প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

এ অঞ্চলে ধর্মীয় বিতর্কের আয়োজন
১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে বাঁশখালী গ্রামের বাড়ির সম্মুখস্থ মাঠে ধর্মীয় বিতর্কের (মুনাজেরা) আয়োজন করা হয়। এর আয়োজক হলেন আমিরুল হজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী। সময়টা সম্ভবত ১৯৪৭/৪৮ সালের দিকে।
সেই সময়ও দেশে ধর্মীয় দুই মতাবলম্বীর মধ্যে একে অপরকে মন্দ বলতে থাকত। খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর হয়ত এ বিভেদ অপছন্দ ছিল। ফলে তিনি চেষ্টা করেছিলেন বিভেদ পরিহার করে সহাবস্থানে আনা যায় কি না! যেহেতু তিনি ছিলেন আইনের শাসনের পাশাপাশি নিয়মনীতি মেনে সুন্দর সহাবস্থানে থাকার পক্ষে। সে সময় এ ধর্মীয় বিতর্ক তথা মুনাজারায় কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত অবস্থায়ও ১৫/২০ হাজার বা আরও বেশি লোকের সমাগম হয়। এতে বাঁশখালীর পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকেও ব্যাপক লোকজন উপস্থিত হয়। আজও বয়স্কজনের কাছে এ ধর্মীয় বিতর্কের ব্যাপারে আলাপ করতে শুনা যায়।
সে সময় দেশে প্রায় সকলে হানাফী মাজহাব এবং সুফিজমে বিশ্বাসী ছিল। তার পরেও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তথা সুন্নি ও ওহাবী। এ বিভক্তির বিষয়গুলো ইসলামের মূল/মৌলিকের অন্তর্ভুক্ত হউক বা না হউক এসব নিয়ে একে অপরকে মন্দ বলতে, ঘায়েল করতে কুণ্ঠিত হত না। তখন গ্রামে গঞ্জে ব্যাটারি সহযোগে মাইকের ব্যবহার ছিল। বর্তমানকালের মত ব্যাপক মাহফিল না হলেও পাড়ায় পাড়ায় মাঝে মধ্যে মাহফিল হত। তখন বৃহত্তর চট্টগ্রামে ধর্মীয় ওয়ায়েজ তথা বক্তা হিসেবে দুইজন প্রখ্যাত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একজন শেরে বাংলা হযরত মাওলানা আজিজুল হক আল-কাদেরী (রহ.)। তিনি হাটহাজারী উপজেলা সদরের আগে সড়কের পূর্ব সংলগ্ন মাজার নিয়ে শায়িত। অপরজন খতিবে আজম হযরত মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহ.)। চকরিয়া নিজ বাড়ির নিকটে শায়িত রয়েছেন। শোনা যায় ছোটকালে ওনারা দুজনই সমবয়সী ছিলেন, একই সাথে পড়তেন, ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুই দিকে দুই মেরুতে বিশ্বাস করে বসে। হযরত শেরে বাংলা (রহ.) সুন্নিয়ত, মিলাদ, কিয়াম, ফাতেহা ইত্যাদিতে বিশ্বাসী। অনেকটা বেরলভী আকিদা মতাদর্শী বলা যাবে। অপরদিকে, হযরত খতিবে আজম (রহ.) বিশ্বাস করতেন ঐ সব কিছু ধর্মের মৌলিক ত নয়ই, ধর্মের অন্তর্ভুক্তও নয়। এসব কিছু পরিহার করে চলাই উত্তম। তাকে দেওবন্দী মতাদর্শী বলা যাবে। সে সময় দেওবন্দী মতাদর্শকে ওহাবী বলা হত। নিজ বিবেচনায় এ নামকরণকে ভুল মনে করি। ভারতবর্ষের দেওবন্দ-হানাফী মাজহাব এবং সুফিজম মতাদর্শে বিশ্বাসী বলা যাবে। যা বর্তমান সুন্নি মতাদর্শ থেকে ভিন্নতর। অপরদিকে সৌদি আরবের মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদী থেকে এ ওহাবী শব্দটির উৎপত্তি। মূলকে শামের দামেস্ক কেন্দ্রিক ইবনে তাইমিয়ার মতাদর্শে বিশ্বাসী। যা বর্তমানকালে সালাফী বা আহলে হাদীস মতাদর্শী বলে অধিক পরিচিত।
১৯৮০/৯০ এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান তথা ভারতবর্ষে এ ওহাবী বা সালাফী বা আহলে হাদীস মতাদর্শে তেমন বিস্তার ছিল না। এমনকি জজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপে তেমন বিস্তার লাভ করে নাই। যেহেতু তথায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। পবিত্র মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৬৫ সালে। ফলে তথাকার সন্তানেরা কায়রো, বাগদাদ, কুফা, বসরার পাশাপাশি ভারতবর্ষে আসত উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য।
দেওবন্দ ও আহলে হাদীসের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের পার্থক্য। তারপরেও তাদের মধ্যে অনেকটা সহাবস্থানে রয়েছে। যেমন-দেওবন্দ মতাদর্শে মাজহাব (হানাফী), সুফিজম, মানুষের কল্যাণে তাবিজ, পানি পরা, ঝাড়ফুক ইত্যাদি নানা বিষয়ে শক্তভাবে বিশ্বাসী। অপরদিকে, আহলে হাদীস বা সালাফী বা ওহাবী মতাদর্শে এসব কিছু গ্রহণযোগ্য ত নয় বরং শিরক বেদআতের অন্তর্ভুক্ত বলে প্রচার করছে।