ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই

চট্টগ্রামে সেপ্টেম্বরের তিন গুণ আক্রান্ত অক্টোবরে রোগীকে অবশ্যই মশারির ভেতর থাকতে হবে বেশি করে খেতে হবে তরল খাবার

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

মধ্য আগস্টের পর থেকে বাড়তে থাকা ডেঙ্গুর প্রকোপ যেন কমছেইনা চট্টগ্রামে। বরঞ্চ দিন দিন এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গতকালের আগের ২৪ ঘন্টায়ও নতুন করে ৮৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। আর কেবল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালেই ৮৭ জন রোগী বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছে। সবমিলিয়ে চলতি মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে অক্টোবর) চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৭৬ জনে। আক্রান্তদের মাঝে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। অক্টোবর এক মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৬১ জনে। যা সেপ্টেম্বর মাসের তিনগুণ। সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬০১ জন। আগস্টে ১১৪ জন এবং জুলাইয়ে ৬৪ জন আক্রান্ত হয়। এর আগে জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪ জন, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ০ জন এবং জুনে ১৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় চট্টগ্রামে। সবমিলিয়ে চলতি মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৭৬ জনে।
থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছেনা বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি বলেন, কদিন বৃষ্টি বন্ধ থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ের সময় ফের কয়েকদিন বৃষ্টি হয়েছে। আর থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন পাত্রে (জায়গায়) পানি জমে মশার লার্ভার সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে এডিশ মশার প্রজনন (বংশ বিস্তার) ঘটছে। মূলত এ কারণেই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছেনা। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে হলে টানা ১৫ দিন বৃষ্টি বন্ধ থাকতে হবে। বৃষ্টি বন্ধ না হলে প্রকোপ কমার সম্ভাবনা তেমন নেই, বরং প্রকোপ আরো বাড়তে পারে বলে জানান সিভিল সার্জন।
দিন দিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেড়ে যাওয়ায় চাপ সামলাতে হিমশিম অবস্থায় চমেক হাসপাতাল। তিনটি মেডিসিন (১৩, ১৪ ও ১৬নং) ওয়ার্ড আর দুটি শিশু (৮ ও ৯ নং) ওয়ার্ডসহ হাসপাতালের ৫টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্ত রোগীরা দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেকেই দেরিতে হাসপাতালে আসছে। দেরি হলে ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। তাই জ্বর হলেই ডেঙ্গু টেস্ট করার পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বরের সাথে বমি ভাব, পেট ব্যথা, চোখ লালচে হয়ে যাওয়া -এসব ডেঙ্গুর লক্ষণ। এসবের কয়েকটি দেখা গেলেই দ্রুত টেস্ট করা এবং চিকিৎসকের পরার্মশ নেয়া উচিত। আর ডেঙ্গু ধরা পড়লে রক্তের (সিবিসি) পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর রক্তের প্লাটিলেটের মাত্রা বুঝা যায়। ডেঙ্গু আক্রান্তের অধিকাংশ রোগীর রক্তের প্লাটিলেট কমে যায়। প্লাটিলেটের মাত্রা ও রক্তের আরো কিছু ইনডিকেটর দেখে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
ডেঙ্গুর তেমন কোন ওষুধ নেই উল্লেখ করে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাকিল ওয়ায়েজ ও ডা. আব্দুর রব মাসুম আজাদীকে বলেন, আক্রান্ত রোগীকে বেশি বেশি তরল জাতীয় (পানীয়) খাবার খাওয়াতে হবে। এটাই মূলত ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা। জ্বর থাকলে শুধু সাধারণ প্যারাসিটামল চলবে। এর বাইরে তেমন ওষুধ নেই। তবে আক্রান্ত রোগীর রক্ত (সিবিসি) পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিত রক্তের প্লাটিলেট ও কিছু ইনডিকেটর মনিটর করতে হবে। এটা খুবই জরুরি। সাধারণত আক্রান্তের প্রথম কয়েকদিন রোগীর শরীরের প্লাটিলেট ও হোয়াইট ব্লাড সেল (ডব্লিউবিসি) কমে যায়। এসময় তরল জাতীয় খাবার (জুস, ডাবের পানি, স্যালাইন, স্যুপ প্রভৃতি) বেশি বেশি খেতে হবে। পরিবারের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই দুই চিকিৎসক।
আর আক্রান্ত রোগীকে মশারির ভেতর রাখতে হবে জানিয়ে মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুর সাত্তার বলেন, কোনো এডিস মশা আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানোর পর অন্য কাউকে কামড়ালে তিনিও আক্রান্ত হন। এজন্য পরিবারের একজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে বাকিদেরও আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তাই আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই মশারির ভেতর রাখতে হবে।
এদিকে, সচরাচর মহানগরের বাসিন্দাদের মাঝে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেলেও এবার বিভিন্ন উপজেলা থেকেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বলে জানান চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। এবার প্রায় সব এলাকা থেকেই রোগী আসছে। অর্থাৎ ডেঙ্গুর প্রকোপ মহানগরে সীমাবদ্ধ নেই। গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে।
চাপ বাড়লেও ভর্তি থাকা সকল ডেঙ্গু রোগীকে মশারি সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে জানিয়ে হাসপাতাল পরিচালক বলেন, মশারি থেকে শুরু করে ডেঙ্গু রোগীদের প্রয়োজনীয় সব ওষুধ-পথ্য নিশ্চিত করা হচ্ছে। কোনো কিছুর সংকট দেখা দিলে দ্রুত যাতে আমাদের জানানো হয়, ওয়ার্ড সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় (চমেক হাসপাতালের তথ্যসহ) ২ হাজার ৫৪৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। মৃত্যু হয় অন্তত ৭ জনের। চমেক হাসপাতালের তথ্য ছাড়া ২০২০ সালে ১৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য জানায় সিভিল সার্জন কার্যালয়। সঠিকভাবে রিপোর্টিং না হওয়ায় ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত চিত্র আসেনি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পরের বছরের (২০২১ সালের) তথ্যেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। গত বছর (২০২১ সালে) সবমিলিয়ে ৫৫০ জনেরও বেশি রোগী শনাক্তের তথ্য পাওয়া যায় চট্টগ্রামে। আর আক্রান্তদের মাঝে অন্তত ৮ জনের মৃত্যুর তথ্য জানায় সিভিল সার্জন কার্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রধানমন্ত্রী আসছেন, তাই ‘সুনজর’
পরবর্তী নিবন্ধঅনলাইনে গেমের নামে জুয়া পাচার কোটি কোটি টাকা