তেল থেকে জল

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ২৭ জুন, ২০২২ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

দুনিয়ায় সব্বাই তো মুনাফা চায়, তাই না? আর, তেলের কোম্পানীগুলো তো মুনাফার তেলের উপরেই ভাসে। তা সেই মুনাফা বেশ কয়েকভাবেই করা যায়। তাদের মধ্যে প্রধান হলো, তেল সম্পূর্ণ রিফাইন বা পরিশোধিত না করা। মাটির তলা থেকে খনন করে তোলা তেলের মাঝে বালু থাকবেই, পানিও থাকবে। যতই রিফাইন করবেন, ততই দাম বাড়বে। অন্যদিকে জাহাজ কোম্পানীর মালিকপক্ষও চেষ্টা করে কমদামে তেল কিনতে। তার মানেটা কী দাঁড়ালো? জাহাজে অল্পপরিশোধিত তেল কমদামে নেওয়া হয়। কিন্তু, সেই তেল যদি ডাইরেক্টলি ব্যবহার করেন, কয়েকদিনের মধ্যেই ইঞ্জিনের বারোটা বেজে যাবে।

সুতরাং, আমাদেরকে জাহাজেই কিছুটা হলেও রিফাইনারির মতো কাজ করতে হয়। তার উপরে, খরচ কমানো ছাড়াও আর একটা ব্যাপার আছে- জাহাজগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে, এবং অনেক পোর্ট থেকেই তেল কিনতে হয়- আমরা বলি বাঙ্কার (bunker) নেওয়া। অনেক সময়ই, কাগজেকলমে যা লিখা, তার থেকেও বেশী পানি-বালু থাকে তেলের মাঝে। জাহাজ চালাতে প্রচুর তেল লাগে বলে, সবসময়ই চেষ্টা চলে কমদামের তেল কিনতে। সেই সুযোগে যারা তেল সাপ্লাই দেয়, তারাও স্বাভাবিক বালুর সঙ্গে আরও একটু বালু বা পানি মিশিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না (গোয়ালা আর তেলওয়ালা সব্বাই এক)। কিন্তু, ম্যাও সামলাতে হয় আমাদেরকে। শুধু পানি-বালু না, আরো অনেক অবাঞ্ছিত অপদ্রব্যও থাকে- সালফার বা অন্যান্য ক্ষতিকারক কেমিক্যাল। সেজন্যে আজকাল অনেক দেশই পরিবেশ-দূষণ থেকে রক্ষার জন্যে, তাদের সমুদ্রসীমার মাঝে হেভী-ওয়েল জ্বালানোর ব্যাপারে কড়া আইন ও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।

জাহাজে জ্বালানী তেল দুই ধরনের থাকে- হেভী-ওয়েল (Heavy oil) ও ডিজেল। আজকাল অবশ্য ডিজেলের বদলে, আল্ট্রা-ক্লিন গ্যাসোলিন ব্যবহার হয় বেশী। ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদনের জন্যে জাহাজের তিন-চারটা জেনারেটর থেকে, সেগুলো ডিজেলে বা গ্যাসোলিনে চলে। আর, জাহাজ চালানোর মেইন-ইঞ্জিন এই দুই ধরনের জ্বালানীতেই চলে। গভীর সমুদ্রে গেলে, যেখানে জাহাজ দিনের পর দিন (অথবা ঘন্টার পর ঘন্টা) ফুল স্পিডে চলতেই থাকবে, সেখানে হেভি-ওয়েল ব্যবহার হয়। কিন্তু তীরের কাছাকাছি আসলে, বা নদীতে ঢুকলে, যখন ইঞ্জিনের স্পিড বাড়াতে-কমাতে হয়, তখন আমরা ডিজেল ব্যবহার করি। স্পিড উঠানামার সময়ে (ম্যানুভেরিং maneuvering), হেভি-ওয়েল ব্যবহার করলে ইঞ্জিনের ক্ষতি হয়। ডিজেল বেশ রিফাইন্ড্‌; কিন্তু হেভি-ওয়েল সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। বেশ ঘন, কালো ঝোলাগুড় বা রাবের মত থাকে। সেটাকে গরম করা ছাড়া এক ট্যাঙ্ক থেকে আরেক ট্যাঙ্কে ট্রান্সফারই করা যায় না; আর তার উপরে থাকে বালু-পানি ও অন্যান্য ইম্পিউরিটি। সেজন্যে আমরা পিউরিফায়ার (Purifier) নামের এক ধরনের মেশিন ব্যবহার করে সেই তেলকে ইঞ্জিনের উপযোগী করে তুলি। সাবধানের মার নেই, তাই ডিজেলকেও পিউরিফায়ারের মাঝে শোধন করে নেই। অবশ্য আল্ট্রা-ক্লিন গ্যাসোলিনে সেটা লাগবে না। আর আজকাল আধুনিক প্রযুক্তির ইঞ্জেক্টরের বদৌলতে অনেক জাহাজে ম্যানুভেরিং-এর সময়েও হেভি-ওয়েল ব্যবহার করে।

