ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম : পরিবহন সেক্টর চট্টগ্রাম

ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরী | বুধবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

শিশুশ্রম একটি সমাজ কাঠামোগত সমস্যা। সমাজ যেখানে স্তরায়িতশ্রেণি বিন্যস্ত এবং অসমতা আর বৈষম্য যেখানে সমাজের মূল চরিত্র সেখানে অসমতা এবং বৈষম্যের কারণেই দারিদ্র এবং শিশুশ্রমের উপস্থিতি অনিবার্য।

শিশু আইন, ২০১৩ অনুসারে ১৮ বছরের নিচে সকলকে শিশু বলা হয়েছে। শিশুশ্রমের বিভিন্ন রকমফের আছে। আইএলও বলছে তিনশ রকমের শিশুশ্রম আছে। শিশুশ্রম দন্ডণীয় অপরাধ। আমাদের দেশে সরকার ৩৮টি কাজকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে আমাদের বিবেচনায় সবচেয়ে কঠিনতম এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হচ্ছে সড়ক পরিবহণ সেক্টরে যে সকল শিশু কাজ করে। পরিবহণ আইনেই আছে ২১বছরের নিচে কেউ প্রকাশ্যে (লোকালয়ে) গাড়ি চালানো বা এর সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারবে না। দেখা যায় শুধু মাত্র দারিদ্র্যের কারণেই শিশুগুলো এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে। সাধারণ সূত্র বলছে, দারিদ্রতা ১শতাংশ বাড়লে শিশুশ্রম ০.৭০শতাংশ বাড়বে।

ঘরে তিনদিনের খাবার আছে, দেশে এমন পরিবার এখনো ৬০শতাংশ হবে না” পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব এম..মান্নানের এ বক্তব্যে দেশে দারিদ্র্যের চিত্র পাওয়া যায় (‘২০ পেরিয়ে ব্রতী’ অনুষ্ঠানে, প্রথম আলো, এপ্রিল ০২, ২০২২)। বিশ্বে প্রায় ২৫ কোটি শ্রমজীবী শিশু রয়েছে। তন্মধ্যে ১৮কোটি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের সাথে যুক্ত ৩৪.৫০লাখ শিশু আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত রয়েছে ১৩লাখ শিশু ( জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০১৩)। কোভিড১৯, রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক মন্দা ইত্যাকার কারণে এ সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে দেশে এবং বিশ্বে।

গবেষণার প্রেক্ষাপট :

২০২১সালের সেপ্টেম্বর মাসে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঘাসফুল ‘ Community Based Child Protection Committee Project’ নামক শিশু সুরক্ষা বিষয়ক প্রকল্পের কাজ শুরু করে। প্রকল্পের মেয়াদ ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে ৩১মার্চ ২০২২ ( ০৭ মাস) । এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম শহরের ৪১টি ওয়ার্ডে জনপ্রতিনিধি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্কুল, মাদ্রাসা, ধর্মীয় নেতা এবং সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৪১টি শিশু সুরক্ষা কমিটি গঠন করে শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, ইভটিজিং ইত্যাদির নেতিবাচক দিক সর্ম্পকে অবহিতকরণ, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এবং শিশু নির্যাতনের ধরন, গতি প্রকৃতি মূল্যায়ণ পূর্বক প্রতিকারে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সংগঠিত করে। এ প্রকল্পের আওতায় ডিসেম্বর ২০২১ এর তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মার্চ ২০২২ সময়কালে কোভিড১৯ পরবর্তী চট্টগ্রাম শহরে সড়ক পরিবহণে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে যুক্ত শিশুদের উপর আমরা ‘ Children Working in the Hazardous Road Transport Sector in Chattogram City, Bangladesh – A Sociological Profile’ শিরোনামে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা শুরু করি। আমাদের অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে চট্টগ্রামে সড়ক পরিবহণে প্রায় ১৫হাজার শিশু যুক্ত রয়েছে। দৈবচয়ন পদ্ধতিতে চট্টগ্রাম শহর ও সংলগ্ন এলাকার ৩০টি ষ্টেশন থেকে নির্ধারিত ‘প্রশ্নমালার’ ভিত্তিতে ৩৩৮ জন ‘উত্তরদাতার’ (শিশুর) সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় এবং ৩টি কেস স্টাডি (ঘটনা অনুধ্যান) ও করা হয়। তাছাড়া শিশুদের মাবাবা, অভিভাবক, পরিবহণ মালিকড্রাইভার, শ্রমিক নেতৃবৃন্দ, বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ, কল কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, সুশীল সমাজসহ অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় (FGD ) করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যাদি যাচাই বাছাই পুনঃ পরিক্ষা নিরিক্ষা পূর্বক সমাজবিজ্ঞান স্বীকৃত গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরী করা হয়। যা ৩১মার্চ ২০২২ ব্র্যাক লানিং সেন্টারে এবং ২২জুন ২০২২ চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আশরাফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় শিশু কল্যাণ পরিষদের ১৪তম সভায়ও উপস্থাপন করা হয়। পাঠক সমীপে গবেষণার সার সংক্ষেপ উপস্থাপন করা হল তবে মুদ্রণ পরিসরের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে কোন টেবল (সারণী) দেয়া সম্ভব হল না। এখানে ‘উত্তরদাতা’ বলতে সাক্ষাৎকার দানকারী সড়ক পরিবহণে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের বুঝানো হয়েছে।

