ভূমিকম্প–কথাটার সাথে শিশু–যুবা–আবাল–বৃদ্ধ–বনিতা সবাই কমবেশি পরিচিত। ছোট বেলায় ভূমিকম্প হলে আমরা সবাই খুব ভয় পেয়ে ঘরের বাইরে চলে যেতাম। বাবা–মা’রা আমাদের আগলে ধরে রাখতেন। পুরো ঘরটা যেন নড়ে চড়ে উঠে। ভূ–কম্পন সৃষ্টির ফলে ঘরবাড়িগুলো কেঁপে উঠে। গাছপালা উপড়ে যায়। পুকুরের পানিতে প্রচন্ড ঢেউ সৃষ্টি হয়। মাছগুলো লাফালাফি করে। মসজিদ থেকে আযানের শব্দ শুনা যায়।
সবাই আল্লাহর সমীপে সেজদায় লুটিয়ে পড়েন। অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী ভূকম্পনের পরবর্তী পদক্ষেপ থাকত খুবই ভয়াবহ। দেখা যায়, অনেক কাঁচা–পাকা ঘরবাড়িতেও ফাটল ধরে যায়। রাস্তাঘাটগুলোতে ফাটল ধরে যায়। গাছপালাগুলো উপড়ে যায়। অনেক পশুপাখির ক্ষয়ক্ষতি হয়। এটি মোকাবেলায় দীর্ঘসময় লেগে যেত অসহায় মানুষদের। এই হল ছোটবেলায় ভূমিকম্প দেখার চাক্ষুষ প্রতিবেদন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক–সিরিয়ার সীমান্তবর্তী গাজিয়ান্তেপ শহরে শতাব্দীর ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে যার মাত্রা ছিল ৭.৮। এই ভূমিকম্পের ফলে অনেক ভবন মুহূর্তেই ধসে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে এবং আহতের সংখ্যাও লাখের কাছাকাছি। ভূমিকম্প পরবর্তী যে কম্পনগুলো হয়েছে তাও অত্যন্ত ভয়াবহ এবং মূল ভূমিকম্পের চেয়েও অধিক শক্তিশালী। ভবনের নিচে আটকা পড়া অসহায় মানুষদের আর্তচিৎকারে আকাশ–বাতাস ভারী হয়ে উঠে। উদ্ধার কর্মীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন তাদের উদ্ধার কাজ চালিয়ে যেতে। এখনো উদ্ধার কাজ চলছে–জীবিত উদ্ধারের খবর পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন শহর থেকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি খুবই চাউর হয়েছে। আধা বয়সী এক পিতা ভবনের নিচে চাপা পড়ে নিহত ১৫ বছর বয়সী কন্যার হাত ধরে বসে আছে দু’দিন ধরে। এই হৃদয়বিদারক ছবি দেখে পাষাণ ব্যক্তির হৃদয়ও গলে যায়। অন্য একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই ভাইরাল হয়েছে। ৪/৫ বছর বয়সী ছোট্ট শিশু কন্যা তার আদরের দেড় থেকে দু’বছর বয়সী বোনকে আগলে ধরে আছে ধ্বংসস্তূপের নিচে, যেন তার উপর কংক্রিটের কোনো আঘাত না লাগে। এই ছবিটিও বিশ্ববাসীর হৃদয়কে দিয়েছে প্রচন্ড নাড়া। এভাবে অনেক হৃদয়বিদারক ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে এখনও। এমনও খবর পাওয়া গেছে অনেক শিশু ভবনের নিচে আটকা পড়ে বেঁচে আছে। সবকিছুই আল্লাহর কুদরত। কেনই বা তুরস্কে এত ভয়াবহ ভূমিকম্প? তার কারণ যেটা জানা গেল তা হচ্ছে–এটির মাত্রা ছিল ৭.৮। যেটি শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে উল্লেখযোগ্য হিসাবে। এটি ১০০ কিলোমিটার ধরে আঘাত এনেছে এবং এর কারণে ভবনগুলোতে মারাত্নক ক্ষতি হয়েছে। জনৈক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, যে কোন বছরের তুলনায় সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ছিল এটি। গত ১০ বছরের মধ্যে মাত্র ২টি ভূমিকম্প এই মাত্রার ছিল। আর এর আগের ১০ বছরে মাত্র ৪ টি ভূমিকম্প এই মাত্রার ছিল। তবে শুধু কম্পনের শক্তির কারণেই এতো বেশি ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। এই ঘটনাটি ঘটেছে ভোরের দিকে, যখন মানুষ ঘরের ভেতরে ঘুমাচ্ছিল। ভবনের দৃঢ়তাও একটি বিষয়। সিরিয়ার অবকাঠামোগুলো খুব একটা ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়।
ভূমিকম্পের কারণ কী?
পৃথিবীর ভূ–পৃষ্ঠ আলাদা বিট দিয়ে গঠিত, যাকে প্লেট বলা হয়, যা একে অপরের পাশাপাশি অবস্থান করে।
এই প্লেটগুলি প্রায়শই নড়াচড়া করার চেষ্টা করে। কিন্তু পাশে থাকা অন্য আরেকটি প্লেটের সাথে ঘর্ষণের মাধ্যমে এই নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয়। তবে চাপ বেশি বেড়ে গেলে কখনো কখনো একটি প্লেট হঠাৎ করে ঝাঁকুনি দেয়ায় ভূ–পৃষ্ঠের উপরিভাগ সরে যায়। এবার এরাবিয়ান প্লেটটি উত্তর দিকে সরে যায় এবং উত্তর দিকে সরে যাওয়া আনাতোলিয়ান প্লেটে গিয়ে ধাক্কা দেয়। প্লেটগুলোর এ ধরণের ঘর্ষণের কারণে অনেক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। এর কারণে ১৮২২ সালের ১৩ আগস্ট ৭.৪ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল যা সোমবার হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পের তুলনায় বেশ কম। তা সত্ত্বেও, উনিশ শতকের ভূমিকম্পের ফলে এলাকার শহরগুলির প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল, শুধু আলেপ্পো শহরেই সাত হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ক্ষতিকর আফটারশক প্রায় এক বছর ধরে চলতে থাকে।
৮৪ বছরের রেকর্ড ভাঙল তুরস্কের ভূমিকম্প
মাত্র এক মিনিটের ভূকম্পন! মুহূর্তে লন্ডভন্ড তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহর। সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ার সীমান্ত শহরগুলোও। ভূকম্পনপ্রবণ অঞ্চল তুরস্কে ভূমিকম্প নতুন কিছু নয়। নিয়মিত ঘটনা। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ২০২০ সাল। ওই বছর দেশটিতে সব মিলিয়ে ৩৩ হাজার বারেরও বেশি ভূমিকম্প হয়েছিল। এর মধ্যে রিখটার স্কেলে চার মাত্রার বেশি ছিল ৩২২টি। তুরস্কের বেশ জনপ্রিয় একটি প্রবাদ-‘জমিনই নিয়তি’। এই প্রবাদই বলে দেয়, ভূমিকম্পের সঙ্গে তুর্কিদের সম্পর্ক কতটা গভীর। কিন্তু সোমবারের ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প রীতিমতো তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে গেছে তুরস্কে। ১৯৩৯ সালের পর ৮৪ বছরে এমন ভূমিকম্প দেখেনি তুরস্ক। ১৯৩৯ সালেও তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। সে সময় অন্তত ৩৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সোমবার যে এলাকায় ভূমিকম্পটি আঘাত হেনেছে, ওই এলাকায় ভূমিকম্পের প্রবণতা অনেক। সোমবারের ভূমিকম্পটি সামপ্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পগুলোর চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
তুরস্কের যে ভয়াবহতা বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে তার আরও ভেতরের কারণ যদি আমরা খুঁজতে যাই, তাহলে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে– এভাবেই সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা ভূমিধস, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, করোনা ভাইরাস এর মতন বিপদগুলো দিয়ে থাকেন তাঁর বান্দাদের সতর্ক করার জন্য–যাতে করে মহান আল্লাহর দিকে নিজের জীবনটাকে পরিশুদ্ধ করা যায়। অথচ বিপদ আপদ শেষে আমরা নিমিষেই ভুলে যাই সেই সত্তাকে–যিনি আমার ও আপনার রব। যাঁর হাতে মহাকাশ, নভোমন্ডল, পৃথিবীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রিত। তাঁর প্রদত্ত হেদায়াত থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই এভাবে মাঝেমাঝে আল্লাহতায়ালা মানবসৃষ্ট আযাব–গজব দিয়ে থাকেন। এই পৃথিবীর অবাধ্য মানুষগুলো আল্লাহর বিধান কিংবা মহাগ্রন্থ আল্ কোরআনের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে এই আপদগুলো সংঘটিত হয়। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে বলছেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে–স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, আল্লাহতায়ালা তাঁদের কিছু কাজকর্মের জন্য তাদেরকে শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাতে চান, আশা করা যায় তারা ফিরে আসবে’– সূরা আর রোম– ৪১। এরপরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘তুমিই বল, তোমরা জমিনে ভ্রমণ কর এবং যারা আগে ছিল, (আল্লাহতায়ালাকে অস্বীকার করায়) তাদের কি পরিণতি হয়েছে তা অবলোকন কর; তাদের অধিকাংশ লোকই ছিল মোশরেক’। সূরা আশ্ শূরার ৩০ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, ‘যে বিপদ আপদই তোমাদের উপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের অর্জন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের অনেক (অপরাধ এমনিই) ক্ষমা করে দেন’। অতএব বুঝা যায়–ভূমিধস, ভূমিকম্পের মতন বিপদগুলো আমাদের হাতের অর্জন। এগুলো আসার আগেই আমাদের ঈমানকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আল্লাহর বিধানকে, আল্লাহর কোরআনকে নিজের বুকে ধারণ করা চাই। প্রাত্যহিক জীবনে এর প্রতিষ্ঠা চাই। নচেৎ এভাবেই তুরস্কের মতন ভয়াবহ ভূমিকম্পের কবলে আমাদের বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় এই আযাব আসতে বাধ্য। আল্লাহর দ্বীনকে নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রেও প্রতিষ্ঠা করা চাই।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল