং চলে যান, ইচ্ছেমতো ঘুরে টুরে তবেই বাড়ি ফিরবেন। গুয়াংজুতে সবকিছু তো রয়েছে, সমস্যার কিছু তো নেই। এখানে লাগেজ টাগেজ রেখে শুধু কেবিন ব্যাগটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। ঘুরে টুরে এখানে এসে আরো কয়েকদিন থেকে তারপর ঘরে ফিরবেন!
সত্যিই তো, চীনে এসে যদি চীনের গ্রেট ওয়ালই না দেখি তো কেমনে কী! চীন আসলাম, অথচ গ্রেট ওয়াল দেখলাম না, রাজধানী দেখলাম না! যে বেইজিং এখন আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ারকে শাসায়, সেই বেইজিং না দেখে ঘরে ফেরা কী ঠিক হবে! আমার মাথার পোকাগুলো একের পর এক প্রশ্ন করে বিব্রত করে তুলছিল আমাকে। ইউছুপ ভাই এবং ভাবীকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিজে নিজে নানা প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করছিলাম।
মনে মনে ভাবলাম, দু’চারদিন গুয়াংজু এবং আশেপাশে ঘুরি। তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। চীনে যতক্ষণ ইউছুপ ভাইর অফিস বা ফ্ল্যাট আছে, মানুষজন আছে ততক্ষণ আমার তো কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া ডলার যেগুলো দেশ থেকে এনেছি তার সবগুলোই তো প্রায় অক্ষত রয়েছে! অতএব অন্য চিন্তা বাদ দিয়ে মুরগীর মাংসের ঝোল এবং হাতঝাড়া পিঠা উপভোগ শেষে আমি ধুমায়িত কাপে চিনি মেশাতে শুরু করলাম! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেখ রাসেল ছোটোদের বইমেলা : দেশে প্রথম উদ্যোগ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