কোন জেলার বাসিন্দা :

এ প্রশ্নের উত্তরে দেখা যায় ১৩৫জন (৩৯.৯৪%) চট্ট্রগাম জেলা ও শহরের, কুমিল্লা ৪১ জন (১২.১৩%), নোয়াখালী ৩৬জন (১০.৬৫%), ভোলা ৩০জন (.৮৭%), নীলফামারী ২৩জন (.৮০%), লক্ষীপুর ১৩(.৮৫%), চাঁদপুর ১১জন (.২৫%), ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ৮জন (.৩৭%), কক্সবাজার ৭জন (.০৭%) বরিশাল এবং ফেনী উভয় জেলার ৬জন করে (.৭৭%) এবং বাকীরা অন্যান্য জেলা থেকে এসেছে। এই ৩৩৮জন ২৩টি জেলা এবং ১টি সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দা। এ তথ্য থেকে বুঝা যায় চট্টগ্রাম এবং তৎপাশ্ববর্তী জেলা সমূহের হত দরিদ্র মানুষগুলো ভাগ্য অন্বেষণে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে আসে কাজের সন্ধানে। লক্ষণীয় যে, আমাদের ইতোপূর্বের গবেষণায় ( চৌধুরী : ২০১৮) পরিবহণ সেক্টরে চট্টগ্রাম এলাকার শিশু কর্মরত ছিল ৩৪(২১.২৫%) বর্তমানে তা বেড়ে ১৩৫জন (৩৯.৯৪%), কোভিডের কারণে জ্যামিতিক হারে এ সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে হয়।

গ্রাম থেকে শহরে আসার কারণ:

এ প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় আর্থিক সংকটের কারণে ১২৪ জন ( ৩৬.৬৯%), পরিবারের প্রয়োজনে ৭৭জন (২২.৭৮%), অর্থ উপার্জনের জন্য ৩৭জন (১০.৯৫%), মাবাবাকে সাহায্য করার জন্য ৪৬জন ( ১৩.৬১%), দারিদ্রের কারণে ৩৮জন (১১.২৪%), কাজের সন্ধানে ১৬জন (.৭৩%)। এ তথ্য আমাদেরকে বহুল আলোচিত ‘ চঁংয ধহফ চঁষষ’ ফ্যাক্টরের কথাই জানান দিচ্ছে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যে মানুষ কর্মের আশায়, জীবিকার আশায়, উন্নততর জীবনের আশায় স্থানান্তরিত হয় নতুন জায়গা খুঁজে বের করে এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

কর্মএলাকা ও আবাসস্থল :

এ প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় উত্তর দাতা (শিশু) চট্টগ্রাম শহর এবং তৎসংলগ্ন ৩০টি এলাকায় যেমন অক্সিজেন৪৪, বড়পোল ৩৩, এ কে খান ইস্পাহানী ২৭, কর্ণেল হাট ১৯, অলংকার মোড় ১৮, ২নং গেইট ১৫, নিউ মার্কেট, ফইল্ল্যাতলী এবং কুয়াইশ লিংক রোড প্রতিটিতে ১২জন করে বাকীরা কুয়াইশ, কালুর ঘাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, ফতেয়াবাদ, বড় দিঘীর পাড় এলাকায় কাজ করে।

