জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

ইমাম আযম আবু হানিফা (.) একটি আদর্শ জীবন

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, সর্বোত্তম আদর্শের অনুকরণীয় মডেল নবী মোস্তফার জীবনাদর্শ অনুসরণ করুন, নবীজির আনীত পবিত্র ধর্ম আল ইসলামের বিধান বাস্তবায়নকারী মুজতাহিদ ইমামগনের অনুসৃত নীতি আদর্শ গ্রহণ করুন, মেনে চলুন, তাঁদের রেখে যাওয়া ইলমের আমানতকে সংরক্ষণ করুন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা নিবেদন করুন, ইসলামের জন্য তাঁদের মহান ত্যাগ ও অবদানকে স্বীকার করুন। তাঁদের অনুসৃত ও প্রদর্শিত পথই একমাত্র সিরাতুল মুস্তাকিমের সঠিক পথে নিজকে পরিচালিত করুন। নবীজির ইলমের উত্তরাধিকার মুজতাহিদ ফকীহ ও মযহাবের ইমাম চতুষ্ঠয়ের নির্দেশনা কে অমান্য করা, বিরোধীতা করা, প্রকৃত পক্ষে নবীজির নির্দেশ অমান্য করার নামান্তর।

কুরআনের আলোকে মাযহাবের ইমামগণের আনুগত্য করা ওয়াজিব : আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ, নির্দেশ মান্য করো, আল্লাহর এবং নির্দেশ মান্য করো রাসূলের আর তাদেরই যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। (সূরা: নিসা, আয়াত: ৫৯)

উল্লিখিত আয়াতে “উলীল আমরে মিনকুম” দ্বারা মাযহাবের মুজতাহিদ ইমামগণের আনুগত্য ও অনুসরণ অপরিহার্য করা হয়েছে। (তাফসীর নূরুল ইরফান, পৃ: ২২৮)

ধর্মীয় অজানা বিষয়ে, অস্পষ্ট বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ও ধারণা অর্জন করার জন্য মাযহাবের ইমামগণের শরনাপন্ন হওয়া, তাঁদের প্রদত্ত নিদের্শনা মেনে চলা অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “জ্ঞানবানদের কে জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমাদের জ্ঞান না তাকে। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত:-০৭) এ আয়াত দ্বারা মাযহাব অনুসরণ ওয়াজিব করা হয়েছে।

ইমাম আযম আবু হানিফা (.) সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ভবিষ্যবাণী : হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, “দ্বীন যদি উর্ধ্বাকাশের সুরাইয়া নক্ষত্রের নিকটেও হয় তবুও পারস্যের এক বা একাধিক ব্যক্তি তা আহরণ করবেই।” (মুসলিম শরীফ, খন্ড:, পৃ: ৭২৭)

প্রখ্যাত তাফসীর ও হাদীস বিশারদ আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী (.) (মৃ: ৮৪৯৯১১ হি) ও আল্লামা ইবন হাজর মক্কী (.) (মৃ: ৯০৯৯৭৪ হি.)’র বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্ত হাদীস দ্বারা ইমাম আযম আবু হানিফা (.)’র দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, মুজতাহিদ ফকীহ ও হাদীস বিশারদদের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (.) ছাড়া অন্য কেউ পারস্য বংশোদ্ভূত ছিলেন না।

কুরআন হাদীসের আলোকে শরয়ী বিষয়ে হাজার হাজার জটিল কঠিন মাসআলার সমাধান ও জটিলতা নিরসনে চার মাযহাবের ইমামগন ছিলেন প্রজ্ঞা পান্ডিত্য ও পূর্ণরূপে পারদর্শী। আর ইমাম আবু হানিফা (.) ছিলেন, জ্ঞান গভীরতায়, প্রজ্ঞায় সকলের শীর্ষে, সবচেয়ে অগ্রগামী। তিনি ছিলেন ইসলামী আকাশে উদিত এক সমুজ্জ্বল নক্ষত্র আলোকবর্তিকা। তাঁর আদর্শ জীবন ও কর্মের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন ঘটেছে।

