তরুণ প্রজন্মের আত্মহত্যার প্রবণতা ও প্রাসঙ্গিক কথা

বিচিত্রা সেন | সোমবার , ৪ জুলাই, ২০২২ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

‘অর্পি নতুনের শিরে মুকুট রতন
চলে যায় দ্বিধাহীন চির পুরাতন’।
কবিগুরু ঠিকই বলেছিলেন। বিশ্বসংসারের নিয়মই এমন। নবীনের কাঁধে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে পুরাতন নীরবে সরে দাঁড়ায়। কবিগুরু আরও বলেছিলেন, ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। অর্থাৎ নবীন প্রজন্ম যেন প্রাচীন অর্ধমৃতদের আঘাত করে তাঁদের চিরমুক্তি দিয়ে নিজেদের পথ সুগম করে নেয়। চিরকাল নবীনরাই বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছে। বিদ্রোহী কবির ভাষায় ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবৈশেখীর ঝড়’। যুগ থেকে যুগে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নবীনরাই দেশ ও জাতির ভার নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। তারাই সৃষ্টি করেছে নব নব ইতিহাস। নবীন মানেই প্রাণের হুল্লোড়। কিন্তু সেই নবীন যদি তার প্রাণস্পন্দন হারিয়ে ফেলে, তখন তার জীবনে নেমে আসে চরম হতাশা। সেই হতাশা তাকে তিলে তিলে জীবন বিমুখ করে তোলে। তারপর একদিন সবার অগোচরে সে জীবন থেকে পালায়। বেছে নেয় আত্মহননের পথ। মা বাবার সমস্ত স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে, বন্ধু বান্ধবের সমস্ত মায়াকে পাশ কাটিয়ে কী করে পারে সে এমন করে নিজেকে শেষ করে দিতে? এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র আত্মহননকারীরই জানা। আমরা শুধু ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সম্ভাব্য কিছু কারণই খুঁজে মরি।
কথাগুলো বললাম এজন্যই যে, ইদানীং কালে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। যে তারুণ্য তিল তিল করে জীবনকে উপভোগ করার কথা, যে তারুণ্য গানে, গল্পে, কবিতায় কিংবা অন্য কোনো সৃজনশীলতায় নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা সে তারুণ্য কেন এভাবে জীবন ছেড়ে পালাচ্ছে? এ প্রসঙ্গে আমার খুব কাছ থেকে দেখা কয়েকটি আত্মহত্যার কেস স্টাডি তুলে ধরছি। কেস স্টাডি ১.দীপু মা বাবার একমাত্র সন্তান। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা চাকরিতে ঢুকেছে। মা বাবা খুশিতে আত্মহারা। একমাত্র ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছে। এবার মনের মতো একটা মেয়ে খুঁজে ছেলেকে বিয়ে করাতে হবে। সেই চেষ্টাই করছেন তাঁরা। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দীপুর মা দেখলেন ছেলে তার ফ্যানের সাথে ঝুলছে। নিজ হাতে দড়ি কেটে ছেলের লাশ নামালেন তিনি। তন্ন তন্ন করে সারা ঘর খোঁজা হলো কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া যায় কিনা। কিছুই পাওয়া গেলো না। ফোনেও কিছুর হদিশ পাওয়া গেলো না। পরে বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারলেন প্রেমে ব্যর্থতা এ মৃত্যুর কারণ। কেস স্টাডি ২. নিহাল ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সহপাঠিনী রুনার সাথে তার গভীর বন্ধুত্ব। দুজনের স্বপ্ন বোনার শেষ নেই। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার দুই/তিনমাস আগে থেকে পাল্টে যেতে থাকে রুনা। একপর্যায়ে নিহালকে সে জানিয়ে দেয় সম্পর্ক রাখতে তার অপারগতার কথা। অনেক কাকুতিমিনতি করেও নিহাল রুনাকে ফেরাতে পারে না। অভিমানী নিহাল কারো সাথে কিছু শেয়ার না করেই আত্মহননকেই শেষ আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়। কেস স্টাডি ৩. মা বাবার অনেক আদরের মেয়ে নিশি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ভালোবাসে নবীন এক সরকারি কর্মকর্তাকে। মা বাবা বিষয়টি জানতে পেরে ওই পাত্রের সাথেই বিয়ে দেবার উদ্যোগ নেয়। তখনই ঘটে বিপত্তি। জানা যায় ছেলেটি আসলে ভুয়া পরিচয় দিয়েছে। সে বাস্তবে বেকার। সরকারি চাকরি দূরে থাক, সে আসলে কোনোকিছুই করে না। প্রাণের মানুষের এই প্রতারণা মেনে নিতে পারে না নিশি। মা বাবাকে এ মুখ দেখানোর চেয়ে আত্মহত্যাকেই শ্রেয় মনে করে সে। কেস স্টাডি ৪. ইমরান খুব মেধাবী ছেলে। ছোটবেলা থেকে মা-বাবা তার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে যে কোনোভাবেই তাকে ডাক্তার হতে হবে। জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি সব পরীক্ষায় সে সব বিষয়ে এ+ পেয়ে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। অথচ এত পড়াশোনা করেও শেষপর্যন্ত সে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেলো না। তীব্র হতাশায় জীবন থেকে পালাতে গিয়ে সে আত্মহত্যার পথই বেছে নিলো।
এখানে আমি খুব কাছ থেকে দেখা মাত্র চারটি ঘটনা তুলে ধরলাম। আরও অনেক কেস স্টাডি আমার জানা। বেশির ভাগ আত্মহত্যার নেপথ্য কারণ প্রেমে ব্যর্থতা। কখনো কখনো মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর ওপর অভিমান করেও কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আবার কেউ বা স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়েও জীবন থেকে পালায়। তবে যে কারণেই হোক না কেন আত্মহত্যার নেপথ্যে তীব্র আবেগ কাজ করে। মানুষ যখন আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, আবেগই যখন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন মানুষ আত্মহত্যার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আর তরুণ প্রজন্ম আবেগের কাছে ধরাশায়ী হয় বলেই তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আমাদের নবীন প্রজন্মকে বলা হয় ‘হেডডাউন জেনারেশন’। কারণ তাদের মাথা সারাক্ষণই ঝুঁকে আছে মোবাইল স্ক্রিনের ওপর। এ কাজটিতে তারা সাময়িক আনন্দ পেলেও বস্তুত তারা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে চারপাশের জগৎ থেকে। তারা চাঁদ দেখে না, ফুল দেখে না, পাখি দেখে না, নদী দেখে না। তারা সারাক্ষণ একটা যন্ত্রতেই নিমগ্ন। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, বর্তমান প্রজন্ম মনে হয় ভালো করে মা-বাবার মুখও দেখে না। যন্ত্রের মাধ্যমে সবকিছু শেয়ার করতে করতে তারা মানুষের কাছে কোনোকিছু শেয়ার করতে অস্বস্তি বোধ করে। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে তারা জানে না কিংবা পারে না। কোনো এক বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে নিজের অপ্রাপ্তিকে ঝেড়ে ফেলতে তারা পারে না। ছোট্ট জীবনে অসীম চাপ নিতে গিয়ে তারা জীবনের প্রতিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এজন্য তাদের চাওয়া পাওয়ার মাঝে বিন্দুমাত্র হেরফের হলেই তারা নিজেরাই নিজেদেরকে শেষ করে দেয়। কিন্তু কেন তাদের এত জীবন বিমুখতা?
আসলে গত দুই তিন দশক ধরে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ফলে আমাদের বেশির ভাগ দম্পতির একটা বা দুটো সন্তান। আমাদের প্রজন্ম কিংবা তার আগের প্রজন্ম যেভাবে ভাগাভাগি করে শৈশব কৈশোর পার করেছে, সেই ভাগাভাগির দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় আগের চেয়ে বেড়েছে। তারই প্রভাব পড়েছে পরিবারগুলোতে। তুলনামূলক স্বচ্ছলতায় বড় হওয়া এ তরুণ প্রজন্ম ভাগাভাগি বা শেয়ারিং জানে না। ছোটবেলা থেকেই মা বাবা তাদের অভাবটা বুঝতে দেয় না। এজন্য হয়তো অনেকসময় মা বাবা নিজেরাই অনেকটা স্যাক্রিফাইস করেন। কিন্তু সেই সন্তানরাই বড় হয়ে যখন তাদের মতো জীবন পায় না, তখন মা বাবার কথা একবারও না ভেবে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। একবারও ভাবে না মা বাবার প্রতি তাদের দায়িত্ববোধের কথা। তাই ছোটবেলা থেকে সন্তানদের মনে মা বাবার প্রতি, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ শেখানো উচিত। আমাদের মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারে যে সামান্যতম আঘাতে সন্তানরা আত্মহত্যা করে, তার চেয়ে অনেক কঠিনতম আঘাত সয়েও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জীবনের ঘানি টানে। কারণ ছোটবেলা থেকে তারা জীবনের কঠিন রূপই দেখেছে। তাই আমাদের মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোরও উচিত সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই জীবন যে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির ক্ষেত্রফল তা বুঝিয়ে দেওয়া। তাহলে তারা বুঝবে জীবনে প্রাপ্তির সাথে সাথে অপ্রাপ্তিও আসতে পারে। সেটাকে মেনে নেওয়ার নামই মানবজীবন। তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলছি, স্বার্থপরের মতো শুধু নিজে ভালো থাকতে চাইলেই চলবে না, মা বাবা, আত্মীয়স্বজনকে ভালো রাখাটাও তোমাদের দায়িত্ব। যে জীবনটাকে তোমাদের নিজের মনে করে আত্মহননের পথে পা বাড়াচ্ছো, সে জীবনটা তোমাদের একার নয়। এ জীবনটা মা বাবার মাধ্যমে স্রষ্টা তোমাদের দান করেছে। তাই এ জীবনটা শেষ করে দেওয়ার আগে একবার মা বাবার কথা ভাবো। ভাবো, তাদের প্রতি তোমাদের দায়িত্ববোধের কথা। অনেক স্বপ্ন নিয়ে তারা তোমাদের বড় করেছেন। তাঁদের স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটিও না। জীবন তো একটাই। সে জীবনটাকে উপভোগ করো। মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দাও। দেখবে, জীবন অনেক সুন্দর। শুরু করেছিলাম কবিগুরুর আশ্রয় নিয়ে। শেষও করছি কবিগুরুকে শিরোধার্য করে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেন আত্মশক্তিকে জাগ্রত করতে এই শপথ নেয়-
‘সহায মোর না যদি জুটে/ নিজের বল না যেন টুটে,. সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি/ লভিলে শুধু বঞ্চনা/ নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়’।
আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বেঁচে থাকুক আমাদের সন্তানেরা। আর যেন কোনো বাবা মাকে সন্তানের আত্মহননের তীব্র কষ্ট বয়ে বেড়াতে না হয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ-চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাকরি নিয়ে হালকা চিন্তা
পরবর্তী নিবন্ধস্বপ্নসেতু পদ্মা