অবৈধভাবে দখলে থাকা জমি উদ্ধারে রেলওয়েকে মনোযাগী হতে হবে

রেজাউল করিম স্বপন | বুধবার , ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ রেলওয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও রাষ্ট্র পরিচালিত একটি সেবা ও পরিবহন সংস্থা। এর সদর দপ্তর ঢাকায়। ১৯৯০ সালে এই সংস্থা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত হয়। এর লোকবল প্রায় ২৫,০৮৩ জন এবং মোট দৈর্ঘ্য ২,৯৫৫.৫৩ কিমি। বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬২ সালে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ছোট ছোট রেলপথ সেকশন চালু করতে থাকে। প্রথমদিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করা হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি প্রথম বাংলাদেশে রেলপথ স্থাপন করে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলযুগে প্রবেশ করে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে বাংলাদেশের রেল পরিবহন ব্যবস্থার সিংহভাগ পরিচালনা করে। কয়েকটা বেসরকারি সংস্থা খাদ্য ও পানীয়ের ক্যাটারিং, কিছু নির্বাচিত রুট ও রেলওয়ের রিজার্ভেশন ও টিকেটিং ব্যবস্থা এবং প্রধান রেলপথ সমূহে ফাইবার অপটিক কেবল স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকে। বাংলাদেশ রেলওয়েকে মূলত দুইটি অংশে ভাগ করা হয়, একটি অংশ যমুনা নদীর পূর্বপাশ ও অপরটি পশ্চিমপাশ। এদেরকে যথাক্রমে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। পূর্বপাশের অংশের দৈর্ঘ্য ১২৭৯ কিলোমিটার এবং পশ্চিমপাশের অংশের দৈর্ঘ্য ১৪২৭ কিলোমিটার। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের রূপসা নদীর পূর্ব প্রান্তের ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রূপসাবাগেরহাট ব্রডগেজ রেলপথ সেকশনটিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের তৃতীয় অংশ হিসেবেও ধরা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে দুই ধরনের রেলপথ চালু আছে ব্রডগেজ (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি বা ১,৬৭৬ মি.মি.) ও মিটারগেজ (১০০০ মি.মি.)। দেশের পূর্বাঞ্চলে মিটার ও ব্রডগেজ উভয় ধরনের রেলপথ বিদ্যমান। তবে পূর্বাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব রেলওয়ে স্টেশন হতে ঢাকা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথও রয়েছে। ইতিপূর্বে ন্যারোগেজ (২ ফুট ৬ ইঞ্চি বা ৭৪৬ মি.মি.) রেলপথ চালু থাকলেও এখন তা ব্যবহৃত হয় না।

সারাদেশে রেলওয়ের জমি আছে প্রায় ৬২ হাজার একর। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে একক ভাবে সর্বোচ্চ জমির মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর মধ্যে কাগজ কলমে দখলে আছে ৫৮ হাজার ৬০৬.৫৭ একর আর প্রায় ৩ হাজার ৬১৪ একর জমি রয়েছে বেদখলে। তবে রেলের যেসব কর্মকর্তা জমির খোঁজখবর রাখেন তাদের ধারনা অবৈধ দখলে থাকা জমির পরিমান কয়েকগুণ বেশি। বিভাগীয় ও জেলাসহ মূল্যবান জায়গায় রেল নিজেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদি লিজ দিয়ে রেখেছে রেলের জমি। কোথাও কোথাও আবাসিক এলাকা করে রেলের সাবেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে রেলের হিসাব মতে সংস্থাটির জমির মধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে ৩০ হাজার ৭৬৮.৫১ একর। ১৩ হাজার একরের বেশি জমি দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ১৮ হাজার একরের বেশি জমি অব্যবহৃত। বিশেষজ্ঞদের মতে অব্যবহৃত জমির বেশিরভাগ যুগের পর যুগ ধরে অবৈধ দখলে রয়েছে। এর মধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ বেশি। তবে ঢাকা চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে প্রচুর মূল্যবান জমি অব্যবহৃত ও বেদখল অবস্থায় রয়েছে। শহরের বাইরে রেলের বিস্তীর্ণ কৃষি ও জলাভূমি রয়েছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে এই বিবেচনায় এসব জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। ভুক্তভোগী অনেকে বলেন কৃষক বা গরীব মানুষের এইসব জমি অধিগ্রহণ করার পর অব্যবহৃত রাখায় তা টাউট বাটপার ও প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছে। অন্যদিকে শহরের ভিতরের অবৈধ দখলে থাকা জমিগুলোতে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে যাতে মাদক, দেহব্যবসা, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী ও অপরাধীদের অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। বর্তমানে নগরে অধিকাংশ সন্ত্রাসীর আবাসস্থল হলো রেলওয়ের জায়গায় গড়ে উঠা বস্তিতে। ফলে ঐ সব এলাকায় দিনের বেলায়ও সাধারণ মানুষ চলাচল করতে ভয় পায়। আবার অনেক জায়গায় অবৈধ বসতিগুলোতে বিভিন্ন এনজিও ও সামাজিক সংস্থা পানি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করায় অবৈধ দখলদারিরা আরো উৎসাহিত হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকা চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অনেক মূল্যবান বাণিজ্যিক জমি বেসরকারি খাতে লিজ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর কু্‌ড়িলে ১.৮৪ একর জমি পাঁচতারা হোটেল ও শপিংমলের জন্য একটি হোল্ডিংসের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যার বাজার মূল্য শতকোটি টাকার বেশি। এর বাইরে আয় বৃদ্ধির জন্য ২০১৪ সালে রেলের জমিতে হাসপাতাল, শপিং মল, পাঁচ তারকা হোটেল, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে ব্যবসা করার উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে। সরকারি বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ ধরনের ১২টি প্রকল্প সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটি সভায় নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। চট্টগ্রামে সিআরবিতে একটি হাসপাতাল ও শপিং মল নির্মাণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যেটির বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণ মাঠে নামায়, সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ইতস্তত করছে। কারণ চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত এই জায়গা ব্যতীত চট্টগ্রাম শহরে আর কোনো জায়গা খালি নেই। কমলাপুর রেলস্টেশন ঘিরে মাল্টিমোডাল হাব প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়ে জাপানের একটি কোম্পানি প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন করেছে। বাকি প্রকল্পে বিনিয়োগকারী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এর বাইরে আরো তিনটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকা চট্টগ্রাম সহ বড় শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রায় ২০০ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প নেওয়ার সময় ধারণা দেওয়া হয়েছে, জমি দেবে রেল কর্তৃপক্ষ আর অবকাঠামো বানাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। যৌথ মালিকানার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত এইসব জমি রেলের মালিকানায় থাকবে কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ ইতিপূর্বে প্রতিষ্ঠিত বহুতল ফুলবাড়িয়া রেল মার্কেটের মালিকানা ও ভাড়া আদায়ের কোনটাতেই রেলের সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই রেলের অধিগ্রহণকৃত জমি যদি কাজে না লাগে তবে তা মূল মালিক বা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কাছে ফেরত দেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে অন্তত জমিগুলোর সদ্ব্যবহার হবে।