উত্তর দাতারা হাটহাজারী এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার ১১টি থানার ২৪টি এলাকায় বাস করে যেমন বায়োজীদ, আকবর শাহ, হালিশহর, পাহাড়তলী, বাকলিয়া, কোতোয়ালী, খুলশী, চান্দগাঁও, ডবলমুরিং। তারা অপেক্ষাকৃত নিচু জলমগ্ন, ঘিঞ্জি এলাকার বস্তিতে বাস করে যেখানে স্বল্প ভাড়ায় থাকা যায়। অনেকে গাড়ীর গ্যারেজে, ফুটপাতে ( আইল্যান্ড) ও থাকে। গবেষণা বলছে ধনী এবং সচ্ছলরা নগর শহরের কেন্দ্রে / অভিজাত এলাকায় থাকে ও গরীবরা গলি ঘুপছি, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা নিম্নাঞ্চলে বাস করে ( আলী ১৯৯২, আলী এবং মিঞা ২০১৬)

বয়স, ধর্ম ও লিঙ্গ :

এ প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় ৮বছর বয়সী ১জন (.২৯%), ১০বছর বয়সী ২জন (.৫৯%), ১১বছর বয়সী ৭জন (.০৭%), ১২বছর বয়সী ১৯জন(.৬৩%), ১৩ বছর বয়সী ২৯জন (.৫৮%), ১৪ বছর বয়সী ৬৪ জন (১৮.৯৩%), ১৫ বছর বয়সী ৩৯জন (১১.৫৪%), ১৬ বছর বয়সী ৭১জন (২১.০০%), ১৭ বছর বয়সী ১০৩ জন ( ৩০.৪৭%), ১৮ বছরের কম ৩জন ( .৮৯%)। এতে বুঝা যায় সড়ক পরিবহণে কর্মরত শিশুদের অধিকাংশেরই বয়স ১১১৭বছর। তাদের মধ্যে মুসলিম ৩২২জন ( ৯৫.২৬%), হিন্দু ১৪জন (.১৪%), বৌদ্ধ ২জন ( .৫৯%), খ্রীস্টান কিংবা উপজাতি পাওয়া যায় নি। নেই কোন মেয়েশিশু এটা বোধ করি আমাদের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কারণে।

পেশা নির্বাচন, পেশার ধরণ, বাবা ও পরিবারের অন্যদের পেশা :

কার সিদ্ধান্তে এ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যোগ দিয়েছে এ প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, বাবার সিদ্ধান্তে ১২৩জন ( ৩৬.৩৯%), মায়ের সিদ্ধান্তে ৫৬ জন (১৬.৫৭%), ভাইয়ের সিদ্ধান্তে ২৫জন ( .৪০%), বোনের সিদ্ধান্তে ২১জন ( .২১%), নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৫১জন ( ১৫.০৯%), স্থানীয় অভিভাবকের সিদ্ধান্তে ১৭জন (.০৩%), অন্যান্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ৪৫জন (১৩.৩১%)। তাদের মধ্যে ১৯৪জন ( ৫৭.৪০%) হেলপার কাম টেম্পোরারি ড্রাইভার যাদের বয়স ৮১৮ বছর এবং ৪৯জন (১৪.৫০%) ড্রাইভার এবং গাড়ী ধোয়া মোছা ইত্যাদি কাজে রয়েছে ৯৫জন (২৮.১১%)। তাদের বাবাদের মধ্যে ৮৭জন ড্রাইভার, ভ্যান চালক ৫জন , রিক্সা চালক ২৬জন, বাকীরা দিনমজুর, হকার, বেকার, কোভিডের কারণে পেশাচ্যুত ইত্যাদি। সন্তুষ্টির বিষয় হচ্ছে উত্তরদাতাদের পরিবারের মাত্র ২৪জন (.১০%) সড়ক পরিবহণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত রয়েছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো উত্তর দাতা ৩৩৮জনের মধ্যে ২৪৩জন (৭১.৯০%) হেলপার কাম টেম্পোরারি ড্রাইভার এবং ড্রাইভার যারা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গাড়ী চালায় সংশ্লিষ্ট নজরদারীর দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ, উওঋঊ, শ্রম অধিদপ্তর, ট্রাফিক পুলিশ এমন কি সড়ক পরিবহণ নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক যোগসাজশে ‘লাইন খরচ’ দিয়ে। প্রকাশিত তথ্যে জানা যায় ২০১৩ সালে ( চৌধুরী ; ২০১৩) ২১% অবৈধ চালক, ২০১৮ সালে ( চৌধুরী ; ২০১৮) ৩৯% অবৈধ চালক। টিআইবি’র ২০১৭ সালের টহরাবৎংধষ চবৎরড়ফরপ জবারব িসূত্রে জানা যায় ৩৫% অবৈধ চালক, সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রীর সংসদের বক্তৃতায় জানা যায় ৪৬.৫৬% অবৈধ চালক। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে দেশে অবৈধ চালক ৫০% এর বেশী। সবকিছুকে ছাড়িয়ে চট্টগ্রামে ৭১.৯০% অবৈধ চালক যা অত্যন্ত বিপদজনক।

