বিশ্বব্যাপী জেন্ডার বিষয়ক নানা কার্যক্রম যখন একের পর এক সাফল্যের মুখ দেখেছে, তখন ২০২৩ সালে এসেও ‘জেন্ডার’ শব্দটি শুনলে আমাদের দেশের অনেকেরই গায়ে জ্বালা ধরে। অথচ ‘জেন্ডার’ শব্দটি শুনে তার বা তাদের কি মনে হয় বা বিষয়টি তারা কেমন বুঝছেন? নিশ্চিতভাবেই ঠিকঠাক উত্তর মিলবে না । তাই আসুন সহজ করে বুঝি।
জেন্ডার হলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে কোনো একটি সমাজের নারী–পুরুষের প্রত্যাশিত আচরণ। অর্থাৎ সমাজে একজন নারী–পুরুষ কী করবে কিংবা কী করতে পারবে না সমাজ কর্তৃক তা নির্ধারণ করে দেওয়াই হচ্ছে জেন্ডার। জেন্ডার কোনো অপরিহার্য বিষয় নয়, বরং এটি সমাজসৃষ্ট ও পরিবর্তনযোগ্য। আর জেন্ডারের ভিন্নতার কারণে কোনো ব্যক্তি যখন তার অধিকার, সম্মান, মর্যাদা কিংবা অন্যান্য যেকোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন, তাই জেন্ডার বৈষম্য।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার নারীরা। বিশ্বব্যাপী জেন্ডার বৈষম্যকে দুটি ভাগে দেখা হয় যার একটি নারী–পুরুষের দৈনন্দিন কাজ ও দায়–দায়িত্বে জেন্ডারভিত্তিক শ্রমবিভাজনে অসমতা, অন্যটি হচ্ছে অধিকার, পছন্দ, ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারহীনতা বা পর্যাপ্ত সুযোগের অভাব। প্রশ্ন আসে, জেন্ডার বৈষম্য দূর করতে জেন্ডার সমতায়ন বিষয়টি সমাজে কিরূপে বিরাজমান?
সহজ ভাষায় উত্তর হলো, জেন্ডার সমতায়ন নিয়ে সমাজের নিরক্ষর, স্বল্পশিক্ষিত, এমনকি তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সমাজের মধ্যেও ভ্রান্ত ধারণা বিরাজমান। নারী–পুরুষের সমতার কথা বললেই একদল মনে করেন, নারী–পুরুষ তো জৈবিকভাবে আলাদা এবং বৈজ্ঞানিকভাবেও তো নারী–পুরুষ আলাদা। সেক্ষেত্রে নারী–পুরুষ সমান কীভাবে হয়?
এই জেন্ডার সমতায়ন বিষয়টি জটিল কোনো তত্ত্ব নয় বরং নারী–পুরুষের সমতায়ন বলতে নারী–পুরুষ সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টিকে বোঝায়। নারী–পুরুষ, জাতি,ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষেরই সমান মর্যাদা ও অধিকার পাবার অধিকার রয়েছে। মানবাধিকার সনদ বিশ্বের প্র্রতিটি প্রান্তের সকলের সেই মানবাধিকারকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমাদের সমাজে নারী–পুরুষভেদে অধিকার ও মর্যাদায় পরিলক্ষিত হয় ব্যাপক বৈষম্য। জেন্ডার
সমতায়ন মূলত এই বিষয়টি নিয়েই কাজ করে। জৈবিকভাবে এবং জন্মগতভাবে নারী–পুরুষের শারীরিক গড়নের পার্থক্য জেন্ডার সমতায়নের কোন আলোচ্য বিষয় নয়। শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের মধ্যে মানবিক বোধের জাগরণ ঘটে। ফলে শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মধ্যে অপরের প্রতি মর্যাদা, অধিকার ও শ্রদ্ধাবোধকে জাগ্রত করে তোলে।
বিশ্বের প্রতিটি ধর্মই নারী–পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদার কথা বলে। তাহলে আলাদা করে জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে কাজ করা কেন প্রয়োজন? নৃ–তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে মানুষ যেসব আদর্শ, বিশ্বাসের ধারণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে জীবন যাপন করে তা–ই ধর্ম। প্রতিটি ধর্মই মানুষকে নমনীয়তা শেখায়, শেখায় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, তবুও ভালো মানুষ হবার জন্য ব্যক্তির বসবাসকৃত সমাজ স্বীকৃত যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার সেগুলোই শেখায় ও অনুশীলনে উদ্বুদ্ধ
করে ধর্ম। সচেতন দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে, আমাদের সমাজে প্রতিটি ধর্মই নারী–পুরুষের অধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের ব্যাপারে আমরা উদাসীন। যার ফলে ধর্মীয় বিধিবিধানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমতা কিংবা নায্যতার দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান থাকলেও বাস্তবে অনুশীলনের জায়গাতে বরাবরই অনীহা দেখা যায়। তাই জেন্ডার সমতায়নের যে নারী–পুরুষের অধিকার নিয়েই কাজ করে, সেই ব্যাপারটিকে জনসাধারণের মধ্যে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন
করতে হবে। ধর্মীয় সুশিক্ষার মাধ্যমে কট্টরপন্থীতা দূরীকরণ করে পরিপূর্ণ শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয় উদারতারবাদের অনুশীলন ঘটাতে হবে।
আর তাই জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো। জেন্ডার বৈষম্য যেহেতু সামাজিক সমস্যা, তাই জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ কোন একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভব নয়। স্থানীয় কমিউনিটি, শিক্ষাব্যবস্থা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, শিক্ষক, শিক্ষাক্রম,
পাঠপুস্তকসহ সামগ্রিকভাবে সবার অংশগ্রহণ এখানে অত্যন্ত জরুরি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জেন্ডার নির্বিশেষে সবাইকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে একসাথে মিলেমিশে থাকার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। আর এভাবেই গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন একীভূত সমাজ।