তবে রেলওয়ে নিজেদের জমি দখলে রাখতে না পারলেও নতুন জমি কেনার জন্য ইতিমধ্যে ২টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর একটি হচ্ছে গাজীপুরের কালিগঞ্জের দাড়িয়াপাড়ায়। সেখানে রেলের ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করার লক্ষ্যে ৩৩১.৩১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। জমি কেনার পর সেখানে ব্রডগেজ ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন মেরামতের কারখানা নির্মাণ করা হবে। পর্যায়ক্রমে সেখানে নির্মাণ করা হবে রেললাইন মেরামত কারখানা। রেলওয়ে প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট। এসব কার্যক্রমের জন্য পরে আলাদা প্রকল্প নেয়া হবে। অন্যটি হলো গাজীপুরের ধীরাশ্রমে অভ্যন্তরীন কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ২২২ একর জমি অধিগ্রহণ করার প্রকল্প। যা রেল মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়ে বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা।

এদিকে রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগের তথ্য মতে ঢাকায় রেলের জমির পরিমান ১ হাজার ৩০০ একর, গাজীপুরে ১ হাজার ২২৮ একর, নরসিংদীতে ১ হাজার ৫৪০ একর, সৈয়দপুরে প্রায় ৮০০ একর ও রাজবাড়িতে কয়েকশ একর জমি। যার বেশিরভাগই অবৈধ দখলে আছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ওই দুইটি নতুন প্রকল্প গাজীপুরের আশেপাশে রেলের জমিতেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব অথবা চট্টগ্রামসহ যেখানে নিজস্ব জমি আছে সেখানে প্রথম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ইস্পাহানির ফ্যাক্টরি হতে টাইগার পাস পর্যন্ত রেলের নিজস্ব কয়েক হাজার একর জায়গায় অতি সহজে এটি বাস্তবায়ন করা যায়। কারণ গাজীপুরে কারখানা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু সেটা না করে রেলের আগ্রহ নতুন প্রকল্পে। কারণ নতুন প্রকল্প হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের লাভ বেশি। এই দুইটি প্রকল্পে রাজস্ব খাত হতে খরচ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যদিও রাজস্ব বাজেটের স্বল্পতায় রেললাইন, ইঞ্জিন ও কোচ মেরামতই ঠিকমত হচ্ছে না। অন্যদিকে নতুন আইসিডির জন্য গাজীপুরের ধীরাশ্রমে অনেক আগে থেকেই কাজ চলছে। তবে রেলের অব্যবহৃত জমি কোথায় কী পরিমাণ আছে এবং সেটা ব্যবহার করা যায় কিনাএই বিষয়ে কখনো কোনো সমীক্ষা করা হয় নেই। তাই জমির সমীক্ষা করে প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা দরকার। বর্তমানে রেলের ৪১ টি প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯১ হাজার কোটি টাকা বিদেশি ঋণ। আরো ৮ টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। মনে রাখতে হবে, রেলওয়ের মূল কাজ হলো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সেবা যথাযথভাবে পালন করা। বর্তমানে টিকেট, যাত্রী নিরাপত্তা ও সেবার মান নিয়ে রেলের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ রয়েছে। যেখানে মূল কাজই রেলওয়ে ঠিকমত করতে পারে না, সেখানে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় যুক্ত হয়ে তারা কতটুকু সফল হতে পারবে সেটি বড়ই প্রশ্ন?

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম : পরিবহন সেক্টর চট্টগ্রাম