তুষারধসের মুখোমুখি

বাবর আলী | সোমবার , ২৭ জুন, ২০২২ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

পর্ব-১

আগের দিনের বড় একটা অংশই কেটেছে রুট ওপেন করতে যাওয়া আমাদের দুই পাহাড়ি বন্ধু তথা শেরপাদের দিকে চোখ রাখতে গিয়ে। বেস ক্যাম্পে বসে বসে পুরো দিনই দূরের রক ওয়ালটার পানে চোখ রাখছিলাম। একমাত্র বাইনোকুলারটা কখনো ওর চোখে, কখনোবা ওর দুই নেত্রে। মেঘ এসে ওদেরকে ঢেকে দিয়ে দৃষ্টিসীমার আড়াল করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সটান হয়ে বসে ওদিকেই সকলের অখন্ড মনোযোগ। মেঘ-সূর্যের লুকোচুরিতে মেঘকে পরাভূত করে সূর্যের জিত না হওয়া অবধি আবার নিজেদের মধ্যে নানান বিষয়ে গল্প। সূর্যের আলোকচ্ছটায় মেঘ হটিয়ে দূরের পাথুরে দেয়ালটা দৃশ্যমান হতেই আড্ডার মোড় ঘুরে নেমে আসে নীরবতা। উৎসুক নয়ন খুঁজে ফেরে পাথুরে দেয়ালে কালো দুটো বিন্দু।

শেষ বিকেলে আমাদের দুই পাহাড়ি বন্ধু ফিরে আসার পরে খাবারদাবার খেয়ে ওরা ধাতস্থ হবার পরেই উপরে কী হলো সেটা সাগ্রহে জানতে গুড়ের সন্ধানে থাকা পিঁপড়ের দলের মতো লাইন করে ওদের তাঁবুতে গেলাম। দুই পাহাড়ি বন্ধু ক্যাম্প ওয়ানের উপরের পাথুরে দেয়ালটায় রোপ ফিক্স করে এসেছে। বেস ক্যাম্পে বসেই আমরা তা দেখতে পেয়েছি। রোপ ফিক্স করে রক ওয়ালটার উপরে উঠেই র‌্যাপেল (পাহাড় কিংবা পাথুরে গাত্র বেয়ে দড়ির সাহায্যে নামা) করে নেমে যায়নি। আরো উপরে যাওয়ার পথটুকুও রেকি করে এসেছে। উপরের স্নো কন্ডিশন ভালো হলেও একটা কথা শুনে আমরা খানিকটা দমে গেলাম। শেরপাদের ভাষ্যমতে, শেষ দিকে আমাদের রোপ কম পড়তে পারে। সে সম্ভাবনা যথেষ্ট। তবে এটা যদিও সম্ভাবনার কথা। যাই হোক, ঠিক হলো পরদিন ভোরেই বেরোচ্ছি আমরা।

পাহাড়ে আমি সবসময়ই তাড়াতাড়ি শুতে যাই বলে আমার ঘুমটাও খানিকটা তাড়াতাড়িই ভাঙে। এমন জায়গায় বসে সূর্যোদয় দেখতে চাওয়ার লোভ থেকেই রোজ সূর্য উঠার আগেই ঘুম থলি তথা স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতা ছাড়ি। সেদিন বেশ কিছুক্ষণ স্লিপিং ব্যাগ আঁকড়ে পড়ে থেকে অনাগত দিনগুলোর কথা চিন্তা করে নিজের মধ্যেই একটা উত্তেজনা অনুভব করলাম। আজ বেস ক্যাম্প ছেড়ে উপরের দিকে যাত্রা করব বলে ভোর থেকেই আমাদের শেরপা বন্ধুরা পুজোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। পূজার বেদি বানানো হচ্ছে আশেপাশ থেকে কুড়ানো পাথর দিয়ে। সময় বাঁচাতে সকলেই হাত লাগাল। মাউন্টেন গডের উদ্দেশ্যে দেওয়া পুজোর প্রসাদ হিসেবে খাবারদাবার, মিষ্টান্ন যেমন থাকে, তেমনি থাকে পর্বতারোহণে ব্যবহৃত নানান সরঞ্জামও। নাতিদীর্ঘ আরাধনার শেষ হলো বেদিকে কয়েক চক্কর ঘিরে চাল ছিটিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। অভিযানের কুক চন্দ্রা বাকিদের উপাসনা শেষ হওয়ার পরেও মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলেন। ওনার এই প্রথম পর্বতে আসা। মিনিট বিশেকের মধ্যে পায়ে স্নো বুট গলিয়ে, পিঠে ব্যাকপ্যাক চাপিয়ে আমরা রেডি। লাকপা আমাকে দেখিয়ে দিল কোন দিক দিয়ে যেতে হবে। আর ক্যাম্প ওয়ানের জায়গাটাও ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিল। গ্লেসিয়ার (বরফের নদী) থেকে নেমে আসা পানির ধারা তথা নালাটা কোন দিক দিয়ে পেরোনো সুবিধা হবে সেটাও জেনে নিলাম ওর কাছ থেকে। খানিক বাদেই আমরা পাঁচ অভিযাত্রী বেরিয়ে গেলাম। আমাদের দুই শেরপা আর কুক রওনা দেবে বেস ক্যাম্পের বাঁধাছাঁদা শেষে।

ভোরের প্রথম সূর্য কিরণটা আমাদের লক্ষ্য অনামী পাহাড় চূড়াটার উপরেই পড়ে। গত কদিনের অভ্যস্ত চোখ তাই বলে। আজ যাত্রার শুরু থেকেই আকাশ খানিকটা গুমোট। স্নো বুট পরায় চলার গতি কিছুটা হলেও শ্লথ। তানভীর ভাই, মনির ভাই আরা আমার স্নো বুটে অভ্যস্ততা থাকলেও জিতু আর আইয়ুবের জন্য ব্যাপারটা নতুন। তবে কিছুক্ষণ চলার পরেই বেশ সাবলীল দেখলাম ওদেরকে। পথ চলতে চলতে চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে এটা-ওটা নিয়ে কথা বলেই যাচ্ছি অনর্গল। কিছু দূর গিয়ে সুবিধাজনক একটা জায়গা খুঁজে নিলাম নালাটা পেরোবার জন্য। হিমালয়ের গ্লেসিয়ারগলা এসব নালা পার হবার মোক্ষম সময় সকালবেলা। এরপর দিনের আলো যত বাড়ে, সূর্যের ক্রমাগত তাপ বিকিরণে নালাগুলোর উচ্চতাও বাড়তে থাকে। বরফ গলা হিমশীতল জলের এসব নালায় একবার পা হড়কালে হাইপোথারমিয়া (শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া) হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তেমন একটা পরিস্থিতে পড়েছিলাম আমরা একবার। মাউন্ট ইয়ানাম থেকে ফেরার সময়ে ভরতপুরের কাছের নালাটা পার হতে গিয়ে ভেসে গিয়েছিলেন শিহাব ভাই। সময়টা ছিল শেষ বিকেল।

থরথর করে কাঁপতে থাকা শিহাব ভাইকে সেদিন ধাবায় চার-পাঁচটা কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছিলাম আমরা। জোর করে গরম তরল খাওয়াচ্ছিলাম বারে বারে। উৎকণ্ঠিত কয়েক জোড়া চোখ কিছুক্ষণ পরপরই তার সেরে উঠা পরিমাপ করার চেষ্টা করছিল। যাই হোক, সকাল সকাল নালা পার হওয়াতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। পায়ে স্নো বুট থাকায় সেগুলোকে বাঁচাতে একটু নিচু অংশে পাথর ফেলে দারুণ ব্যবস্থাই করে ফেলেছি আমরা। সারসের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে নির্বিঘ্নে নালা পেরিয়ে ওই পাশে এসে নালার ধার ঘেঁষেই পথচলা।

নালার পানির রং দেখে আরো এক প্রস্থ মন খারাপ। নিচের দিকে বেস ক্যাম্প ঘেঁষে নামা এই নালার পানিই গত কদিন ধরে পান করছি আমরা। বৃদ্ধের ছানি পড়া চোখের ন্যায় ঘোলা পানি। রান্নাবান্নার কাজেও ব্যবহার করেছি। সেদিকে তাকিয়ে আরেক প্রস্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে চলা। আরো মিনিট বিশেক চলার পরে খাড়া নেমে যাওয়া গ্লেসিয়ারের অংশে চলে এলাম। গত পরশু দলের সবাই মিলে এখানেই আইস ক্রাফটের (বরফে আরোহণের কৌশল) দক্ষতাটা ঝালিয়ে নিয়েছি। মূলত ফ্রন্ট পয়েন্টিং (খাড়া বরফের দেয়ালে আরোহণের এক ধরনের কৌশল) আর আইস এক্সের (বরফে ব্যবহৃত এক ধরনের কুঠারবিশেষ) ব্যবহারই ঝালিয়ে নেওয়া আরেক দফা। জায়গাটা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। অনবরত পাথর গড়িয়ে পড়ছে বাম পাশ থেকে। হেলমেটটা ব্যাকপ্যাকের বাইরের স্ট্র্যাপে ঝোলানো ছিল। সেটাই এক ফাঁকে গলিয়ে নিলাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধতেল থেকে জল