আদি বীজ সংরক্ষণ এবং আমাদের মায়েরা

রিতু পারভী | শনিবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

সভ্যতার অগ্রগতি আমাদের অনেককিছু দিয়েছে, ভালো এবং মন্দ। অনেক কিছুই পেয়েছি, সহজ জীবনকে অধিকতর সহজ করতে গিয়ে যুক্ত করেছি জটিলতা, দেহে, মনে। দেহকে আরাম দিতে গিয়ে নাজুক শরীরে বোপন করেছি বিষের বীজ, চিন্তাকে করেছি দুর্বোধ্য।

 

মাঠে ঘাম ঝরানো নীরোগ, শক্তিশালী দেহ শীতলায়ন যন্ত্রে কাবু হয়ে হয়েছে রোগের আধার। সভ্যতার আশীর্বাদ বুমেরাং হয়ে আমাদের নিয়ে চলেছে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গভীর খাদে, আমরা টুপটাপ ঝাঁপিয়ে পড়ছি গভীর অন্ধকারে।

আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান এই বসুন্ধরার এমন এক জায়গায় যেখানে মাটিতে সোনা ফলে, প্রকৃতিই দিয়ে দিয়েছে জীবন চলার সমস্ত উপকরণ। হাজার বছরের ইতিহাস বলে কোনকিছুর অভাব এই ভুস্বর্গে ছিল না। অপার শান্তি, নিরবচ্ছিন্ন জীবন ছিল। কিছু ভয়াবহ রোগ ব্যতিত কোন কিছুই কাবু করতে পারেনি এই জনপদের মানুষকে। মাটির কোলে থেকে মাটির মতই সহজ, সহনশীল ছিল এই জনপদের মানুষ।

উর্বর মাটিতে জন্ম নিতো এমাটির মানুষের জন্য উপযোগী সকল ফসল। যেমাটির যেফসল সেফসলেই সেএলাকার মানুষের জীবনের মুক্তি, জীবনের উপযোগী। বলা হয় যে মাটিতে যে ফল, ফসল ফলে তাসে মাটির সন্তানের জন্যই ফলে।

নদী বিধৌত বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজেদের ফসলের বীজ বংশানুক্রমে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই কাজে নারীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। বীজ সংরক্ষণের প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়ে আসছে নারীদের দ্বারা। মাঠে কাজের পাশাপাশি দক্ষতার সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বংশানুক্রমে করে এসেছে আমাদের মায়েরা, বাংলার নারীরা। তাঁরা জানেন এই আদি বীজের গুরুত্ব, তার সংরক্ষণ পদ্ধতি।

মায়ের মমতায়, অতি যত্নে বীজগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে গ্রামবাংলার নারীরা। হাত বদল করে করে এই পরম্পরা চলে আসছে বহু যুগ ধরে। তাইতো এখনো টিকে আছে সামান্য কিছু আদি জাতের ফল, ফসল, সবজি।

কর্পোরেট আগ্রাসনে হারিয়ে গেছে এই মাটির উপযোগী, এর জল হাওয়ায় টিকে থাকতে পারা, এর পোকামাকড়ের সাথে লড়াই করতে পারা অনেক প্রজাতির ফসল। উচ্চ ফলনের লোভ দেখিয়ে, এই অঞ্চলের মাটির বিরুদ্ধে গিয়ে, কীটনাশক, রাসায়নিক সার আর হাইব্রিড বীজ তুলে দিয়েছে কৃষকের হাতে।

সহজ সরল মাটির মানুষগুলোর সামনে লোভের চকচকে নোট দুলিয়ে ধ্বংস করেছে বহুকাল ধরে বেঁচে থাকা, এই অঞ্চলের মাটির উপযোগী শস্যবীজ। খাবার স্বাদ ভুলিয়ে দিয়ে লাভের স্বাদ লাগিয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষগুলোর মনে, সাথে বাড়তি হিসেবে যোগ করেছে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এর মত ভয়াবহ রোগ।

যুগ যুগের সংস্কৃতি, বীজ সংরক্ষণের যেসংস্কৃতি তাকে ফিরিয়ে আনাটা এখন সময়ের দাবি। প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে ফিরিয়ে আনতে হবে আদি চাষ পদ্ধতি, বাঁচাতে হবে আদি বীজ। আমাদের নারী কৃষকেরা এখনো সেই লড়াই করে যাচ্ছেন। আদি বীজ সংরক্ষণ এবং পুরনো চাষ পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমেই সম্ভব জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে একটা সুস্থ জীবন, সুস্থ কৃষি সংস্কৃতি তৈরি করা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমৃদ্ধির ধারায় ‘সত্যিকারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’
পরবর্তী নিবন্ধজেন্ডার সমতায়ন