আয়, কর্মঘন্টা, কর্মের মেয়াদ:

দৈনিক কত ঘন্টা কাজ করে, কত টাকা আয় হয় এবং কতদিন থেকে এ কর্মে নিয়োজিত এ প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, ৩৫জন (১০.৩৫%) ৭দিন থেকে ৩বছর যাবত দৈনিক ১৯ ঘন্টা কাজ করে প্রতিদিন ২০৭০টাকা পায়। ৫৭জন (১৬.৮৬%) ৪দিন থেকে ৪বছর যাবত দৈনিক ৫১২ ঘন্টা কাজ করে প্রতিদিন ১০০১৫০টাকা পায়। ৩জন (.৮৯%) .৫ বছর থেকে ৪বছর যাবত প্রতিদিন ৪৭ ঘন্টা কাজ করে ১৫১২০০ টাকা পায়। ১৭৭জন (৫২.৩৭%) ৭দিন থেকে ৪বছর যাবত প্রতিদিন ৪১৮ ঘন্টা কাজ করে ২০১২৫০ টাকা পায়। ৬৩ জন (১৮.৬৪%) ১মাস থেকে ৪বছর যাবত প্রতিদিন ৪১৭ ঘন্টা কাজ করে ২৫১৩০০ টাকা পায়। ৩জন (.৮৯%) ১বছর যাবত প্রতিদিন ৮১২ ঘন্টা কাজ করে ৩৫১৪০০ টাকা পায়। এতে দেখা যায় ঝুঁকিপূর্ণ ও হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও শিশুগুলো ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত। এক্ষেত্রে শোষণ, শ্রমশোষণ সম্পর্কিত মাক্সের ধারণা যথার্থ প্রমাণিত।

মালিকড্রাইভারের সাথে সর্ম্পক, কাজের ঝুঁকি, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন:

এ প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় ২৪১জনের (৭১.৩০%) সাথে মালিকড্রাইভারের স্বাভাবিক সর্ম্পক রয়েছে। ১২জনের (.৫৪%) সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক রয়েছে। ৬৪জন (১৮.৯৩%) সর্ম্পক খারাপ বলে জানিয়েছে এবং ২১ জন (.২১%) এ প্রশ্নের জবাব দেয়নি।

কাজের ঝুঁকি সর্ম্পকে জানে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে ৩১৪জন (৯২.৯০%) ঝুঁকি সর্ম্পকে অবগত বলে জানান বাকী ২৪ জন (.১০%) এ কাজ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে না। লক্ষণীয় তাদের মধ্যে ২৮১জন (৮৩.১৪%) বৃত্তিমূলক/কারিগরী প্রশিক্ষণ অথবা ঝুঁকি মুক্ত কাজের সুযোগ চায়।

শারীরিক নির্যাতন বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে ৩০৯জন (৯১.৪২%) শারীরিক নির্যাতনের কথা জানায় তবে ২৯জন (.৫৮%) না সূচক উত্তর দেয়।

যৌন নির্যাতন বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে ৪৩জন (১২.৭২%) যৌন নির্যাতনের কথা স্বীকার করে যদিও ২৯৫জন (৮৭.২৮%) না সূচক উত্তর দেয়। উল্লেখ্য আমাদের সংস্কৃতিতে যৌন বিষয়ে কেউ খোলামেলা আলোচনা করতে চায় না, লজ্জা পায়। যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও তা কেউ সচরাচর প্রকাশ করতে চায় না। এ ক্ষেত্রে বহুল উচ্চারিত প্রবাদ , ‘বুক ফাটে তবু ও মুখ ফোটে না’ সত্য!

ড্রাইভার কর্তৃক বখরা আদায়, টাকা খরচের ধরণ, বিনোদন, পরিবারের সাথে সর্ম্পক :

২৭৯জন (৮২.৫৪%) ড্রাইভার কর্তৃক বখরা আদায়ের কথা জানান, ৪৭জন (১৩.৯০%) না সূচক জবাব দেন এবং ১২জন এ প্রশ্নের জবাব দেয় নি।

আয় করা / রোজগারের টাকা কিভাবে খরচ করেন এ প্রশ্নের জবাবে জানা যায় ৮৮জন (২৬.০৩%) পরিবারকে টাকা দেয়, ৭৩জন (২১.৬০%) দৈনন্দিন খাওয়ার খরচে ব্যয় করে, ৫৫জন (১৬.২৭%) উপাদেয় খাদ্য খায়, ৩৯জন (১১.৫৪%) ভিডিও গেইমস খেলে, ৩৪জন (১০.০৫%) সিনেমা দেখে, ৩৮জন (১১.২৪%) নেশা করে, ১১জন (.২৫%) ধুমপান করে।

৫৬জনের (১৬.৫৭%) অবসরবিনোদনের কোন সময় নেই, অন্যান্যরা খেলাধূলা, ভিডিও গেইমস, কেউ বা অবসাদ ক্লান্তি হেতু ঘুমিয়ে, শুয়ে বসে সময় কাটায়। পরিবারের সাথে সর্ম্পক প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় ২৯২জন (৮৬.৩৯%) পরিবারের সাথেই থাকে, অন্যান্যরা গ্যারেজ, ফুটপাত, ওর্য়াকশপ বা একই এলাকার কারো সাথে থাকে।

শিক্ষা, জন্ম নিবন্ধন, বাল্যবিয়ে :

বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানের মূলনীতির অংশে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জাতীয় অঙ্গীকার হচ্ছে – ‘Education for All আবার এসডিজি এর লক্ষ্য ৪ (চার) – ‘Quality Education’ – মান সম্পন্ন শিক্ষা। জাতীয় সাক্ষরতার হার হচ্ছে ৭৫.৬০%। উত্তর দাতাদের (শিশু) শিক্ষা সর্ম্পকিত প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় অক্ষর জ্ঞানহীন ৫০জন (১৪.৭৯%), প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে ১৮৫জন (৫৪.৭৩%), ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে ৮১জন ( ২৩.৯৬%), মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছে ২২জন (.৫১%)। তাদের বাবার শিক্ষা সম্পর্কিত তথ্যে জানা যায় অক্ষর জ্ঞানহীন ১৫০জন (৪৪.৩৮%), প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে ১৩৭জন (৪০.৫৩%), ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে ৪২জন ( ১২.৪৩%) আর মাদ্রাসায় পড়েছে ৯জন (.৬৬%)। উত্তর দাতা ও তাদের বাবার মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হচ্ছে বাবারা ১৫০জন (৪৪.৩৮%) অক্ষর জ্ঞানহীন কিন্তু উত্তর দাতাদের (শিশু) মধ্যে ৫০জন (১৪.৭৯%) অক্ষর জ্ঞানহীন। এটি একটি উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন।

উত্তর দাতার (শিশু) জন্ম নিবন্ধন সর্ম্পকিত তথ্যে জানা যায় ২১৩জন (৬৩.০২%) জন্ম নিবন্ধন করেছে কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হল ১২৫জন ( ৩৬.৯৮%) জন্ম নিবন্ধন করেনি।

বিভিন্ন কারণে অকারণে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের ঝোঁক/প্রবণতা বেশী। বিশ্বে ১৫বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষে। উত্তর দাতাদের বৈবাহিক মর্যাদা বিষয়ক তথ্যে জানা যায় ২৮০জন ( ৮২.৮৪%) অবিবাহিত এবং ৪৬জন শিশু (১৩.৬১%) বিবাহিত ১২ জন (.৫৫%) বিয়ের দিন ক্ষণের অপেক্ষায় অর্থাৎ ৫৮জন (১৭. ১৬%) বিবাহিত এতে বুঝা যায় শুধুমাত্র মেয়েশিশু নয় ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রেও বাল্যবিয়ের হার ক্রম বর্ধনশীল।

চিকিৎসা, নিরাপদ পানি, মোবাইল ও তথ্য প্রযুক্তি সম্পৃক্ততা:

কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হলে প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যয় সর্ম্পকিত প্রশ্নের উত্তরে ২৫৩জন (৭৪.৮৫%) জানান পরিবহণ মালিক চিকিৎসার খরচ দেয়, ২৩জন (.৮০%) জানান ড্রাইভার চিকিৎসার খরচ দেয় আবার ৬২জন (১৮.৩৪%) জানান নিজেকেই কর্মস্থলে দুর্ঘটনার চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হয়।

টিকাদান সম্পর্কিত তথ্যে জানা যায় ৩০৯জন (৯০.৮৩%) টিকা নিয়েছে, ৩১জন (.১৬%) টিকা নেয় নি।

নানা রোগ বালাই’র অন্যতম বাহন পানি। উত্তর দাতাদের মধ্যে ১৫৫জন (৪৪.৮৬%) ওয়াসার পানি, ৩১জন (.১৭%) ট্যাংকের পানি, ৩৬জন (১০.৬৫%) ডিপ টিউবওয়েল এর পানি, ৪১জন (১২.১৩%) অন্যান্য উৎস থেকে সহজে পাওয়া পানি পান করে এবং শুধুমাত্র ৭১ জন (২১%) জানিয়েছে তারা নিরাপদ পানি পান করে।

বলা হয় মোবাইল ফোন ও তথ্য প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে আমাদের শিশু কিশোর, তরুণরা ঝুঁকিতে রয়েছে। মোবাইল ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্যে জানা যায় পর্ণোগ্রাফিতে আসক্ত ৬১জন (২৪.৫০%), ফেসবুকিং করে ৭৫জন (৩০.১২%), টিকটক বানায় ১৭জন (.৮৩%), টিকটক দেখে ৮৬জন (৩৪.৫৪%), ইউটিউব, ভিডিও ইত্যাদি ১০জন (.২০%)। এ তথ্য খানিকটা উদ্বেগের।

কোভিড ১৯ সম্পর্কিত তথ্য:

কোভিড১৯ সর্বস্তরের মানুষের জন্যই একটি আপদ। হত দরিদ্র খেটে খাওয়া এ শিশুগুলোর কোভিডকালীন দীর্ঘ ছুটি/ লকডাউনে যাপিত জীবনের তথ্যে জানা যায় ১৩৩জন (৩৯.৩৫%) গ্রামে ছিল, ২০৫জন (৬০.৬৫%) শহরে বস্তি, গলি, ঘুপছি, ঝুপড়ি ফুটপাতে ছিল। ৩৩৭জন (৯৯.৭০%) আর্থিক কষ্টের কথা জানিয়েছে ৩০১ জন (৮৯.০৫%) খাদ্য সংকটের কথা বলেছে।

কোভিড কালে মানুষের দুর্দশা লাঘবে সরকারি, ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা রকম ত্রাণ ও সাহায্যের কথা যেমন নগদ টাকা, ভোগ্য পণ্য, কাপড় চোপড়, ঔষধ, মাস্ক, সেনিটাইজার ইত্যাদির কথা আমরা জানি। কোভিডকালে সাহায্য সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় ৭৩ জন (২১.৬০%) নগদ সহায়তা পেয়েছে, ২২জন (.৫১%) খাদ্য সাহায্য পেয়েছে, ৩০জন (.৮৭%) মাস্ক পেয়েছে এবং ২১৩ জন (৬৩.০২%) সেনিটাইজার পেয়েছে বলে জানান। এ তথ্যে কোভিড কালে ত্রাণ সাহায্য অপ্রতুল ছিল বলেই জানান দেয়।

কোভিডকালে আয় রোজগার ছিল না বলে জানিয়েছে ৩০৩জন (৮৯.৬৪%), পেশার পরিবর্তন করতে হয়েছে বলে জানিয়েছে ৩১৫জন (৯৩.১৯%), বাসা বদলাতে হয়েছে আরো নিম্নমানের সস্তা বাসায় চলে যেতে হয়েছে বলে জানিয়েছে ৪৮জন (১৪.২০%)

আশানিরাশাহতাশা :

মানুষ আশায় বাঁচে। চট্টগ্রামের সড়ক পরিবহণে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত এ শিশুগুলোর মধ্যেও আমরা ভিন্ন ধরনের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা দেখেছি, জীবনের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে উত্তর দাতাদের (শিশু) কাছ থেকে বৈচিত্র্যময় প্রত্যাশার কথা জানা যায়। দক্ষ ড্রাইভার হতে চায় ৫০জন (১৪.৭৯%), ব্যবসায়ী হতে চায় ২৪জন (.১০%), লেখাপড়া শিখে ভাল চাকরী চায় ২৫জন (.৪০%) বেশি টাকা রোজগারের জন্য বিদেশ যেতে চায় ৭জন (.০৭%), গাড়ীর মালিক হতে চায় ৬জন (.৭৭%), সরকারি উদ্যোগে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিতে চায় ৪১জন (১২.১৩%), দক্ষ মেকানিক হয়ে গ্যারেজ মালিক হতে চায় ৬৫জন (১৯.২৩%), কৃষক হতে চায় ১জন (.২৯%), ডাক্তার হতে চায় ২জন (.৫৯%), ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় ২জন (.৫৯%)

এ প্রশ্নের উত্তর দেয়নি ১১৫জন (৩৪.০২%) তাদের চোখে মুখে, হতাশার ছাপদীর্ঘশ্বাস। লক্ষণীয় ৩৩৮জন শিশুর মধ্যে ১১৫জন (৩৪.০২%) অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশেরও বেশি হতাশ। এ দায় ভার সমাজের।

প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত্বে দেখা যায় এ শিশুগুলো প্রকৃত অর্থেই মৌলিক চাহিদা, সুযোগসুবিধা ও অধিকার বঞ্চিত।

সুপারিশ সমূহ

শিশু আইন, ২০১৩, শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮)। সড়ক পরিবহণ আইন২০১৮, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৮ এর সীমাবদ্ধতা, অসঙ্গতি ও সাংঘর্ষিকতা দূর করে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট অংশীজন কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, বিআরটিএ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (ট্রাফিক উইং), সড়ক পরিবহণ মালিক, শ্রমিক সমিতি ও পরিবহণ শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির তদারকী ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

সড়ক পরিবহণ, গৃহকর্মীসহ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের সুরক্ষা, চিকিৎসা ও যথাযথভাবে বেড়ে উঠার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ চাই।

সমন্বিত জাতীয় নীতিমালার মাধ্যমে শিশুশ্রম, শিশু পাচার, শিশু নির্যাতন রোধ করে তাদের কারিগরী ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা এবং সুস্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশ তথা সুস্থ বিনোদনের সুযোগ নিশ্চিত করা।

বাল্যবিবাহ রোধ, ইভটিজিং, শিশুর যৌনতার ব্যবহার (Pornography) , মাদকাসক্তি ও অপরাধ প্রবণতা রোধে সরকার কর্তৃক গঠিত শিশু কল্যাণ ও সুরক্ষা কমিটিকে কার্যকর করা।

লেখক : সমাজবিজ্ঞানী ও সিনেট সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এবং চেয়ারম্যান ঘাসফুল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবৈধভাবে দখলে থাকা জমি উদ্ধারে রেলওয়েকে মনোযাগী হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাসের পাতায় দৈনিক আজাদী