প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১২ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া গারাংগিয়া জামে মসজিদের সম্মুখে শায়িত রয়েছেন মহান দুই পীর ছাহেব কুতবুল আলম সুলতানুল আউলিয়া হযরত আলহাজ্ব শাহ সুফি মাওলানা আবদুল মজিদ (রহ.) (প্রকাশ গারাংগিয়া বড় হুজুর কেবলা) ও কুত্‌বে মাদার হযরত আলহাজ্ব শাহ সুফি মাওলানা আবদুর রশিদ হামেদী ছিদ্দিকী (রহ.) (প্রকাশ গারাংগিয়া হযরত ছোট হুজুর কেবলা)। উভয় হযরত পীর ছাহেব কেবলা আপন সহোদর ভ্রাতা। মধ্যখানে রয়েছে অপর ভ্রাতা হযরত শাহ সুফি হাফেজ আবদুল লতিফ (রহ.)। তাকেও গারাংগিয়া হযরত মেজ হুজুর বলা হয়।
উভয় হযরতের আব্বাজান হযরত সুফি মুহাম্মদ আলী উদ্দিন মিয়াজী (রহ.)। একজন দুনিয়াবিমুখ সাধারণ জীবনযাপনকারী আল্লাহর অলি ছিলেন। তাঁর বহু কারামত রয়েছে। তিনি ১৯৩৩ সালে ইন্তেকাল করেন।
হযরত বড় হুজুর কেবলা ১৮৯৪ সালে গারাংগিয়া নিজ বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের বাড়িতে শেষ করেন। অতঃপর পার্শ্ববর্তী মির্জাখীল গ্রামস্থ হযরত মাওলানা আবদুল লতিফ (রহ.)’র নিকট আরও শিক্ষা লাভ করতে যেতেন। এরই সাথে মির্জাখীলস্থ হযরত শাহ সুফি মাওলানা আবদুল হাই (রহ.) ( হযরত ছাহেবের) নিকটও গমন করেন ধর্মীয় জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে। সেকালে ত বটেই ১৯৮০ দশকের আগ পর্যন্তও দেশের বড় বড় আলেমরা নিজ বাড়ীতে ছাত্রদেরকে উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন শুধুমাত্র পুণ্যের নিয়তে।
অতঃপর হযরত বড় হুজুর পশ্চিম পটিয়া শিকলবাহা মাদ্‌রাসায় কিছু দিন পড়ালেখা করেন। এরপর আরও উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর দারুল উলূম মাদ্‌রাসায় ভর্তি হন। এখানে শিক্ষা জীবন শেষ করে আরও উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তৎনিকটে মোহসেনিয়া মাদ্‌রাসায় (বর্তমানে হাজী মুহসিন কলেজ) ভর্তি হন এবং ফাজিল পাস করেন কৃতিত্বের সাথে। ঐ সময় প্রসিদ্ধ কৃতী ছাত্র বিধায় উস্তাদগণের আগ্রহে দারুল উলূম মাদ্‌রাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। এরপর ভারতে গমন করতে উদ্যোগী হন। কিন্তু তিনি বাড়ীর অভিভাবকও ছিলেন বিধায় দূরে কোথাও চলে গেলে ছোট ছোট সন্তান-সন্ততি নিয়ে পুণ্যবতী মাতা অসহায়বোধে তাঁকে বারণ করেন। ফলে উস্তাদ মির্জাখীলস্থ হযরত ছাহেব কেবলা পরামর্শ দেন ঘর-বাড়ী, ছোট ভাই বোনদের ছেড়ে অতি দূরে টাইটেল পড়তে না গিয়ে ঘরের নিকটে মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা করা উত্তম হবে বলে। ফলে ১৯২০ সালে বাড়ীর নিকটে গারাংগিয়া মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদ্‌রাসা দ্রুত প্রসার লাভ করায় ছাত্র সংখ্যাও তেমনি বাড়তে থাকে। ফলে সরকারও পরীক্ষার সেন্টার অনুমোদন দেন। কিন্তু ১৯৫২ সালে পরীক্ষা চলাকালীন টয়লেটে নকল দৃষ্টিগোচর হওয়ায় হুজুর স্বইচ্ছায় সরকারী কেন্দ্র প্রত্যাহার করে নেন।
তিনি ১৯২১ সালে আজমগড়ী হযরতের নিকট তরিকতে দাখিল হন। দাখিল হন চুনতী ইউসুফ মঞ্জিলে। ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড় থেকে মহান পীর হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান (রহ.) (আজমগড়ী হযরত) তরিকতে তাবলীগের সফর করেন। তরিকতে তাবলীগের সফরে বছরে ন্যূনতম এক বার চট্টগ্রাম আসতেন। এই সময় তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর ও চন্দনপুরায় অবস্থান করতেন। সাগরপথে স্টিমারে বাঁশখালী ছনুয়া যেতেন। নদীপথে গারাংগিয়া হয়ে চুনতী গমন করতেন। চুনতী হযরত শাহ ছাহেব কেবলার দাদার বাড়ী ইউসুফ মঞ্জিলে অবস্থান করতেন। ১৯২১ সাল থেকে গারাংগিয়া মাদ্‌রাসার খেদমতের পাশাপাশি তরিকতের কাজও চালিয়ে যেতে থাকেন। এমনি অবস্থায় প্রতি বছর আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রামে তাশরীফ আনলে তাঁর সান্নিধ্যে থাকতে তৎপর হন। অপরদিকে হযরত বড় হুজুরও আজমগড় যাওয়া-আসা করেন।
১৯৪৪ সালে চুনতী হযরত আলহাজ্ব শাহ সুফি নজির আহমদ (রহ.) ইন্তেকাল করলে তাঁর জানাযা দাফনে হযরত আলহাজ্ব শাহ সুফি মাওলানা আবদুস সালাম আরাকানী (রহ.)’র সাথে গারাংগিয়া বড় হুজুরের মোলাকাত হয়। আগে থেকে উভয়ের মধ্যে জানা থাকলেও এ মোলাকাতের পর থেকে উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতা দেখা দেয়। চুনতী হযরত শাহ সুফি মাওলানা হাবিব আহমদ (রহ.)সহ তিন মহান ব্যক্তিত্ব চট্টগ্রাম থেকে আজমগড় গমন করেন। তথায় আজমগড়ী হযরত গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর (রহ.)কে খেলাফত দানে ভূষিত করেন।
তখন থেকে হযরত বড় হুজুর গারাংগিয়া মাদ্‌রাসার খেদমতের পাশাপাশি তরিকতে তাবলীগের সফর আনজাম দিয়ে গেছেন। যেহেতু আজমগড়ী সিলসিলার বৈশিষ্ট্য হল বছরে ন্যূনতম ৩ মাস তরিকতে তাবলীগের সফর করা আবশ্যক । সেই সময় প্রতিকূল যোগাযোগ মানুষের বাড়ী ঘরের অবকাঠামোগত প্রতিকূলতা অনেকের কাছারী ঘর, বাড়ী সংলগ্ন টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকা অনেকটা স্বাভাবিক। কিন্তু তরিকতের খেদমতের মহান লক্ষ্যে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে চষে বেড়ান। পাশাপাশি গারাংগিয়া মাদ্‌রাসার খেদমত আছেই। ফলশ্রুতিতে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রামে গারাংগিয়া বড় হুজুর কেবলা সব আকিদা মতাদর্শের কাছে সবর্জন শ্রদ্ধেয় হিসেবে শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। যে ঘরে বা যে স্থানে গমন করতেন লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। তৎমধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শের আলেমের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।
১ম বার ১৯৪৫ সালে ২য় বার ১৯৫১ সালে তিনি ২ বার হজব্রত পালন করেন।
গারাংগিয়ার এ মহান পীর ছাহেব ১৯৭৭ সালের ২১ অক্টোবর শুক্রবার সকালে নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। ঐ সময় মোবাইল ত ছিলই না, ল্যান্ড ফোনেরও সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু কয়েক লাখ লোকের সমাগমে বাদে আছর গারাংগিয়া মাদ্‌রাসা ময়দানে জানাযা হয়। জানাযার সমাগম ময়দান পেরিয়ে মাদ্‌রাসা দালানে, রাস্তায়, ঘরের উঠানে, ডলু নদীর চরে মানুষের তিল ধারণের জায়গা ছিল না।
তাঁর মহান পীর আজমগড়ী হযরত বলে গেছেন;“মেরে মজিদ কা খীমা ওয়াসী’ নজর আতা হে”অর্থাৎ গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা শরীয়ত ও ত্বরীকতের বিশালত্ব দেখতেছেন বলে তাঁরই পীর ছাহেব আজমগড়ী হযরত এ বাক্য বলেছিলেন। তাঁর মহান পীর আরও বলে গেছেন,“ বাঙ্গাল মে কুই মুখলেছ হেত মজিদ হে”। বাস্তবই গারাংগিয়া বড় হুজুর কেবলা শরীয়ত কেন্দ্রীক ত্বরীকতের বিশাল আনজাম ভাববার বিষয়। তাঁর মোবারক হাতে তৈরি হয়েছে অসংখ্য অতি উঁচুমানের আলেম মুফতি, মুহাদ্দেস, সুফি দরবেশ। আরও রেখে গেছেন লক্ষ লক্ষ মুরিদ।
তাঁর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে শতের কাছাকাছি দাখিল থেকে কামিল মাদ্‌রাসা। তাঁর উছিলায় প্রতিষ্ঠিত কত মসজিদ, ফোরকানিয়া, খানকাহ, এতিমখানা, হেফজখানা রয়েছে গণনা করে শেষ করার নয়। তিনি যাচাই বাছাই করে ৭৮ জনকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন।
হযরত ছোট হুজুর কেবলা: গারাংগিয়া হযরত ছোট হুজুর কেবলা বহুমুখী প্রতিভা বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন হযরত বড় হুজুরের ১০ বছরের ছোট। গারাংগিয়া মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করলে তথায় ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করেন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য দারুল উলুম মাদ্‌রাসায় ভর্তি হন। এখান থেকে ফাজিল পাস করে গারাংগিয়া মাদ্‌রাসায় হেড মাওলানা হিসেবে যোগদান করেন। ঐ সময় হতে তিনি সর্বমহলে আওয়াল ছাহেব হুজুর তথা হেড মাওলানা হিসেবে প্রকাশ পেতে থাকেন। নিজের বড় ভাই অভিভাবক হযরত বড় হুজুর কেবলার পাশাপাশি নিজেও রাত দিন গারাংগিয়া মাদ্‌রাসার খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯২৮ সালে আজমগড়ী হযরত চুনতী তাশরীফ আনলে হযরত বড় হুজুর নিজের পিতা এবং ছোট ভাই ছোট হুজুরকে নিয়ে আজমগড়ী হযরতের নিকট নিয়ে তরিকতে দাখিল করে দেন। সে হতে হযরত ছোট হুজুর কেবলা গারাংগিয়া মাদ্‌রাসার খেদমতের পাশাপাশি তরিকতের নিয়মিত আমল চালিয়ে যেতে থাকেন। দীর্ঘ সময় মোরাকাবায় (ধ্যানে) থাকতেন। অভিভাবক বড় ভাই হযরত বড় হুজুরের অনুমতি সাপেক্ষে একাধিক বার আজমগড় গমন করেন।
১৯৫৫ সালে ১৬ বছর ব্যবধানে আজমগড়ী হযরত সর্বশেষ বার ভারত থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম তাশরীফ আনেন রেলে। হালিশহর কয়েকদিন থেকে কাপ্তাই গমন করেন। তথায় ১ রাত থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীর চন্দনপুরা জমিদার এয়ার আলী খানের বাসভবনে অবস্থান নেন। এই সময় কয়েকজনকে লিখিত খেলাফত দানে ভূষিত করেন। তৎমধ্যে হযরত ছোট হুজুর (রহ.)ও রয়েছেন। কিন্তু বড় ভাই অভিভাবক তরিকতের খেদমতে আছেন বিধায় ১৯৭৫-৭৬ সাল পর্যন্ত নিজেকে নিজে গুটিয়ে রাখেন। ১৯৭৭ সালে হযরত বড় হুজুর কেবলা ইন্তেকাল করলে তিনি বড় ভাই এর রেখে যাওয়া তরিকতের বিশাল জংশন ও গারাংগিয়া মাদরাসার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় হযরত ছোট হুজুর কেবলার রাত দিন বিশাল খেদমত সকলকে ভাবিয়ে তুলে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মহিলা মাদ্‌রাসা। আরাকান রোড থেকে গারাংগিয়া পর্যন্ত ৬ কি.মি নতুন রাস্তা নির্মাণ করান। নামকরণ করেন “শাহ মজিদিয়া রোড”। তিনি মাদ্‌রাসা কমপ্লেক্স উন্নয়নে নানাভাবে অবদান রাখেন। মসজিদ পুনঃ নির্মাণ করে দালানে রূপান্তর করেন। তিনি ৩ বার হজ্বব্রত পালন করেন। ১৯৯৪ সালের ৪ নভেম্বর শুক্রবার সকালে নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। হযরত ছোট হুজুরেরও কয়েক লাখ লোকের সমাগমে আছরের নামাজের পরে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এ ১৭ বছর হযরত ছোট হুজুর কেবলা শরীয়ত, তরিকত ও সাধারণভাবে মানবকল্যাণে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার বিশালত্বের প্রকাশ সর্বমহলে তাক লাগিয়ে দেয়। হযরত ছোট হুজুর কেবলা ১৯৭৭ থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত ১০৩ জনকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন। গারাংগিয়া হুজুরদ্বয়ের মতাদর্শ এক, অভিন্ন। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত সুন্নি আকিদা। কিন্তু অন্য মতাদর্শের প্রতি বিদ্বেষ নয়, সহাবস্থানে বিশ্বাসী। ফলে আজও দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গারাংগিয়া হযরত পীর ছাহেবান সর্বমহলে সর্ব আকিদার কাছে অতি শ্রদ্ধাভাজন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছেন; যা দেশে বিরল।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধঢাকা ওয়াসার এমডির বেতন বোনাসের হিসাব চায় হাইকোর্ট