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর দেওবন্দ থেকে মুফতি শফি (রহ.) করাচি চলে যায় । তথায় মসজিদ, মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা করে। পবিত্র কুরআন মাজীদের তাফসির লিখেন। নাম দেন মা’রেফুল কোরআন। এ বিখ্যাত তাফসীর ঢাকা মাওলানা মহিউদ্দিন খান উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। সৌদি সরকার পুনঃ মুদ্রণ করে ঢাকা দূতাবাসের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে হাজার হাজার কপি বিলিবন্টন করতে থাকেন বিনা হাদিয়ায়। ইহা বিশ্বে সর্বধিক পঠিত তাফসীর। ছোট ভাই সাবেক মেয়র ও এম.পি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর বাসায় হযরত মাওলানা জালাল উদ্দিন আল কাদেরী (রহ.) থেকে জানতে চেয়েছিলাম, কুরআন মাজীদের তাফসীর কোনটি অত্যধিক গ্রহণযোগ্য? তিনি কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন মা’রেফুল কুরআন উত্তম হবে।
সৌদি সরকার পরবর্তীতে জানতে পারল এ মা’রেফুল কোরআনে দেওবন্দ মতাদর্শের পক্ষে বিভিন্ন কথা বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ রয়েছে। পরে বিলিবণ্টন ত নয়ই সৌদি সরকার অবশিষ্ট যা রক্ষিত ছিল সেগুলো উঠায়ে লোহিত সাগরে ভাসিয়ে দেয় বলে জানা যায়।
বস্তুত ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে দেওবন্দ আকিদার বড় বড় আলেমেরা সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রসমূহে যাওয়া আসা শুরু করে। তথাকার শাইখরা এদেশে অকাতরে দান করতে থাকে মসজিদ, মাদ্‌রাসার জন্য। পরবর্তীতে ১৯৯০ এর দশক এবং এর পর থেকে বৃহত্তর কুষ্টিয়া, বৃহত্তর রাজশাহী, উত্তরবঙ্গ থেকে অসংখ্য আহলে হাদীসপন্থী সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রে যেতে থাকে। তারা মূলত সরকারি অফিস, শিক্ষা, ধর্মীয় গবেষণা কেন্দ্রে চাকরিজীবী হিসেবে গমন করে। বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার আহলে হাদীসপন্থী সৌদি আরবসহ আরব রাষ্ট্রে অবস্থান নেয় চাকরিজীবী হিসেবে। যেহেতু তাদের গ্রহণযোগ্যতা সে সব দেশে অত্যধিক। তাদের মাধ্যমে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রসমূহের যথাযথ দপ্তরে বুঝানো হয় ভারতবর্ষ শিরক বেদআতে ভরপুর। এতে তারা হজ্ব ওমরাকারীদের মাধ্যমে শিরক বেদআত মুক্ত থাকতে কোটি কোটি টাকার বইপত্র বিলিবণ্টন করতেছে। যেমনটা বিশ্বে অন্যান্য দেশের ভাষায়ও। মূলতঃ আহলে হাদীস বা ওহাবী দেওবন্দী মতাদর্শের সাথে এক নয়। যদিওবা অনেক ক্ষেত্রে সহাবস্থান দেখা যায়।
মূল কথায় ফিরে আসি; আমাদের দেশে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে ওহাবী সুন্নি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলে আসছে। এতে খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন উভয় মতাবলম্বীর দুই মুরব্বিকে এক স্থানে বসায়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি এসব কিছু বন্ধ করা যায় কিনা অর্থাৎ ধর্মীয় সহাবস্থানে আনা যায় কি না! ধর্মীয় বিতর্কের আয়োজন স্পর্শকাতর বিষয়। নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়। এতে মারাত্মক রূপ লাভ করার সমূহ সম্ভাবনা। খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব প্রভাব থাকার কারণে হয়তবা সম্ভব হয়েছে।
ব্রিটিশ পেরিয়ে পাকিস্তান আমলেও আমাদের দেশে ধর্মে সুন্নি ও দেওবন্দী দুই মতাদর্শে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৯০ এর দশকের পর থেকে উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গ থেকে আহলে হাদীস পন্থিদের সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রসমূহে গমন, তথা হতে ব্যাপক প্রচার, বিনামূল্যে বাংলা ভাষায় বই পত্র বিতরণ চলতেছে। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইন্টারনেটের প্রসারে আমাদের দেশে আহলে হাদীসের দ্রুত উত্থান চলতেছে। বড় বড় মসজিদে মাগরিব এশা নামাজে সমস্বরে আমিন বলা হচ্ছে। যে হারে দেশে আহলে হাদীসপন্থিদের সংখ্যা বাড়তেছে আমাদের অবর্তমানে সন্তানদের আমলে তরিক্বত, মাজহাব, সুফিজম কোন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে ভাবতে হবে।
১৪০০ বছরের মাজহাব, সুফিজম ২০০০ দশকে আহলে হাদীসপন্থিদের উত্থানে কতটুকু টিকে থাকবে ভাববার বিষয়। তারপরেও আমাদের বুঝে আসতেছে না, আমাদের মধ্যে এখনও ওহাবী, সুন্নি নিয়ে হিংসা বিদ্বেষ বাড়াবাড়ি দূরত্ব রয়েই গেছে। ফলে স্বভাবতই আমাদের সন্তানেরা আমাদের এসব দেখে আহলে হাদীসপন্থি উত্তম বিবেচনা করে ঐ দিকে চলে যাবে স্বাভাবিক। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সুন্নি ও দেওবন্দী মতাবলম্বী উক্ত বিষয়ে ভাবা দরকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধমাদকের সঙ্গে কোনো আপস নয়