বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থা : কামিনীর অবনী

ফারহানা ইসলাম রুহী | বুধবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ

আদিম কালে পুরুষ যখন শিকারে ব্যস্ত, নারী নিয়েছে গৃহের আশ পাশ জুড়ে কৃষিকাজের ভার। আজকের এই বিশ্ব জুড়ে কৃষি শিল্প নারীর হাত ধরে এগিয়ে গেছে শতাব্দী পর শতাব্দী । চোখ মেলে তাকালে ই দেখি জুম চাষ, চা বাগানে নারী শ্রমিকদের সন্তানকে পিঠে বেঁধে জীবন জীবিকার নিরন্তন প্রচেষ্টা। খামার, গবাদি পশু পালন মৃৎ শিল্প হতে শুরু করে, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিদ্যমান শত রকমের ফ্যাক্টরিতে নারী শ্রমিকদের পদচারণা মুখর। গুরুত্ব ও বৃদ্ধি পাচ্ছে তারা সততা ও কর্ম নিষ্ঠার কারণে। গার্মেন্টস শিল্পকে বিশ্ব দরবারে নারী শ্রমিকরাই পৌঁছে দিয়েছেন এক উঁচু মাত্রায়। এই মহামারী কেড়ে নিয়েছে শত আশা আকাঙ্ক্ষা। হয়েছে লক্ষ্য জীবনের ছন্দপতন। মাটি চাপা পড়েছে অনেক পরিবারের সুখ স্বাচ্ছন্দ। ঘটেছে কত বিয়োগান্তক ঘটনা। আপনজনের মৃত্যুতে ভগ্ন, শোকাচ্ছন্ন শত হৃদয়। অনেকেরই স্বামীর চাকুরিচ্যুত হয়েছেন ব্যয় সংকোচন নীতির কবলে। কিংবা কারো কারো বেতন কাঠামো অর্ধেক। বেসরকারি শিক্ষিকা যারা সম্মানী পাননি। হারিয়েছেন টিউশনি। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যে উচ্চমাত্রা বৃদ্ধির কারণে, সন্তানদের ভালো স্কুল কলেজে পড়াশোনা চালাতে কাটছে কত নির্ঘুম রাত। এই বিশ্ব দুর্যোগ করোনা পরিস্থিতিতে দৈনন্দিন জীবনে শুরু হয়েছে ঘাত প্রতিঘাত নানা প্রতিকূলতা। পরিবারকে আর্থিক দৈন্য হতে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে, মেধা দক্ষতা ও ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নারীরা শুরু করেছেন ঘরে বসে টেইলারিং, মাস্ক তৈরি, অনলাইন কুকিং ক্লাস, ক্যাটারিং, ক্রাফট, নিজের বাগানের শখের কাক্টাস বিক্রি করে স্বাবলম্বী হবার অপার বাসনা। কেউ কেউ শখ বসে করতে গিয়ে নানান কাজে সাফল্যেরও মুখ দেখেছেন। এমন অনেকেই আছেন। পারিবারিক অর্থনীতিকে উন্নতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সংসারের যাঁতাকলে, অনেক সময় তারা পরিবারে সহযোগিতাও পাননি। স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির আপনজনদের উৎসাহ ও সাহায্যের অভাবে। নিজের প্রতিভা চাপা পড়ে গেছে। নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। মিলেছে আত্মবিশ্বাস। বিস্তর অবসরকে কাজে লাগাতে অনেকই বেছে নিলেন, নতুন করে বাগান করা, হস্ত শিল্প, সুই-সূচির কাজ, কুরশী কাজ, উলের বুনন, ব্লক বাটিক, নানা পণ্যের রিসাইক্লিন ব্যবসা। শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার জগতে যারা ছিলেন, গান, কবিতা, নৃত্য, একক অভিনয় ইত্যাদির ফেইসবুক লাইভ প্রোগ্রাম অংশগ্রহণের মাধ্যমে আত্মার খোরাক যুগিয়েছেন। ফিরে পেলেন যেনো হারানো সত্তা। শত ইচ্ছে থাকলেও যারা লেখালেখি থেকে যান্ত্রিক সভ্যতার কারণে অনেক দিন দূরে ছিলেন। তাদের হাত থেকে বে রিয়ে এসেছে নানার সুন্দর সব গল্প কবিতা আর কথামালা।
এই তো গেলো, সব আশার দীপ্তির কথা। নারীর প্রতিটা দিন শুরু হয় নিয়ে গভীর উৎকন্ঠায়। মা, স্ত্রী, কোনো কোনো পরিবারে বোন ও কন্যা পারিশ্রমিক বিহীন নীরব নিরলস শ্রমজীবী । কাজের লোক বিদায় করেছেন । করোনা প্রকোপ থেকে নিজ পরিবারের সুস্থতা নিরাপত্তার কথাটি ভেবে। সবাই সব কিছু ঠিক মত পাবে তো? না! এত হতেই হবে!
স্বামীর অফিসের টিফিন। প্রতিদিনকার রান্না, সন্তানদের পড়াশোনা। রোজগার গেরস্থালি কাজ। বয়স্ক মুরুব্বী থাকলে তার সেবা। সব কিছু আগের চেয়ে গুছিয়ে চলা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ চাইলেও কাউকে ডাকতে পারেনি কভিড এর ভয়ে। নিজের যত্ন নিতে সময় নেই তার। সবার পছন্দ, ইচ্ছে,ভালো লাগার পরিপূর্ণতা দিতে গিয়ে ভুলে যান প্রয়োজনীয় ঔষধ পথ্য গ্রহণ। তিনি শরীরের যত অসুস্থতা কষ্ট, যন্ত্রণা, মনের ব্যথা দেখান না কারণ একটাই ,সবাই কে খুশি ও নির্বিঘ্নে চলার পথ ঠিক রাখা। হোক তার যত যা তনা। আমি প্রশ্ন করি? হে নারী তুমি কি দেবদূত? কোত্থেকে পাও তুমি এমন কঠিন প্রেষণা? নারী বলে উঠেন! আমি নিতান্তই সাধারণ মানবী ! চাইনা শুনতে কারো অনুযোগ! কটূ কথা! না কোন খোঁটা, অবজ্ঞা ,উপহাস আর তাচ্ছিল্যে ভরা আচরণ, না বিবেকের দংশন! যদিও বলে তবুও শুনি! সারাদিন বসে বসে করিটা কি? এত আমার নিত্য প্রশ্ন! মাঝে মাঝে একঘেয়েমি কাজ করতে করতে খুব বিষণ্নতায় ভুগি। কেউ বোঝেনা এই আমাকে! তারা বলেন! আমি মানসিক রোগী। দিন পর দিন হচ্ছে আমার খিটখিটে মেজাজ। ভালোবাসা আর সহানুভূতিবিহীন এই জীবন চলা কত দুষ্কর। তবুও চলতে হবে। যত দিন যায় চলা এই ছিল উত্তর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যৌথ পরিবার আছে সব কিছু করেও অপরাধ বোধে ভুগতে বাধ্য করেন। পরিবারের সদস্যগণ। পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয়। বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
পরিবারে কঠিন দিনগুলিতে, পাশে থেকে নারী হাল ধরেন। সাহস যোগান। সেবা দেন নীরবে। সান্ত্বনা দিয়ে যান জটিল পরিস্থিতিতে আপনজনদের ।কিন্তু সেই মানুষটিকে কারণে অকারণে ছোট খাটো বিষয় নিয়ে অনেক সময় বিনা অপরাধে অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে, কোনো কোনো সময় প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌতুক দাবি নিয়ে ও যখন প্রশ্ন বিদ্ধ করে আঙুল তুলে হেনস্ত করে। তিনি কাউকে পাশে পান না ভেবে দেখুন কত মানবিক? সেই নারীদের মনের যন্ত্রণা বোঝার কেউ নেই। আপনজনরাই দূরে সরে যায় যার যার স্বার্থে। অনেক ক্ষেত্রে পাশে এসে স্বামী ও সেই ভাবে এগিয়ে আসেন না। কিন্তু তার উপস্থিতি এক বিশাল দায়িত্ব ।
জনম ধরে সর্বংসহা বটবৃক্ষ রূপে নারী।এই সব বিশেষণ কেবল নারীর জন্যেই সৃষ্টি। যার দরুণ বেশিরভাগ নারীকে অফিস থেকে ফিরে আগে উনন ঘরে দেন দৌড়। স্বামীর সন্তানদের জন্যে সব রেডি করে পরে নিজের চিন্তা করেন।
বুদ্ধি হবার পর থেকে কন্যা সন্তান দেখে বৈষম্যের শিকার। নারী জন্ম লগ্ন হতেই বোনের চেয়ে ভাইকে প্রাধান্য। কারণ বংশের বাতি। সমঝোতা কথাটি কন্যা সন্তানের জন্যে ছেলে সন্তানের জন্যে নয়। শ্বশুর বাড়িতে বউ হয়ে এসে বেশির ভাগ নারী মেয়ের মত ভালোবাসা পায় না। সেখানেও সমস্ত অধিকার থাকা সত্ত্বেও নারী বঞ্চিত। করোনা কালে দেখা গেছে শোষণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সহিংস তা বেড়েছে দ্বিগুণ। দেশের হাজার হাজার পরিবারে। কেউ প্রকাশ করে আর কেউ অসহায়, হয়ে সন্তান দের কথা ভেবে তার প্রতি প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অন্যায় কে মুখ বুজে সহ্য করে যান। দিনের পর দিন। এই বলয় থেকে বের হবার যেনো উপায় নেই। প্রতিবাদ করলে তালাক এমন বাক্য শুনতে হবে বা হচ্ছে। বাবার বাড়ির সহযোগিতা কামনার সুযোগ নেই। তারা হবেন নিরাশ্রিতা। কন্যা সন্তান থাকলে তো কথাই নেই। তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হবার কথা ভেবে তার উপরে ঘটে যাওয়ার সব অনাচার মেনে নেন। নিয়তির নির্মম পরিহাস ভেবে।
নারীর জটিল পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধতা। নারীর পারিবারিক সামাজিক নারীর নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের কর্ণধারদের সততার সাথে এগিয়ে আসা। প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অন্যায়কে প্রতিহত করা শক্ত হাতে।
প্রতিটি পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে তাদের ছেলে সন্তানদের নারীকে মর্যাদা দেবার দীক্ষা দান করার জন্যে। নারীর প্রতি অনাচারের বিরুদ্ধে, আত্মমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সঠিক সময়ে কঠোরভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। তবেই এই অপরূপ ধরিত্রী পেতে পারে নতুন প্রজন্মের জন্যে একটি বিশুদ্ধ নির্মল বিশ্ব সমাজ ।

লেখক : শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিউ ড্রপ্স প্রিপারেটরি স্কুল;
পাস্ট প্রেসিডেন্ট ইনার হুইল ক্লাব অব চিটাগাং ডিস্ট্রিক ৩৪৫।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে