জামাল নজরুল ইসলাম : একজন মানবিক ও দেশপ্রেমিক মানুষ

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | শুক্রবার , ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

আমার কেন জানি মনে হয়, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা বুঝতে শিখি এ দেশ আমাদের বসবাসের অযোগ্য। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ এদেশে অন্ধকার। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য, সুযোগ পেলে বিদেশে চলে যাওয়া। আমি প্রায় অনেক শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যে এ দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু আবার স্রোতের বিপরীতে অনেক মানুষকেও দেখেছি যারা বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসছে ও এসেছিল দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য কিছু করবে বলে। অনেকে আবার বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে এসে, হতাশ হয়ে ফিরেও যান। কারণ আমরা জানি প্রত্যাশার মাত্রার সাথে হতাশার একটা দারুণ সংযোগ আছে। আবার কিছু কিছু মানুষ আছে তারা যথেষ্ট আশাবাদী। তাঁরা হতাশ হলেও দেশের বিদ্যমান অসহিষ্ণু পরিবেশ, অনিয়ম, প্রচলিত সিস্টেমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দেশের ভালো করার চেষ্টা চালিয়ে যান। উনাদের মধ্যে একজন হলেন, প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম। আমরা সবাই জামাল স্যারনামেই যাঁকে চিনি।

আমাদের সবারই জানা স্যার কেন বিদেশের অনেক টাকার চাকরি ছেড়ে, চাকচিক্যময় জীবনের মোহ ত্যাগ করে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। স্যারের এক সাক্ষাৎকারে স্যার সেটা নিজেই জানিয়েছিলেন। উনার মতে – ‘আমি কখনোই স্থায়ীভাবে বিদেশে থেকে যাওয়ার চিন্তা করতাম না। দেশে ফিরে আসার চিন্তাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল, এর ভিন্নতা ঘটেনি কখনোই। আরেকটা দিক হলো বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থা সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব ছিল না।’ স্যার যখন কেমব্রিজ ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগ দেন তখন একটি হইচই পড়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৮৪ সালে একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেমব্রিজের অনেক উচ্চ বেতনের অধ্যাপনার চাকরিটি ছেড়ে বাংলাদেশের চবির সামান্য বেতনে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিতে আসলেন কেন? এর উত্তরে মৃদু চিরায়িত হাসি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বাড়ি চিটাগং, এ জন্য এখানে জয়েন করি। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, আমি এখান থেকে নিতে আসিনি, আমি দিতে এসেছি’।

বিজ্ঞানচিন্তা নামক একটি পত্রিকায় জামাল স্যারের দুই মেয়ের এক সাক্ষাৎকারে জেনেছিলাম, বিদেশে থাকতেও স্যার দেশ নিয়ে প্রচণ্ড চিন্তা করতেন এবং দেশের জন্য কিছু করতে পারাকে গৌরবের মনে করতেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসার পরেও দেশের বিভিন্ন অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, ক্ষমতাবানের দৌরাত্ম্য, চরমপন্থা দেখে খুবই মর্মাহত হতেন। এবং মেয়েদের সাথে আলোচনায় তিনি বলতেন এগুলোর পরিবর্তন দরকার। আমরা দেখতে পাই পরবর্তীতে তিনি বেশ কিছু কলামও লিখেছেন পত্রিকায়, যেগুলোতে সমাজের বিভিন্ন অসংগতি, অনিয়ম, ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। তিনি যে বাংলাদেশে বসে শুধু বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করতেন তাই না, বরং পুরো বিশ্বে কেমনে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে সেটা নিয়েও চিন্তা করতেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের যুদ্ধ নিয়ে স্যার খুব বিচলিত থাকতেন। পাশ্চাত্য যখন ইরাকে আক্রমণ চালায়, এবং হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে তখন জামাল স্যার পশ্চিমা সভ্যতার ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন ও এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন।

দৈনিক আজাদীতে স্যারের একটি সাক্ষাৎকার একবার দেখছিলাম ইউটিউবে। দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সার্সন রোডের পাহাড়ের স্যারের বাসায় সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। তিনি আজাদী পত্রিকার প্রতি শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি সাংবাদিকদের জন্য এক ধরনের উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। স্যারের মতেসাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক তথ্যনির্ভর সংবাদ নির্ভয়ে প্রকাশ করা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে সেটা একটু সমস্যা হচ্ছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের হেনস্থার শিকার হতে হয়। এটা আমাকে বিচলিত করে, এবং এটা বন্ধ হওয়া দরকার। সাংবাদিকরা যদি প্রকৃত চিত্রটা তুলে না ধরে, আমরা বুঝবো কী করে দেশে হচ্ছেটা কী, দেশ কোন পথে আছে!

আমাদের জামাল স্যার ছিলেন সহজসরল এবং মানুষকে খুব সহজেই বিশ্বাস করতেন। অসহায় ও দরিদ্রদের তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। এমনও অনেক কথা শুনেছি, বেতন যেদিন তুলতেন সেদিনই তা প্রায় শেষ হয়ে যেত। স্যারের অধীনে ডিগ্রি নিয়েছেন এমন একজন ছাত্রের লেখায় জানলাম, ২০০২ সালের দিকে প্রতি মাসের ১ বা ২ তারিখে কিছু বিহারী লোক স্যারের বাসায় চলে আসতেন। স্যার বেতন পাওয়ার পর প্রতিমাসের একটা অংশ তাদেরকে দিয়ে দিতেন। আরেকবার স্যার ফটিকছড়িতে একটা ইফতার পার্টিতে গিয়ে ছিলেন। নামাজ আদায় করে সালাম ফিরানোর সময় দেখছেন এক লোক স্যারের জুতাগুলো নিয়ে যাচ্ছেন। গাড়িতে উঠার সময় ড্রাইভার জুতোর কথা জিজ্ঞেস করতে স্যার বললেন, আমি দেখেছি এক লোক জুতোগুলো নিয়ে যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই লোকটি গরীব তাই কিছু বলিনি। ওকে আমি পেলে আরো একজোড়া জুতা কিনে দেবো এবং প্রতিমাসে সাহায্য করবো।

এই সহজ সরল, বিশ্বাসপ্রবণ ও মানবতাবাদী মানুষটি একসময় সমাজের নানা সামাজিক সংগঠন ও ভালো উদ্যোগের সাথে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করে ফেলেন। উনার কাছে কেউ গেলে কাউকেই না করতেন না। অনেক স্বার্থপর ও স্বার্থান্বেষী মহল উনাকে ব্যবহার ও বিতর্কিতও করেছেন নিজেদের স্বার্থে। তাঁর অত্যন্ত মূল্যবান সময়ের অনেকখানিই সামাজিক সংগঠনগুলোর জন্য ব্যয়িত হয়েছে। উনার উদ্দেশ্য ছিল সৎ। অন্তত মানুষের মধ্যে পজেটিভ পরিবর্তন আসুক। সামাজিকতার পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও তাঁকে ভাবাতো। শিক্ষিত মানুষের মধ্যে লোভ আর স্বার্থপরতা, রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দেখলে তিনি নিজে নিজে খুব মনঃকষ্টে ভুগতেন।

প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যার যে কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন এবং তার ব্যাপ্তি যে কত বড় ছিল তা সহজে প্রকাশ করতেন না। এর জন্য কোনো অহংকারও কোনোদিন করতেন না। প্রচারবিমুখ এ মানুষটি এক সাক্ষাতকারে নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘১৯৫৭ সালে আমি কলকাতা থেকে অনার্স শেষ করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে গণিতশাস্ত্র ট্রাইপাস করতে যাই। সাধারণত এটা ৩ বছরের কোর্স। তবে আমি দুই বছরেই শেষ করে ফেলি। ওখানে আমার সহপাঠী ছিলেন পরবর্তীতে ভারতের বিখ্যাত গণিতবিদ নারলিকার। আরেকজন ছিলেন ব্রায়ান জোসেফসন, যে তাঁর পিএইচডি থিসিসের জন্য মাত্র ৩৩ বছর বয়সে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পায়। আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন জেমস মার্লি যিনি ১৯৬৬ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান। ১৯৯৮ সালে রসায়নে নোবেল পান আমার শিক্ষক জন পোপল। আমি এগুলো বলছি, সেসময় আমাদের লেখাপড়ার পরিমণ্ডল কত বিশাল ছিল তা বোঝানোর জন্য। আমার পিএইচডি থিসিস ছিল পার্টিকেল ফিজিক্সের উপর। এর ৩/৪ বছর পর আমি আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে কাজ শুরু করি। পরবর্তীকালে এর সাথে যুক্ত হয় কসমোলজি। বলতে পারেন এই তিনটিই হচ্ছে আমার আগ্রহ ও কাজের মূল ক্ষেত্র’। এতেই বোঝা যায় তিনি বিশ্বের তখনকার দিনের বড় বড় বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করেছেন। কিন্তু এজন্য উনার মধ্যে কোনো অহংকার কাজ করত না, ছিল না কোনো উচ্চাবিলাসী চিন্তা। শুনেছি স্যারকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। স্যার প্রতিবারই বলেছিলেন, ‘আমার চা’য়ের কাপ রিসার্চ সেন্টারে, প্রশাসনিক অফিসে নয়’।

আমাদের জামাল স্যার যথেষ্ট ধার্মিক ও মানবিক ছিলেন। স্যারকে নিয়ে স্মৃতিচারণে কেউ একজন বলেছিলেন, স্যারের একটা কালো লেদারের ব্যাগ ছিল। সেটা ইঁদুর কেটে ফেলছে। স্যারকে তাঁর পিয়ন এটা জিজ্ঞেস করাতে স্যার বললেন, ইঁদুর কেটে ফেলেছে কারণ ওই ব্যাগের ভিতর একটা বিস্কুটের প্যাকেট ছিল। আমি ভুলে বের করি নাই। আজ থেকে টেবিলের উপর ইঁদুরের জন্য বিস্কুট রাখবো। আবার স্যারকে নিয়ে কোনো এক লেখায় পড়েছিলাম, ক্যামব্রিজে থাকাকালীন সময়ে ইংরেজি না জানায় প্রসব বেদনায় কাতর এক বাঙালি মহিলাকে সাহায্য করতে পারছিলেন না ডাক্তারেরা। তখন জামাল স্যারের সাহায্য চায় ডাক্তার। পরে গিয়ে দেখেন সিজারের মাধ্যমে ফুটফুটে একটা ছেলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। স্যার হাঁটুগেড়ে বসে সেই নবজাতকের কানে আযান দেন এবং বলেছিলেন মুসলিম পরিবারের পুত্র সন্তান জন্ম নিলে তার কানে আযান দেওয়া কর্তব্য। স্যারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। বর্তমান প্রজন্মের প্রতি প্রত্যাশা, এই মহান বিজ্ঞানীর দেশপ্রেম ও মানবতাবোধ সবাই জানুক, নিজেরা দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ হোক। এগিয়ে যাক আমার দেশ।

লেখক: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও

প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন