চাকরি নিয়ে হালকা চিন্তা

মো. ছাকী হোসেন | সোমবার , ৪ জুলাই, ২০২২ at ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

চাকরি জীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। মা-বাবার সংসারে অতি আদরে বড় হতে হতে শিশু, প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, হাইয়ার সেকেন্ডারি, বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডি পেরিয়ে চাকরি করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা পেয়ে বসে মনের মনি কোটায়। কেউ কেউ চিন্তা করে সংসারের হাল ধরতে হবে, কেউ বা চিন্তা করে লিখা পড়া যখন করেছি, অন্য চিন্তা না করে একটা চাকরি নেয়াই মঙ্গলজনক।
প্রকৌশলী বা ডাক্তারদের লাইন ভিন্ন হলেও মধ্যম লাইনে অথবা নন-টেকনিক্যাল লাইনে যারা পড়েন তাদেরই চিন্তা-চেতনা ভিন্ন। কোন দিকে যাবো। সরকারি চাকরি, কর্পোরেট চাকরি, স্বনামধন্য বহুজাতিক কোম্পানি, দেশীয় বিখ্যাত কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি। এ সকল নানান চিন্তা মস্তিষ্কে ঘুরাফেরা করে। কিন্তু চাইলেই তো হবে না। ৩০-৩৫ বছর পূর্বে চাকরির বাজারে যে গুনাগুণ সম্বলিত চাকরি প্রার্থীর দরকার ছিল আজ তা নেই। এইতো ২০০০ সালের গোড়ার দিকে অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানি বা দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রার্থী হিসাবে এম,বি,এ, পাশ ছেলে/মেয়েকে বেছে নিত। এ অবস্থা দেখে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে বি.এ; এম.এ; বি.কম; এম.কম; বি.এসসি; এম.এসসি; কোর্সের সাথে এম.বি.এ, কোর্স চালু করে দিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না থাকলেও আমাদের দেশে শিক্ষানুরাগী ব্যবসায়ীরা আরও প্রখর চিন্তা করে নতুন ভাবে জেনে নিলেন-এখন এম.বি.এ. কোর্সের যুগ। সময় কম। যত তাড়াতাড়ি এম.বি.এ. তৈরি করা যাবে তত নিজের ব্যবসার জন্য তো ভালোই, সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাবে সহজেই। তাই চিন্তার পরত বা পর্যায় সম্প্রসারিত করে শুধু বাংলাদেশে চালু করলেন সর্টেন এম.বি.এ, এসসেলারেটেড এম.বি.এ; এক্সিকিউটিভ এম.বি.এ; প্রফেশনাল এম.বি.এ, ইত্যাদি। রেগুলার এম.বি.এ, তো আছেই। ফলশ্রুতিতে দেশের তরুণ ও উচ্চবিলাসী/ উচ্চাকাঙ্ক্ষী চাকরিজীবীরা সুযোগ হাতছাড়া না করে উঠে পড়ে লেগে গেলেন রেগুলার বিহীন এম.বি.এ কোর্সে। ইতিমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় জড়িয়ে পড়ে প্রতিযোগিতায়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এমন হারে গজিয়ে উঠেছে যে কোনো ভবনের একতলা, দোতলা অথবা কয়েক তলার সমন্বয়েই গড়া হলো অমুক বিশ্ববিদ্যালয়, তমুক বিশ্ববিদ্যালয়। সাথে ছাত্র-ছাত্রী পাওয়ার জন্য আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন। পূর্ণবৃত্তি, অর্ধবৃত্তি, আগে আসলে বৃত্তি, জিপিএ ৫ পেলে বৃত্তি, ক্রেডিট ট্রান্সফার, সর্বোপরি বিদেশ যাত্রার সুবিধা। যা হোক বৃত্তি নিয়ে ভেবেছেন এমন ছাত্র-ছাত্রী থাকলেও বিদেশ যাবার সুযোগ ছাড়া যায় না।
যা হোক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক পাবে কোথায়। মানসম্মত শিক্ষক, গ্রহণযোগ্য শিক্ষক, বড় ডিগ্রিওয়ালা শিক্ষক পাওয়াও তৎকালীন সময়ে চাট্টিখানি কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি, শিক্ষার মান, নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করতে হিমশিম খেয়েছে এবং এখনও খাচ্ছে।
ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্মার্ট, আনস্মার্ট, ওভারস্মার্ট অনেক ছেলে-মেয়েকে গ্রাজুয়েট/মাস্টার ডিগ্রি হোল্ডার বানিয়েছেন। একে একে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে চাকরি পেয়েছেন অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে। প্রাচুর্য ভরা যৌবন ছিল এম.বি.এ, পাশদের। চাকরিরত এম.বি.এ, তরুণ-তরুণীরা অগ্রাধিকার পেয়ে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে বেতন বৃদ্ধি, প্রমোশনও পেয়েছেন।
দিন যায়, বি.বি.এ, এম.বি.এ, কোর্সে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীর অভাব নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব নেই, যোগ্য-অযোগ্য শিক্ষকের অভাব নেই, বেতন কমতি নেই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক তাও অভাব নেই। অভাব হলো যে সকল পিতা-মাতা জোর গলায় বলছিলেন ‘আমার ছেলে/মেয়ে এম.বি.এ, পাশ’, তাদের চাকরির বাজার। কারণ এত এম.বি.এ, পাশ যে প্রতি বছর হাজার হাজার এম.বি.এ পাশ কৃতকার্য হয়ে বের হচ্ছে কিন্তু কোথায় চাকরি পাবে। চাকরির বাজার অত্যন্ত সীমিত। দু’দশক আগে যে এম.বি.এ, পাশ ছেলের বেতন প্রথম পর্যায়ে ৩০/৪০ হাজার ছিল, এখন নতুনভাবে ঢুকতে হলে ব্যাংক ছাড়া ২০ হাজার টাকা মাসে। পুষালে যোগদিন নতুবা নয়। কতজন ছেলে/মেয়েই বা ব্যবসা করবে। অথবা করতে পারবে।
সরকারি চাকরিতে সবাই কৃতকার্য হয় না। লিখিত, মৌখিক ছাড়াও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না অন্য বিশ্ববিদ্যালয়। সোনার হরিণ। বর্তমান আধুনিক টেকনোলজীর সুবাধে ল্যাপটপে, মোবাইলে টাইপ করতে গিয়ে হাতে লিখা প্রায় ভুলতেই বসেছে আধুনিক ছেলে পিলেরা। ৩০-৪০ বছর পূর্বে ইংরেজি শিখতে গিয়ে চধরৎ ড়ভ ডড়ৎফং, চযৎধংবং, ওফরড়সং, এৎড়ঁঢ় ঠবৎন ইত্যাদি শিখনে যে ভূমিকা রেখেছে এখন আর তা নেই। যার অভাবে শব্দকোষ/শব্দ ভাণ্ডারে ঘাটতি অনেক।
অন্যদিকে দেখা যায়, বর্তমানে নবযোগদানকারী চাকরিজীবীদের অধিকাংশ কষ্ট করতে রাজী নয়, চেয়ার থেকে উঠে একটু ছুটাছুটি করে কাজ করার মন-মানসিকতার অভাব। আর সে সুবাধেই একটু প্রবীণরা নতুনদের ভিন্ন চোখে দেখে প্রাইভেট সেক্টরের প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিকে সুপারিশ করেন-ফায়ার করতে। খুবই আনন্দিত হওয়ার বিষয় যে, কতিপয় শিক্ষিত তরুণ-তরুণী, গৃহিণী, উদ্যোগী মা-বাবা বর্তমান টেকনোলজীর আশীর্বাদে ঘরে বসে বিভিন্ন খাবার সামগ্রী, পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি বাজারজাত করছেন। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে তা হাজার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সুতরাং মাঝখানে হুচট খেলেও বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষিত তরুণ, তরুণী, মধ্যস্তরের চাকরিজীবীরা জীবন জীবিকাতে ভাল ভূমিকা রাখছেন।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; মানব সম্পদ এগিয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমানে সুশিক্ষিত তরুণ-তরুণী সরকারি পর্যায়ে চাকরি পেয়ে তাদের লব্ধ টেকনোলজীর জ্ঞান কাজে লাগাতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। সরকারি নিয়মনীতির প্যাঁচে পড়ে প্রয়োজনীয় আইটেমও কিনতে পারছেন না। আধুনিক সিস্টেম চালু করতে গিয়ে নিয়ম নীতি ছাড়াও উর্দ্ধতন কর্মকর্তার বা নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার মনোভাবের সাথে এক হওয়া যাচ্ছে না। তাই সরকারি কতিপয় বিভিন্ন দপ্তরে, অধিদপ্তরে, বিভাগে, সংস্থায় মানসম্মত আধুনিক সিস্টেম বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে প্রাইভেট সেক্টর প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা কোম্পানী অনেক দূর এগিয়ে গেছে শুধু কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক মনোভাব বিদ্যমান থাকায়।
লেখক : ডাইরেক্টর (জেনারেল এডমিনিস্ট্রেশন), চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিছু মানুষের ক্ষতি করার প্রবৃত্তিটা প্রবল
পরবর্তী নিবন্ধতরুণ প্রজন্মের আত্মহত্যার প্রবণতা ও প্রাসঙ্গিক কথা