জন্ম ও বংশ পরিচয় : ইমাম আযম (.)’র জন্ম ৮০ হিজরিতে কুফায়। নাম: নুমান, উপনাম আবু হানিফা, উপাধি ইমাম আযম। পিতার নাম: সাবিত, দাদার নাম যওতী, কারো কারো বর্ণনামতে তাঁর দাদার নামও ছিল নুমান, দাদা অগ্নি উপাসক ছিলেন ৩৬ হিজরিতে ইসলামে দীক্ষিত হন, দাদা যওতী স্ত্রীকে নিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হন, সেখান থেকে কুফায় পৌছে হযরত মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সান্নিধ্য অর্জন করেন, তিনি কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ৪০ হিজরিতে যওতীর এক পুত্র সন্তান জন্ম হয়। তাঁর নাম রাখা হলো সাবিত। নবজাত শিশুকে নিয়ে দুআ ও বরকতের জন্য মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দুআ করলেন, সাবিত এর শিশু অবস্থায় পিতা ইন্তিকাল করেন, মায়ের স্নেহে লালিত পালিত হন। “তাঁর ৪০ বছর বয়সে পরিবারে এক নূরানী সন্তান জন্ম লাভ করেন। পিতা মাতা স্নেহ করে নাম রাখেন নুমান, তিনি হলেন মুসলিম জাহানের মহান ইমাম, মাযহাবের প্রবর্তক, বিশ্বখ্যাত মুজতাহিদ ফকীহ, যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাসসির। ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি)(তারিখে বাগদাদ, খন্ড: ১৩, পৃ: ৩২৭, আল খায়রাতুল হিসান, পৃ: ৩০, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ৩য়, পৃ: ৪৫৫)

মাযহাবের ইমামগনের মধ্যে একমাত্র ইমাম আবু হানিফা (.) তাবেয়ী ছিলেন : হাদীস বিশারদ ও বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী (.) তাবেয়ী’র নিম্নোক্ত সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন, “তাবেয়ী বলা হয়, যিনি সাহাবার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।” (নুখবাতুল ফিকর, পৃ: ৭২৪)

আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী (.) বর্ণনা করেন, আটজন সাহাবার সাথে ইমাম আযম সাক্ষাৎ করেছেন, বিশেষত: হযরত আনাস ইবন মালিক (রা.), হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা.) হযরত মাকাল ইবন ইয়াসার (রা.) হযরত ওয়াসিলা ইবন আসকা (রা.) প্রমূখ। (তারিখে বাগদাদ, আল খায়রাতুল হিসান, পৃ:৮০)

ইমাম আযম (.)’র ইবাদত ও তাকওয়া : হযরত আবু বকর খতীবে বাগদাদী হযরত ইবনে কসীর, কুতবুল আকতাব হযরত ইমাম শা’রানী (.) প্রমূখ বর্ণনা করেন, ইমাম আযম আবু হানিফা (.) চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত এশার অযু দিয়ে ফজর নামায আদায় করেছেন। যে স্থানে তিনি ইন্তিকাল করেছেন, সে স্থানে সাতহাজার বার কুরআন মজীদ খতম সম্পন্ন হয়েছে। (তারিখে বাগদাদ, খন্ড: , পৃ: ৪৫৭)

হযরত আবু মুতী (.) বর্ণনা করেন, একাধারে ছয় বৎসর তিনি কাবা শরীফের হেরমে ছিলেন। যখনই আমি হেরম শরীফে প্রবেশ করেছি ইমাম আযম আবু হানিফা (.)কে খানায়ে কাবার তাওয়াফরত অবস্থায় পেয়েছি।

আওলাদে রাসূল ইমাম জাফর সাদিক (রা.)’র সান্নিধ্যে দু’বৎসর : আল্লামা আবদুল মুস্তফা আযমী (.) বর্ণনা করেছেন, হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (.)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে হযরত! আপনার বয়স কত? তিনি জবাব দিলেন দু’বৎসর। প্রশ্নকারী জবাব শুনে বিস্ময়ে হতবাক। ইমাম আযম তাৎপর্যমণ্ডিত কথার রহস্য বললেন, এমনিতো আমার বয়স এ পর্যায়ে ষাটের অধিক, কিন্তু আমি আমার দীর্ঘ জীবনের কেবল দু’বৎসরের জীবনকে প্রকৃতপক্ষে মূল্যবান মনে করি যে দু’বৎসর আমি আওলাদে রাসূল আমার পীর মুর্শীদ হযরত ইমাম জাফর সাদিক (.)’র সংস্পর্শ ও সান্নিধ্যে অতিবাহিত করেছি। এ পুণ্যাত্মার সান্নিধ্যের বদৌলতে এ দু’বৎসরের একটি মূহুর্তও আমি আল্লাহ ও তদীয় রসূলের স্মরণ থেকে বিমূখ হইনি। এ দু’বৎসর কে জীবনের অবশিষ্ট সময়ের সমকক্ষ মনে করিনা। তিনি বলেন, আমার জীবনের এ দু’বৎসর যদি না হতো, আমি নুমান ধ্বংশ হয়ে যেতাম। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:, পৃ: ৪৬৪)

ক্রয় বিক্রয়ে আমানতদারিতা : একদিন এক মহিলা রেশমী কাপড় বিক্রির জন্য আনলেন, ইমাম আযম দাম জিজ্ঞেস করলেন মহিলা বললো এক’শ দিরহাম। ইমাম আযম বললেন দাম অনেক কম বলেছো, মহিলা দাম বাড়াতে বাড়াতে চারশ দিরহাম পর্যন্ত বৃদ্ধি করলো, মহিলা বললেন, আপনি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন, ইমাম আযম যাচাই করার জন্য অন্য কাউকে হাজির করার কথা বললেন, মহিলাটি এক লোক কে উপস্থিত করলো, তখন ইমাম আযম নিজেই পাঁচশ দিরহাম কাপড়ের প্রকৃত মূল্য দিয়ে ক্রয় করে নিলেন, এ ছিলো ক্রয়বিক্রয় লেনদেনে ইমামের খোদাভীতি ও আমানত দারিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্ঠান্ত। (আল খায়রাতুল হিসান, পৃ: ৮২)

দানশীলতা : ইমাম আযম আবু হানিফা (.) সৎ ও হালাল জীবিকা অর্জনের জন্য নবীজির সুন্নাত হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। একবার ইমাম আযম আবু হানিফা (.) হাফস ইবন আবদুর রহমান নামক এক ব্যক্তিকে বিক্রি করার জন্য থানের কাপড় দিয়ে বাজারে পাঠালেন এবং এটাও বলে দিলেন, থানের কাপড়ের মধ্যে কিছু দোষ আছে বিক্রয় করার সময় ক্রেতার নিকট তা যেন প্রকাশ করা হয়। আবদুর রহমান বিক্রয় করার সময় ক্রটির কথা বলে দিতে বেমালুম ভূলে গেলেন, ক্রেতাও তাঁর নিকট পরিচিত ছিলনা, ইমাম আযম এ কথা জানতে পেরে অত্যন্ত দু:খ পেলেন। হিসেব করে দেখলেন সেদিন ত্রিশ হাজার দিরহামের ব্যবসা হয়েছিল তিনি বিলম্ব না করে পুরো ত্রিশ হাজার দিরহাম অভাবী ফকির দরিদ্র লোকদের মাঝে সবটুকু দান করে দিলেন। দুনিয়া বিমূখ নির্লোভ ও ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন ইমাম আযম (.)(আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: , পৃ: ৪৬৪), ইসলামী জগতের এ মহান ইমাম প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে ২ শাবান ১৫০ হিজরিতে ৭০ বৎসর বয়সে সিজদারত অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। বাগদাদ নগরীর খিযরান নামক কবরস্থানে রওজা শরীফে তিনি জান্নাতবাসী হয়েছেন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্প : আল্লাহর পক্ষ থেকে কড়া বার্তা
পরবর্তী নিবন্ধজামাল নজরুল ইসলাম : একজন মানবিক ও দেশপ্রেমিক মানুষ