স্বপ্নসেতু পদ্মা

নাসের রহমান | সোমবার , ৪ জুলাই, ২০২২ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

হাজার বছরের বাঙালি। আরো কয়েক হাজার বছর আগে থেকে পদ্মা নদী। দু’পাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে বয়ে চলেছে। এ পদ্মার জনশ্রুতির শেষ নেই। আবেগ অনুভূতির সাথে নানা কাব্যগাথাও পদ্মার ঢেউয়ের মত বহমান। তার চেয়েও বেশি প্রবাহমান পদ্মা পাড়ের মানুষের জীবনের উপখ্যান। কঠিন বাস্তবতার মাঝে বেঁচে থাকার অবিচল সংগ্রাম। জীবন-জীবিকার তাগিদে পদ্মার দু’পাড়ে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। পদ্মাই তাদের জীবিকার সন্ধান দেয়। আজীবন কর্মমুখী করে রাখে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়। পদ্মা নদীতে মাছ ধরে জীবন চালায়। পদ্মা আবার দু’পাশের জমিতে ফসল বোনার স্বপ্ন যোগায়। দিনের পর দিন অজানা অচেনা পথে পাড়ি দিয়ে মানুষ পদ্মার পাড়ে বসতি গড়ে তোলে। সহায় সম্বলহীন মানুষেরাও এসে ভীড় জমায়। অন্য কোথাও কাজ নেই। কাজ না থাকলে খাওয়া নেই। তাই এরা ছুটে আসে পদ্মা তীরে একটা কাজের সন্ধানে। মাছ ধরে অন্তত দু’মুঠো খাওয়া জুটবে। পদ্মা পাড়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইও হবে। সবাই বাঁচতে চায়। বাঁচার জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে। খাল বিল পার হয়ে নদীতেও পাড়ি জমায়। একটা ঠিকানা খুঁজে বেড়ায়। এরকম অনেক মানুষের ঠিকানা হয়ে উঠে পদ্মা।
একসময় নৌকাই ছিল পদ্মা পাড়ের মানুষের একমাত্র বাহন। জীবিকারও বাহন নৌকা। মাছ ধরা ছাড়া আর কোন জীবিকা নেই। ছোট বড় ডিঙি নানা পদের নৌকা আর নানা রকম জাল নিয়ে ছুটে বেড়ায় পদ্মার জলে। কখনো ঢেউয়ের তালে তালে আবার কখনো ঢেউয়ের বিপরীতেও চলতে হয়। এদের জীবনও যেন পদ্মার ঢেউরের মত। কখনো শান্ত ঢেউ খেলানো। দোল খেতে খেতে পদ্মার মাঝে এসে যায়। জালের ভেতর মাছের আনা-গোনা দেখতে পায়। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ আর সারি সারি মাছ কত ধরনের মাছ। জাল ফেলে মাছ তুলে নৌকায় রাখে। কোন দিন সহজে মাছ মিলে যায়, অনেক মাছ পেয়ে পায়। আবার কোন কোন দিন মাছ মিলে না। এখানে ওখানে জলের ওপর নাও ভাসায়। কোথাও না কোথাও মিলে যায়। মাছ নিয়ে ফিরে আসে তখন। এমন দিন আসে পদ্মার ঢেউ উতাল পাতাল করে। বাতাসের বেগ বেড়ে যায়। ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা দোল খেতে থাকে যেন নায়ে পানি ঢুকে যাবে। পানিতে ডুবে যাবে নৌকা। তখন তাল সামলিয়ে সাবধানে নৌকা ভাসিয়ে রাখতে হয়। ঝড় বাদলে উত্তাল তরঙ্গমালায় পদ্মার মাছেরাও উৎসবে মেতে উঠে। পদ্মা আর ঢেউ খেলানো পদ্মা থাকে না, খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা হয়ে উঠে। সবকিছু উপেক্ষা করে নৌকা আর জাল নিয়ে জেলেরাও যোগ দেয় মাছের উৎসবে। কেউ ফিরে আসে, আবার কেউ ফিরে আসে না।
দু’পাড়ের ঘর বাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফসলের মাঠ তলিয়ে যায়। মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু আর থাকে না। পদ্মা ফুলে ফেপে এমন হয়ে যায় যেরূপ আগে কখনো দেখা যায়নি। এত পানি পদ্মার বুকে কোথা থেকে আসে। এত বড় বড় ঢেউ আগে কখনো আসেনি। কোন কিছুই আর ধরে রাখতে পারে না। উত্তাল পদ্মায় সবকিছু ভেসে চলে যায়। ধান, চাল, হাস, মুরগি, গরু, ছাগল, বাড়ি, ঘর সব ভেসে যায়। এমন প্রবল স্রোত মানুষকে ভেসে নিয়ে যায়। মানুষের আশা আঙ্খার পদ্মা জীবন জীবিকার পদ্মা হয়ে যায় সর্বনাশা পদ্মা। করালগ্রাসী পদ্মা। একপাড় ভাঙ্গে আরেক পাড় গড়ে উঠে। এটাই নাকি পদ্মার খেলা। এ সর্বনাশা খেলা আর থামে না। পদ্মার ভাংগা গড়ার খেলায় মানুষ হেরে যায়, মরে যায়। আবার মরে যেতে যেতে বেঁচেও যায়। সবকিছু হারিয়ে পদ্মার পাড়ে জেগে থাকে। পদ্মা যেন আবার আগের রূপে ফিরে আসে। ঢেউ খেলানো মন মাতানো পদ্মা। মানুষ নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে চায়। ভেসে যাওয়া নৌকা আর মাছ ধরার জাল খুঁজে পায়। পদ্মা যেন আবার তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। ভোর বেলায় শান্ত পদ্মায় আবার নৌ ভাসায়। মৃদু মন্দ ঢেউ খেলানো পদ্মা ধীরে ধীরে আলো জলমল হয়ে উঠে। মাঝ পদ্মায় জেলেদের নৌকা, দু’কুল বেয়ে যাত্রীদের পাল তোলা নৌকা, মালবাহী নাও। আর পদ্মা পারাপারের সকল নাও আবার ভাসতে থাকে নদীর বুকে। কত গ্রাম কত জনপদ গড়ে উঠতে থাকে পদ্মার কুলে কুলে।
কত ঘাট কত গঞ্জ গড়ে উঠে পদ্মার তীরে তীরে হিসাব রাখা ভার। কত ফেরী পারাপার এমনকি বন্দর গড়ে উঠে এ পদ্মার পাড়ে। ফেরীতে শুধু কি মানুষ পারাপার? কত ধরনের যানবাহন পার হয়ে যায় ফেরীতে। যে পদ্মায় এক সময়ে শুধু নৌকাই চলতো সে পদ্মায় এখন লঞ্চ স্টীমার আরো কত কিছু চলে। পদ্মা পাড়ের মানুষের জীবন আগের মত নেই। অনেক বদলে গিয়েছে। গ্রামে গঞ্জে হাট বাজারে বেচা কেনার শেষ নেই। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার সময় পার হয়ে নিয়েছে। এক সময়ে মাছ বিক্রি হতো না। দুরে কোন হাটে নেওয়ার যানবাহন ছিল না। এখন বেপারীরা এসে নিয়ে যায়। ব্যবসা বাণিজ্য নানা কাজে মানুষ ব্যস্ত থাকে। পদ্মার মাছ ধরাকে কেন্দ্র কত কিছু গড়ে উঠেছে। এখনো দু’পাড়ের মানুষের আসল জীবিকা মাছ। পদ্মা নদীর মাছ, পদ্মার ইলিশ। ছোট ব্যবসা থেকে শুরু করে বড় বাণিজ্য এ মাছকে ঘিরে। বাড়ি ঘর হাট বাজার কত কিছু গড়ে উঠেছে পদ্মা তীরে। তারপরও পদ্মার ভাঙ্গন থেমে যায়নি কখনো একবার এপাড় ভাংগে ওপাড় গড়ে। আবার ওপাড় ভাঙে এপাড় গড়ে। এ খেলা আর থামে না। আবহামান কাল ধরে চলতে থাকে। পদ্মা পাড়ের জীবন এখন অনেক গতিশীল অনেক বহমান। পদ্মার ঢেউয়ের চেয়ে জীবনের গতি আরো বেশি। লোকালয়ে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আগের মত তারা আর শুধু প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেয় না। তাদের পূর্ব পুরুষের যাপিত জীবন পদ্মাকে ঘিরে। এখন বহুমুখী কর্মকান্ডে তারা ব্যস্ত থাকে। নানা রকম জীবিকার সন্ধানে ছুটে। মানুষের কাছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে গিয়েছে। পাশে ঘর বাড়ি উঠেছে, ইমারত গড়ে উঠেছে। রাস্তা কালভার্ট নির্মিত হয়েছে কোথাও কোথাও বেডিবাধ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে হয়েছে। বৈদ্যুতিক বাতিতে গ্রামগঞ্জ আলোকিত হয়েছে। ছেলে মেয়েরা লেখা পড়ায় এগিয়ে গিয়েছে। দালান কোঠা যতই নির্মিত হউক না কেন কিন্তু পদ্মার ভাংগন রোধ হয়নি। পাকা ঘর বাড়ি মসজিদসহ এলাকার পর এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। কোন কোন গ্রাম ভাংগতে ভাংগতে পুরাটা পদ্মার বুকে মিশে গিয়েছে। এরকম অনেক মানুষ যারা বাড়ি ঘর জমি জিরাত হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। এরা ভেসে বেড়ায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। নতুন ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা করে। এসব মানুষের নিরন্তর পথ চলা যেন থামে না।
এখন আর মাঝি মাল্লা নেই। গুনটানা নৌকাও নেই। দাঁড় বেয়ে গুন টেনে কত কষ্ট করেছে আগের মানুষেরা। এত কষ্ট করেও দু’বেলা ভাত জোটাতে পারেনি ছেলে মেয়েদের ভাগ্যে। দারিদ্রতার মাঝে ঘুরপাক খেয়েছে। এখন আর সে সময় নেই, সবকিছু বদলে গিয়েছে। নৌকায় ইঞ্জিন লেগেছে। এখন সব ইঞ্জিন চালিত নৌকা লঞ্চ স্টিমারও এসেছে। পদ্মার ঢেউয়ের চেয়ে ইঞ্জিনের শব্দ বেশি শোনা যায়। বড় বড় স্টিমার যাত্রী নিয়ে মালামাল নিয়ে পদ্মার বুকে ধেয়ে চলে। এক গঞ্জ থেকে আরেক গঞ্জে বয়ে নিয়ে যায়। যোগাযোগ সহজ হওয়ায় যাতায়ত আরো বেড়ে গিয়েছে। লঞ্চের সংখ্যা বাড়ে, স্টীমারও বাড়তে থাকে। স্টীমারের সাথে পাল্লা দিয়ে দ্বিতল লঞ্চ পদ্মায় নামে। শুধু পদ্মা পাড়ের বা আশে পাশের মানুষজন নয় দুরবর্তী জেলার মানুষেরা লঞ্চ স্টীমার করে যাতায়াত করে। বিভিন্ন মালামাল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়। এতে অর্থনীতির চাকা অনেক সচল হয়। গ্রামীন মানুষের জীবন যাপনের মানও বাড়তে থাকে তবে মাঝে মাঝে বিশেষ করে বর্ষার সময় ঝড় বাদলে কোন কোন নৌযান ডুবে যায়। অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে পদ্মার বুকে। এসবের পরও কোন কিছু থেমে থাকে না। চলতে থাকে, নদীর স্রোতের মত চলতে থাকে। ফেরীতে বাস ট্রাকগুলো দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে থাকে কখন ফেরী পাড়ি দেবে । ফেরী পাড়ে এসে ভিড়লে একে একে গাড়িগুলো ফেরীতে উঠে। পনের বিশটা গাড়ি একসঙ্গে ফেরী পাড়ি দেয়। এ দৃশ্য দেখলে সহজে মনে হয় না কোন কালে মাঝিরা খেয়া ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে পারাপার করাতো। তবে মাছ ধরার নৌকা এখনো অনেক। জেলেরাও অনেক আছে। নৌকার মাঝিদের হয়ত খুঁেজে পাওয়া যায় না। পদ্মার মাছের স্বাদ এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরে। পদ্মার ইলিশের সুনাম দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। পদ্মার রূপালী ইলিশ দেখতে যেরকম সুন্দর তার চেয়ে বেশি সুস্বাধু। এখনো ঝাকে ঝাকে ইলিশ পদ্মার জলে বিররণ করে। জেলেদের জালে ধরা পড়ে। জেলেরাও মাছ ধরার আনন্দে মেতে উঠে। দিনে রাতে মাঝ ধরে। দেশের নানা প্রান্তের মানুষের কাছে পদ্মার ইলিশ পৌঁেছ যায়। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। দেশের বাইরে রপ্তানি হয়ে বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসে। আগের দিনের কথা মানুষের আর মনে থাকে না। পেছনে ফিরে তাকানোর সময় কোথায়। সামনের দিকে এগিয়ে চলে। পদ্মাকে নিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এতকাল পদ্মা পাড়ি দিয়েছে নৌকায়, লঞ্চে, ফেরীতে, স্পীড বোটে এখন মানুষ পায়ে হেঁটে পদ্মা পাড়ি দিতে চায়। এ কেমন স্বপ্ন! অনেকটা দিবা স্বপ্নের মত। এতবড় পদ্মা খরস্রোতা পদ্মা কিভাবে হেঁটে পাড়ি দিবে। কেউ বলে অবাস্তব, একেবারে অসম্ভব, এ কখনো হতে পারে না। কেউ বলে পদ্মার উপর নাকি সেতু হবে। এ কি করে হয়? এত লম্বা এত দীর্ঘ সেতু কি করে সম্ভব। এ স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। কখনো বাস্তবতায় রূপ নেবে না। তারপরও স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি। স্বপ্নতো একদিন বাস্তবে রূপ নিতেও পারে। এরকম নানান কিছুর মধ্যেও মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। একটি সেতুর স্বপ্ন। দীর্ঘতম একটি সেতুর স্বপ্ন। দেশের সব চেয়ে দীর্ঘতম সেতু নির্মিত হবে পদ্মা নদীর উপর। ভাবতেও কেমন লাগে। পদ্মার নদীর ওপর সেতু নির্মিত হবে, সেতু দিয়ে যানবাহন পার হবে। মানুষ পদ্মা পাড়ি দেবে। এত বিপুল অর্থ কোথা থেকে আসবে? নিজস্ব অর্থায়নে নাকি পদ্মা সেতু হবে।
কার আছে এত সক্ষমতা? এত বড় দুঃসাহস! এসবের কোন উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। সময়ের গতিতে সবকিছু বদলে যায়। দিনে দিনে স্বপ্নটা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে স্বপ্নটা এগিয়ে যায়। কেউ আর থামাতে পারে না। ধীরে ধীরে স্বপ্নটা বড় হতে থাকে। এক সময় অনেক বড় স্বপ্ন হয়ে ওঠে। দেশের সব মানুষের স্বপ্ন হয়ে যায়। স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে। কেউ কেউ অবাক নয়নে থাকায়। বলে ওঠে, একি করে সম্ভব! স্বপ্ন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে সেতুটি দৃশ্যমান হতে থাকে। কোটি মানুষের আবেগ অনুভূতি এ সেতুকে নিয়ে আবর্ত হয়। প্রমত্তা পদ্মার মত অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে স্বপ্নের সেতুটি। খরস্রোতা পদ্মার বুক থেকে জেগে ওঠে স্বপ্নের সেতু পদ্মা। গর্বের সেতু পদ্মা। অবাক বিস্ময়ে তাকায় সারা বিশ্ব। লাখো মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয় স্বপ্নের সেতু পদ্মা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যাংকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধতরুণ প্রজন্মের আত্মহত্যার প্রবণতা ও প্রাসঙ্গিক কথা
পরবর্তী নিবন্ধতপন বড়ুয়া