জুলে রিমে থেকে ফিফা বিশ্বকাপ

রেজাউল করিম | বুধবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২২ at ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দাদের অনেকে আজ জ্বরে আক্রান্ত। এই জ্বরে তারা আক্রান্ত হন চার বছর পর পর। আঁতকে উঠার কিছু নেই। এটা ফুটবল ভাইরাস। আর কয়দিন পর মধ্যপ্রাচ্যের অনন্য সুন্দর দেশ কাতারে বসছে দ্য গ্রেটেস্ট শো অব দ্য আর্থ অর্থাৎ ফুটবল বিশ্বকাপের ২২তম আসর। আগামী ২০ নভেম্বর বাজবে কিকঅফের বাঁশি। সমগ্র বিশ্বে নয়, বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা আগামী একমাস বুঁদ হয়ে থাকবেন। চট্টগ্রামেও দেখা গেছে, প্রিয় দলের সমর্থকদের পতাকা নিয়ে বাড়ি রাঙাতে। ইতোমধ্যে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের দুই সমর্থক পতাকা লাগাতে গিয়ে মারাও গেছেন।
ফুটবল বিশ্বকাপ সর্বপ্রথম ১৯৩০ সালে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নেয় উরুগুয়ে। এরপর থেকে প্রতি চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফুটবলের এ বিশ্বযুদ্ধ। তবে মাঝে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ আর ১৯৪৬ সালে বসেনি বিশ্বকাপের আসর। এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল। পাঁচবার বিশ্বসেরার ট্রফি নিজেদের ঘরে তুলছে সেলেসাওরা। এছাড়া চারবার করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে জার্মানি এবং ইতালি।
বিশ্বকাপ শুরুর সময় ট্রফির নাম ছিল ‘জুলে রিমে ট্রফি’। ১৯৪৬ সালে প্রথম ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমেকে সম্মান জানিয়ে তার নামে ট্রফির নামকরণ করা হয়। তবে ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপের ৪ মাস আগে ইংল্যান্ডে এক প্রদর্শনী থেকে ট্রফিটি চুরি হয়ে যায়। সাতদিন পর ট্রফিটি উদ্ধার করা হয়। এরপর থেকে চুরি ঠেকাতে প্রদর্শনীতে রেপ্লিকা ট্রফি ব্যবহার করা হয়। ১৯৭০ সালে মেঙিকোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের নবম আসরে চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল তৃতীয়বার বিশ্বসেরা হওয়ার পর স্থায়ীভাবে জুলে রিমে ট্রফি তাদেরকে দিয়ে দেয়া হয়। যদিও সেলেসাওদের কাছে থেকে ১৯৮৩ সালে ফের এই ট্রফি খোয়া যায়। ব্রাজিলকে জুলে রিমে ট্রফি স্থায়ীভাবে দেয়ার পর ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপের নতুন ট্রফি উন্মোচন করা হয়। ফ্রেঞ্চ ভাস্কর আবেল লেফলয়োর দ্বারা ডিজাইন করা এই ট্রফিতে প্রাচীন গ্রিক পুরাণের বিজয়ের দেবীকে চিত্রায়িত করা হয়েছিল যাকে কিনা একটি দশ কোণা বিশিষ্ট কাপ হাতে দেখা যায়। এই অনন্য শিল্পটির ওজন ছিল ৩.৮ কেজি, এটি সোনায় মোড়ানো রূপা দিয়ে তৈরি ছিল এবং লাপিস লাযুলির ভিতের উপর দাঁড় করানো ছিল। তাই এই ট্রফি ‘সোনালি দেবী’ বলে নামেও লোকমুখে পরিচিত ছিল। কাপটির নিচের দিকের সোনালি ফলকের চারদিকে ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বিশ্বকাপজয়ী দেশগুলোর নাম খোদাই করা হয়েছিল। দেশগুলো ছিল : উরুগুয়ে (১৯৩০, ১৯৫০), ইতালি (১৯৩৪, ১৯৩৮), জার্মানি (১৯৫৪), ইংল্যান্ড (১৯৬৬) এবং ব্রাজিল (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০)। ১৯৭০ সালের জুনে মেঙিকোতে তাদের ৩য় ফিফা বিশ্বকাপ জয়ের দরুণ ব্রাজিল দল তৎকালীন ফিফা নিয়মানুসারে জুলে রিমে কাপ আজীবনের মত নিজ দেশে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
১৯৭৪ সালে নতুন বিশ্বকাপ ট্রফির প্রথম ব্যবহার হয়। সেবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল জার্মানি। এরপর থেকে স্থায়ীভাবে কোনো দেশকেই বিশ্বকাপ ট্রফি দেয়া হয় না। চার বছর শুধু বিশ্বকাপ ট্রফি নিজেদের কাছে রাখতে পারে কোনো দেশ। এরপর শিরোপাজয়ী দলকে দেয়া হয় একটি রেপ্লিকা।
ফুটবলার এবং ফুটবলপ্রেমী সবার কাছেই ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ট্রফি অন্যান্য ট্রফির তুলনায় একটি ভিন্ন মাত্রার নান্দনিক শিল্প। ফুটবলের সর্বসেরা এই ট্রফির সমৃদ্ধ রূপকথা আর পৌরাণিকতা ক্রীড়াবিদদের অতিমানবীয় কীর্তির ক্ষেত্রে সর্বদা অনুপ্রাণিত করে।
জুলে রিমে কাপ (প্রকৃত অর্থে যার নাম দেয়া হয়েছিল ইংরেজিতে ‘ভিক্টরি’) ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ীদের প্রদান করা হত। ফিফা ইতিহাসের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে ১৯২৯ সালে প্রথম কোনো আন্ত:দেশীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের পক্ষে ভোট প্রদান করেছিলেন। তার এক বছর পরই তিনি বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের হাতে ট্রফি তুলে দিতে সমর্থ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জুলে রিমের স্মরণেই এই ট্রফির নামকরণ করা হয় জুলে রিমে কাপ। জুলে রিমের নামে এই কাপটির নামকরণ অনেকটাই যুক্তিযুক্ত ছিল কারণ ফিফার ইতিহাসের তৃতীয় এই প্রেসিডেন্ট ১৯২১ সাল থেকে প্রায় ৩৩ বছর যাবত দায়িত্ব পালন করে গিয়েছিলেন। প্রথম আন্ত:দেশীয় ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য বিশ্ব জুলে রিমের কাছেই সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকবে। তিনিই বিভিন্ন দেশের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, ফুটবল সংস্থা এবং জাতীয় দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরি করে এই প্রতিযোগিতা আয়োজনের দায়ভার নেন, যা ছিল তখনকার সময়ে অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালীন চার বছর অন্তর বিশ্বকাপ আয়োজন এবং ফিফা সংস্থাটিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে তিনি সারা পৃথিবীতে ফুটবলের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। যখন জুলে রিমে অবসর নেন তখন ফিফার মোট সদস্য দাঁড়ায় ৫৬ টি দেশ যা ১৯২০ সালের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন দেশের কাছে এই ট্রফিটি থাকতো পরবর্তী বিশ্বকাপ মূল পর্বের ড্র না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু এখন আর এমনটি করা হয় না। বর্তমান ফিফার নিয়মানুযায়ী, প্রতি বিশ্বকাপের জয়ী দল একটি সোনার আবরণে মোড়ানো ব্রোঞ্জের রেপ্লিকা পুরস্কার হিসেবে পেয়ে থাকে। আসল ফুটবল ট্রফিটি ২০১৬ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখের ফিফা ওয়ার্ল্ড ফুটবল মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। আর এভাবে জুলে রিমে কাপ থেকে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল। অনেক ইতিহাস জড়িত বিশ্বকাপে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশৈশব ক্যান্সার ও পলিথিন বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান
পরবর্তী নিবন্ধপ্রধানমন্ত্রীর জনসভা প্রমাণ করবে জনগণের জন্য রাজনীতি করে আওয়ামী লীগ