জ্বালানীর পরে আসে লুব্রিকেটিং ওয়েলের ব্যাপার। সেগুলো যখন কেনা হয়, তখন ভালই থাকে। কিন্তু ইঞ্জিনে-মেশিনে ব্যবহার করার পরে সেগুলোকেও পিউরিফাই করে নিতে হয়। লুব-ওয়েল ব্যবহারে এর মাঝে ময়লা জমে, বিশেষ করে কার্বন বা অন্যান্য জিনিস। মাঝেমাঝে পানিও মিশে যায়- সেটা হলে মারাত্মক ক্ষতির ব্যাপার। ইঞ্জিনে ব্যবহারে লুব-ওয়েল গরম হয়ে গেলে, আমরা হিট-এক্সচেঞ্জারের মাধ্যমে ঠান্ডা করি, যেখানে একদিক দিয়ে ঠান্ডা পানি আর অন্যদিক দিয়ে গরম লুব-ওয়েল চলে। কোনোটাই একে অন্যকে স্পর্শ না করেই, একজনের তাপ অন্যজনে নিয়ে নেয়; যার ফলে লুব-ওয়েল ঠান্ডা পানি দ্বারা ঠান্ডা হয়ে যায়। মাঝে মাঝে, এই হিট-এক্সচেঞ্জার ফুটা হয়ে লিক করলে পানি মিশে যেতে পারে। লুব-ওয়েলের কাজই হলো পিচ্ছিল করা, কিন্তু পানি মিশলে সেই বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যায়। বরং আরো ক্ষতি করে, মরিচা পড়তে সাহায্য করে। তাই লুব-ওয়েলে পানি একদমই বরদাস্ত করা যায় না। অনেক সময়ে লোহার গুড়া বা অন্যান্য কিছুও মিশতে পারে।

অনেকক্ষণ ধরেই তো খালি বলেই চলেছি; কিন্তু পিউরিফায়ার জিনিসটা আসলে কি? এটা খুব একটা কমন মেশিন না। তাহলে আসুন, সেটা কী জানার চেষ্টা করি। আমি আপনাদের বিজ্ঞান পড়ানোর চেষ্টা করে ফেলতে পারি। পিউরিফায়ারের আর একটা নাম আছে- সেন্ট্রিফিউজ (centrifuge)। নামটা এসেছে centrifugal force থেকে। একটা দড়ির এক প্রান্তে পাথর বেঁধে বন্বন্‌ করে ঘুরাতে থাকলে, পাথরটা সেন্ট্রিফুগাল ফোর্স অনুভব করবে; এবং ছিটকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। অন্যদিকে দড়িটা নিজেও উল্টাদিকে একটা ফোর্স অনুভব করবে, যার নাম সেন্ট্রিপেটাল ফোর্স। হুট করে দড়িটা যদি কেটে দেওয়া হয়, তাহলে সেন্ট্রিফুগাল-এর কারণে পাথরটা দূরে উড়ে যাবে; আর যে দড়ি ধরে ছিলো সে সেন্ট্রিপেটাল-এর কারণে, ভিতরের দিকে একটা টান অনুভব করবে, এমনকি চিৎপটাং পড়েও যেতে পারে। ক্ষমা চেয়ে নিয়ে, আর দুইটা উদাহরণ দিই। কাদামাটিতে গাড়ি চালালে, চাকা থেকে যেই কাদা ছিটকে ছিটকে যায়, সেটা সেন্ট্রিফুগাল। আর সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবী যেই টান অনুভব করে সেটা সেন্ট্রিপেটাল। এরপরে আর একটা জিনিস বলি- আপেক্ষিক গুরুত্ব (specific gravity)। তেলের আপেক্ষিক গুরুত্ব কম বলে সেটা পানির উপরে ভাসে; আর বালুরটা পানির চেয়ে বেশী বলে সেটা তলায় জমে যায়। এখন আমি যদি একটা ডেকচির মাঝে তেল-পানি-বালুর মিশ্রণকে নিয়ে বন্বন্‌ করে ঘুরাতে থাকি, তাহলে সেন্ট্রিফুগাল ফোর্সের কারণে সবচেয়ে ভারী জিনিস (বালু) একদম দূরে ডেকচির দেওয়ালের কাছে চলে আসবে, এরপরে পানি থাকবে; আর কেন্দ্রের দিকে থাকবে তেল। খুব ভালোমত খেয়াল করলে, এই তিন জিনিসের মাঝের বাউন্ডারি খুবই স্পষ্টভাবেই দেখা যাবে। ব্যস্‌, এই পর্যন্তই বিজ্ঞানের পড়া শেষ। এবারে মেশিনটার দিকে যাই।

