দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:৪৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল। কেন ঘুম ভাঙলো তা বুঝতে পারলাম না। দারুণ একটি স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্নের মধ্যেও বুঝতে পারছিলাম ওটি স্বপ্ন। তবুও সুন্দর স্বপ্নটি আমার মেজাজ ফুরফুরে করে তুলছিল। ভরে যাচ্ছিল মন। তাই ঘুম ভেঙে গেলেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। যদি আবারো স্বপ্নটি দেখা যায়! যদি আবারো ঘুরে আসে বর্ণিল সেই চমৎকার ক্ষণ!!
বেশ কুণ্ডুলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছিল ঘরনি। শীত কাতুরে স্ত্রী আমার। এসির সাথে জনম জনমের শত্রুতা। ঘামে গরমে একাকার হয়েও আমি মন ভরে এসি চালাতে পারি না। কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেলের বন্ধ দরোজা জানালার ভিতরে এসি ছাড়া কী বসবাস করা যায়? জ্বী, আমাকে করতে হয়। প্রায়শঃ। ব্যাপারটি এমন যে, হয় স্ত্রী নয়তো এসি। মাঝে মধ্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠি ঠিকই, তবে স্ত্রীর চেয়ে তো এসি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না। এই সাতসকালে এসি বন্ধ। ঘরে সাফোকেশন হয়, কিন্তু আমাকে তা হাসিমুখে হজম করতে হয়। দমবন্ধ অবস্থায়ও বুঝি আমাকে নিঃশ্বাস নিতে হয়!!
বেশ আয়েশ করে ঘুমুচ্ছিল বেচারি। মায়া লাগছিল। অনেক রাত অব্দি কি কি সব লেখাপড়া করেছে। ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে বহু বছর আগে, তবে এখনো প্রচুর পড়াশোনা করে। বলে না পড়লে পড়াব কিভাবে! স্ত্রীর ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম। বললাম, ক্ষুধা লেগেছে। রেডি হও। নাস্তা করতে যাবো। কথাটি ঠিক নয়, নাস্তা করতে একা একাতো আর যাবো না। সবাই মিলে যাবো। আমার এডিটর স্যার ফোন না করা পর্যন্ত ঘর থেকে বের হবো না। তবুও তাকে রেডি হতে বললাম। সে হাসলো। চোখ বন্ধ রেখেই বললো, স্যার কি ফোন করেছেন? আমি ‘না’ বলায় সে পাশ ফিরে আবারো কুন্ডুলী পাকানোর চেষ্টা করলো।
ইন্টারকম বেজে উঠলো। আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের ফোন। রিসিভ না করেই আমি বুঝতে পারি যে এটি স্যারের ফোন। স্যার কি বলবেন তাও যেন আমি জানি। তবুও রিসিভার তুললাম। স্যার বললেন, সবাইকে ডেকে নাও। নাস্তা করতে যাবো। অতপর আমি সকলের রুমে রুমে ইন্টারকমে ফোন দিলাম। রেস্টুরেন্টে যেতে বললাম। রেস্টুরেন্ট কোন ফ্লোরে কি অবস্থায় তা আগেই বলে দেয়া হয়েছে। রেস্টুরেন্টে ফোন করে উইন্ডোর পাশে দশ জনের বসার ব্যবস্থা রাখার জন্য অনুরোধ করলাম।
এসব হোটেলের নাস্তার বর্ণনা দিতে গেলে একটি আলাদা পর্ব করতে হবে। দুনিয়ার সব ফাইভ স্টার হোটেলের চেহারাই প্রায় একই। বিছানার ধরণ, নাস্তার আয়োজন সবই প্রায় একই রকম। রকমারি আয়োজন নাস্তার। দুনিয়ার সব জাতের সব পাতের খাবার যেন একই সাথে সাজিয়ে রাখা হয়। নানা রুচির মানুষ নানাভাবে সেই খাবার খায়। পূর্ব পশ্চিম কিংবা মধ্যের সব দেশের সব জাতের সব মানুষের খাবারে খাবারে সাজানো থাকে ডিশ। যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে খেতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যতক্ষণ সম্ভব খাওয়া যায়। ব্যুফে সিস্টেম। কেউ কাউকে কিচ্ছুটি বলে না। বরং খাবার সার্ভ করে দেয়ার জন্য, কিংবা আলসে লোকের খাবার এনে দেয়ার জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষ দারুণ সব স্মার্ট তরুণ-তরুণী মোতায়ন করে রাখে।
আমার এডিটর স্যার লায়ন এম এ মালেক এবং ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক, কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম কর্ণধার, সাবেক গভর্নর লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া এবং লায়ন সুপ্রভা বড়ুয়া বৌদি, মুনতাহা গ্রুপের চেয়ারম্যান, সাবেক গভর্নর লায়ন মনজুর আলম মনজু, লায়ন রাশেদা মনজুর ( আমাদের প্রিয় রাশু ভাবী), লায়ন নিশাত ইমরান, লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনা এবং মনজু ভাই-রাশু ভাবীর ছোট্ট খুকী মানারাসহ আমরা এগারজন। এগারজন মানুষের জন্য পাঁচটি গাড়ি। অথচ আমরা সকলে এক গাড়িতেই ঘুরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কিন্তু ট্যুর অপারেটর লায়ন আনোয়ারুল আজিম প্রতি পরিবারের জন্যই আলাদা করে গাড়ির ব্যবস্থা রেখেছেন। এডিটর স্যার আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা গিয়ে কোথাও ঘুরে টুরে আস। দিল্লীতে আমাদের ঘোরার তেমন কিছু বাকি নেই। এখন কোথাও যাবো না। লাঞ্চের পরে বের হবো।’ সবার সাথে কথা বললাম। সবার মতো করে প্রোগ্রাম করে নিলাম। আমাদের গাড়ি ছুটছে। দিল্লীর রাজপথ ধরে ছুটছি আমরা। অগুনতি গাড়ি। হাজার হাজার মানুষ। চারদিকে সাত রাজ্যের ব্যস্ততা। শুরুতে ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি দর্শণীয় স্থানগুলো ঘুরাতে। ড্রাইভার তার নিজের মতো করে প্রোগ্রাম করে নিয়েছে। গাড়ি কোথায় যাচ্ছে কোন পথে যাচ্ছে সেসব নিয়ে টেনশন না করে আমরা আমাদের মতো করে গল্প করতে লাগলাম।
আমাদেরকে কুতুবমিনারের গেটে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পার্কিং এ চলে গেল ড্রাইভার। বললো, আপনাদের ঘোরা হলে আমাকে ফোন করবেন। এখান থেকেই আমি আপনাদের তুলে নেবো।
আমরা হেঁটে টিকেট কাউন্টারের দিকে গেলাম। ভারতের প্রতিটি ট্যুরিস্ট স্পর্টের মতো এখানেও একই অবস্থা। ভারতীয়দের জন্য টিকেট ৩০ রুপি, বিদেশিদের জন্য ৫০০ রুপি। কি সাংঘাতিক অবস্থা! আমরা ভারতে বিদেশি। ড্রাইভার পশ্চিম বঙ্গের লোক পরিচয় দিয়ে ভারতীয় হিসেবে টিকেট কেনার বুদ্ধি দিয়েছিল। কিন্তু এত রক্তে কেনা বাংলাদেশকে অস্বীকার করে ভারতীয় পরিচয় দিতে শুধু লজ্জাই নয়, বিবেকেও বাঁধে। তাই ভারতের প্রতিটি পয়েন্টে বিদেশি হিসেবেই টিকেট কিনি আমি। কোন কোন ট্যুরিস্ট স্পর্টে সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য বিদেশি নাগরিকের চেয়ে কিছুটা কমে (ভারতীয় নাগরিকের জন্য নির্ধারিত দরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি) টিকেটের মূল্য নির্ধারিত থাকে। সেখানে সার্কভুক্ত দেশের নাগরিক হিসেবে টিকেট কিনি। হাজার হাজার টাকা বাড়তি দিতে বুকে বাজে ঠিকই, কিছু নিজের দেশ অস্বীকার করতে আরো বেশি বুকে লাগে।
কুতুবমিনারের ভিতরে প্রবেশ করলাম। বিশাল এক মিনার। আটশ’ বছর আগেকার এক স্থাপনা। ইটের তৈরি। পৃথিবীতে ইটের তৈরি সবচেয়ে বড় মিনার বা স্তম্ভ। আটশ’ বছর ধরে কি করে টিকে আছে! ঘোরলাগা চোখে আমি মিনারের শীর্ষে চোখ রাখলাম। ঘাঁড় বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ২৩৮ ফুট উঁচু। প্রায় চব্বিশ তলা একটি ভবন। ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের আদেশে কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১১৯৩ সালে। ১২২০ সালে এই মিনারের কাজ শেষ করেছিলেন কুতুবউদ্দীন আইবেকের পুত্র ইলতুৎমিস। তবে মিনারের উপরের তলাগুলোর কাজ সম্পূর্ণ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ সালে। ভারতীয়-মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে কুতুব মিনার বেশ গুরত্বপূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামানুসারেই কুতুবমিনারের নামকরণ করা হয় বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যে জানা গেছে। কুতুব মিনারের পাশেই রয়েছে কুতুবউদ্দীন আইবেকের পুত্র সম্রাট ইলতুৎমিসের সমাধি। এছাড়া আশে পাশে আরো বেশ কয়েকটি কবর রয়েছে। রয়েছে প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় স্থাপনা। এগুলোর অনেকগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেকগুলোর ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করা হয়েছে। সবগুলো মিলে কুতুব কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। কুতুব কমপ্লেক্সকে বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। পৃথিবীর অন্যতম নন্দিত একটি স্থাপনা হিসেবে কুতুবমিনারের খ্যাতি রয়েছে। বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে অন্তত পঞ্চাশ লাখ মানুষ কুতুবমিনার পরিদর্শন করে। সেই পঞ্চাশ লাখ মানুষের দুই জন হিসেবে আমরা কুতুব মিনারে প্রবেশ করলাম। কী অদ্ভুত কারুকাজ! কী অদ্ভুত এক স্থাপনা। স্বাধীনতা স্মারক হিসেবে নির্মিত হয়েছিল কুতুবমিনার। এত বছর পরও স্বাধীনতার জানান দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প এবং বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুব মিনার। মেরামতও করা হয়েছে। তবে এখনো মিনার সেই আগের মতোই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কুতুব কমপ্লেক্সের বিভিন্ন স্থাপনার দেয়ালের নানা স্থানে খসে গেছে। কোথাও কোথাও দেয়াল ভেঙ্গে গেছে। কোথাও ছাদ ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে চারপাশের নানা কিছু। বিভিন্ন দেয়ালের পরতে পরতে খোদাই করা পবিত্র কোরানের আয়াতগুলোও ক্যালিওগ্রাফিকর দারুণ মুন্সিয়ানার সাক্ষ্য বহন করছে। আমরা অনেকক্ষণ ঘুরলাম। অনেক কিছু দেখলাম। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের নানা অলিতে গলিতে হাঁটাহাঁটি করে বের হয়ে এলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থা : কামিনীর অবনী
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