তেল কিনে জাহাজে, প্রথমে বড় বড় স্টোরেজ ট্যাঙ্কে রাখে; তারপরে সেখান থেকে নিয়ে স্যাটেলিং ট্যাঙ্কে। এগুলোতে একটু একটু করে তেলকে গরম করা হয়। আর স্যাটেলিং ট্যাঙ্কে কিছুটা থিতু হলে, পানি তলার দিকে জমা হয়। আমরা সেখানে একটা ট্যাপ খুলে অল্প কিছুটা পানি বের করে দিতে পারি। এরপরে আরো একটু গরম করে পিউরিফায়ারে সাপ্লাই দেই। পিউরিফায়ারের মাঝে একটা গামলা (নড়ষি বা ডেকচি) ভীষণ স্পীডে ঘুরে (মিনিটে প্রায় ৫,০০০ থেকে ৭,০০০ চক্কর; অথবা সেকেন্ডে ৮০ থেকে ১০০ বার)। এর মাঝ দিয়ে সেই অপরিশোধিত তেল ঢাললে, ডেকচির উদাহরণের মত সেগুলো আলাদা হয়ে যাবে- পানি একদিক দিয়ে বের হবে, সলিড (বা স্লাজ sludge) অন্যদিক দিয়ে; আর পিউরিফাইড্‌ তেল একদিক দিয়ে। শুধু গামলা নয়, এর মাঝে অনেকগুলো পড়হব আকৃতির ডিস্ক একটার উপরে একটা স্ট্যাক করা থাকে। পরিশোধিত তেল সেগুলোর মাঝ দিয়ে চিপে-চিপে চালান করা হয়, যাতে কোন ধরনের ময়লা বা পানি আর একটুও বাকি না থাকে। তবে এখানে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আইটেম হলো একটা গ্র্যাভিটি-ডিস্ক। তেলের আপেক্ষিক-গুরুত্বের হিসাবে, সঠিক গ্র্যাভিটি-ডিস্ক ব্যবহার করতে হয়, তাহলেই তেল ও জলের সুস্পষ্ট সীমানা তৈরী হবে। আর তা নাহলে, সীমানা নড়ে গিয়ে তেলের দিক দিয়ে পানি বের হবে; অথবা পানির রাস্তা দিয়ে তেল বের হয়ে গিয়ে, দামী তেল লস্‌ হবে। তখন জবাবদিহি করতে করতেই জীবন যাবে।

জাহাজে জুনিয়ার র‌্যাঙ্কের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ারকে পিউরিফায়ারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নতুন এবং জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার বলে, সবসময়ই তারা এইটা নিয়ে যুদ্ধ করে। অনেক জাহাজেই পিউরিফায়ারের সঙ্গে আর একটা মেশিন থাকে, ক্ল্যারিফায়ার (clarifier)। সবই একই কিন্তু এটাতে পানি আলাদা করা যায় না। পিউরিফায়ারের পরেই যে ডাইরেক্ট ইঞ্জিনে তেল দেওয়া হয় তা-ও কিন্তু না। এরপরেও তেলকে ফিল্টারের মাঝ দিয়ে নিয়ে, তারপরে ইঞ্জিনে সাপ্লাই দেয়।

অনেকক্ষেত্রেই লাইনে বেশ কয়েকটাই ফিল্টার থাকে। ম্যাগনেটিক ফিল্টারও থাকে, ধাতব টুকরা (বা গুড়া) ধরার জন্যে। আরো থাকে আল্ট্রা-ফাইন ফিল্টার। তেল যত পরিষ্কার, মাথাব্যাথা ততই কম-ইঞ্জিন ভালো চলবে, পরিবেশ-দূষণ কম হবে, টাকা-পয়সার সাশ্রয় হবে। আর তা নাহলে তো বুঝতেই পারছেন পিউরিফায়ারের প্যারায় পড়বেন।

refayet@yahoo.com
টলিডো, ওহাইও, ২০২২

পূর্ববর্তী নিবন্ধতুষারধসের মুখোমুখি
পরবর্তী নিবন্ধদুই ট্রাক চালককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা