জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

কুরআন সুন্নাহর আলোকে হায়াতুন্নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

পবিত্র কুরআনের আলোকে হায়াতুন্নবী
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন, আল্লাহর নির্দেশিত নবীজির প্রদর্শিত দ্বীনের পথে যারা নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন সেই সৌভাগ্যবান শহীদদেরকে আল্লাহ্‌ পবিত্র কুরআনে জীবিত বলেছেন। শহীদগণ চিরস্থায়ী জীবনের অধিকারী। আল্লাহ্‌ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, হে মু’মিনগণ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে যারা নিহত হয় তোমরা তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত, অথচ তোমরা উপলব্ধি করতে পারছনা। (সূরা বাকারা: আয়াত-১৫৪)
আল্লাহ্‌ তা‘আলা আরো এরশাদ করেছেন, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত বলে ধারণাও করোনা, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক্বপ্রাপ্ত। (সূরা-৩, আল-ই-ইমরান, পারা:৪, আয়াত-১৬৯)

নবী রাসূলগণ কবরে জীবিত থাকার বিষয়টি উত্তমভাবে সাব্যস্ত। আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত অনুগ্রহভাজন চারশ্রেণির প্রিয়বান্দার মর্যাদার কথা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, ‘এবং যে আল্লাহ্‌ ও রসূলের নির্দেশ মান্য করে তবে সে তাদেরই সঙ্গ লাভ করবে যাদের উপর আল্লাহ্‌ অনুগ্রহ করেছেন, নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ ও সালেহীন তথা সত্যপরায়ণ ব্যক্তিগণ, এরা কতই উত্তম সঙ্গী। (সূরা নিসা, আয়াত-৬৯)
শহীদগণ তৃতীয় স্তরের মর্যাদা প্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের জীবিত থাকাটা যেহেতু আয়াত দ্বারা প্রমাণিত ও সাব্যস্ত। সুতরাং আরো সুস্পষ্ট ও সমুজ্জ্বলরূপে প্রমাণিত যে, নবী রসূলগণের হায়াত সমস্ত শহীদদের হায়াত থেকে আরো উত্তম ও উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন। এ প্রসঙ্গে ইমাম শিহাব উদ্দীন খাফাজী রহ. বর্ণনা করেন, আম্বিয়ায়ে কেরাম ও শোহাদায়ে কেরাম উভয়ই জীবিত। নবীগণের হায়াত শহীদগণের হায়াত থেকে অনেক উচু মর্যাদাসম্পন্ন। নবীগণের দেহ মোবারক গ্রাস করার ক্ষমতা মাটিকে দেওয়া হয়নি। তাঁদের অবস্থা শয়নকারীদের মত। (সীরাতুল মুস্তফা, ৩য় খন্ড, পৃ. ২৪৪)
হাদীসের আলোকে হায়াতুন্নবী
হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের উত্তম দিবস হলো জুমু‘আর দিবস। কেননা এ দিবসে হযরত আদম আলায়হিস্‌ সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনে তাঁর প্রাণ কব্জ করা হয়েছে, এ দিনেই কিয়ামত হবে। অতএব, তোমরা অধিক পরিমাণে আমার উপর এ দিবসে দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের দরুদসমূহ আমার নিকট পেশ করা হয়। নবীজিকে জিজ্ঞেস করা হলো কীভাবে আপনার উপর দরুদ পেশ করা হবে অথচ আপনি তো মাটিতে মিশে যাবেন? রাবী বলেন, তারা তো বলতেই থাকে যে, ইন্তিকালের পর আপনার দেহ মাটির সাথে মিশে যাবে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তা‘আলা আম্বিয়ায়ে কেরামের দেহ গ্রাস করা মাটির উপর হারাম করে দিয়েছেন। (ইবনে মাযাহ্‌ শরীফ, পৃ. ৭৬, মুসনাদে বাযযার, ২য় খন্ড,পৃ:১৭)
কুরআন, সুন্নাহ্‌, এজমা কিয়াসের আলোকে দলীল চতুষ্টয় ইসলামী শরীয়্যার প্রমাণ্য দলীল। ‘হায়াতুন্নবী’ বিষয়টি কুরআন সুন্নাহর অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য দলীলাদির ভিত্তিতে প্রমাণিত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসলামের চূড়ান্ত মীমাংসিত ও প্রমাণিত বিষয়কেও বর্তমানে একশ্রেণির তথাকথিত ইসলাম নামধারী কুরআন সুন্নাহর অপব্যাখ্যাকারী বিভ্রান্ত পথভ্রষ্ট লোকেরা হায়াতুন্নবী বিষয়কে অস্বীকার করে যাচ্ছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা মতে আম্বিয়ায়ে কেরাম ইন্তেকালের পরও কবরের জগতে রওজা শরীফে জীবিত আছেন এবং ইবাদত বন্দেগীতে নিমগ্ন আছেন। তাঁদের কবরের জীবনটা রূহানী বা আত্মিক নয় নিঃসন্দেহে তাঁদের জীবনটা হলো দৈহিক জীবন।

হায়াতুন্নবী প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের আক্বিদা
হযরত শায়খ তাকী উদ্দিন রহ. বর্ণনা করেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মসজিদে নববী শরীফে যে ব্যক্তি উচ্চস্বরে কথা বলতেন তাকে সাবধান ও সতর্ক করে দিতেন। মসজিদে নববী শরীফের পাশেই রওজা শরীফে শায়িত আছেন নূরনবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। যে নূরানী দরবারের সম্মান ও আদব রক্ষা করা মু’মিনের ঈমানের পরিচায়ক, জীবদ্দশায় যেভাবে নবীজির সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা নিষেধ ছিলো, নবীজির ওফাতের পরও রওজা শরীফে পবিত্র দেহ ও রুহের সমন্বয়ে জীবিত আছেন, এ কারণেই হযরত সিদ্দিকে আকবর ও হযরত ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার পক্ষ থেকে উচ্চস্বরে আওয়াজকারী ব্যক্তিকে সাবধান করা হয়েছে তোমরা উচ্চস্বরে আওয়াজ করে নবীজিকে রওজা শরীফে কষ্ট দিচ্ছ। আল্লাহ্‌ তা‘আলা প্রিয় হাবীবের দরবারের আদব শিক্ষা দিয়ে আল কুরআনে এরশাদ করেছেন, হে মু’মিনগণ তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ করোনা। (সূরা হুজরাত: ৪৯:২)
হায়াতুন্নবী প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার আক্বিদা
উম্মুল মু’মিনীনদের আক্বিদা ছিল নবীজি রওজা শরীফে জীবিত আছেন। এ কারণে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা যখনই দেখতে পেতেন মসজিদে নববী সংলগ্ন কোথাও কোন পেরেক বা অন্য কিছু লাগানোর শব্দ যদি শুনতে পেতেন, সাথে সাথে তিনি নিষেধ করতেন, বলে দিতেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দিওনা। (শিফাউস্‌ সিকাম: পৃ. ১৫৪)

হায়াতুন্নবী প্রসঙ্গে ইমাম তকিউদ্দীন সুবকী (রহ.)’র অভিমত
শোহাদায়ে কেরামের হায়াত সম্পর্কিত অবতীর্ণ আয়াতগুলো পর্যালোচনা করে তিনি বলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আম্বিয়ায়ে কেরামের অবস্থা সকল শহীদগণের অবস্থা হতে অনেক উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন। শহীদগণের জন্য পূর্ণতা ও মর্যাদা অর্জিত হবে আর আম্বিয়ায়ে কেরামের জন্য অর্জিত হবে না তা হতে পারে না অসম্ভব। (শিফাউস্‌ সিকাম, পৃ. ১৪০)
ইমাম যুরকানীর অভিমত
আম্বিয়ায়ে কেরাম, শোহাদায়ে কেরাম, তাঁদের কবর শরীফে পানাহার করেন, নামায আদায় করেন, রোজা পালন করেন, হজ্ব আদায় করেন। (যুরকানী, আলাল মাওয়াহিব, ৫ম খন্ড, পৃ. ৩৩৩)
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, আমার দুনিয়াবি জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর আমার দুনিয়া থেকে পর্দা করা পরকালীন জীবনও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তোমাদের আমলসমূহ আমার নিকট পেশ করা হয়। যখন তোমাদের উত্তম আমল দেখি তার উপর আল্লাহর প্রশংসা করি। আর যখন মন্দ আমল দেখি, তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। (আ’লা খাযায়িনুল কুবরা, ২য় খন্ড, পৃ. ২৮১, যুরকানী, আল মাওয়াহিব, ৫ম খন্ড, পৃ. ৩৩৭)
ইমাম ইবনুল হাজ্বর মক্কী (র.)’ অভিমত
হায়াতুন্নবী প্রসঙ্গে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (রহ.) প্রণীত ‘আনোয়ারুল বাশারাহ্‌ ফী মাসায়িলিল হজ্বে ওয়াযযিয়ারাহ্‌’ কিতাবে ইমাম ইবনুল হাজ্ব মক্কী ও ইমাম আহমদ কুস্তুলানী বর্ণিত উদ্ধৃতি পেশ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পরের অবস্থা ও দুনিয়াবী জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সর্বাবস্থায় তিনি তাঁর উম্মতের সার্বিক অবস্থা দেখছেন পর্যবেক্ষণ করছেন, তাদের অবস্থাদি তাদের অন্তরের দৃঢ় সংকল্প, অন্তর জগতের অবস্থা তাঁর নিকট দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট, এতে কোন প্রকার অস্পষ্টতা নেই। (মাল মাদখাল: বৈরুত, ১ম খন্ড, পৃ. ২৫২)

হায়াতুন্নবী প্রসঙ্গে মোল্লা আলী কারী র.’র অভিমত
আম্বিয়ায়ে কেরাম ইহকাল থেকে পরকালে স্থানান্তরিত হন মাত্র, তিনি বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই আম্বিয়ায়ে কেরাম অন্যান্য জীবিতলোকদের মত মৃত্যুবরণ করেন না; বরং তাঁরা এক ক্ষণস্থায়ী জগত থেকে চিরস্থায়ী জগতে স্থানান্তরিত হয়ে থাকেন। (মিরকাত: ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪১)
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী হানাফী (রহ.)’র অভিমত :বিশ্ববিখ্যাত মুজতাহিদ ফক্বীহ্‌, আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী আল হানাফী বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই আম্বিয়া আলাইহিমুস্‌ সালাতু ওয়াস্‌ সালাম স্বীয় কবর সমূহে জীবিত আছেন। (শামী, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ১৫১)

নবীজি হায়াতুন্নবী হওয়ার কারণে নবীজির স্ত্রীদের বিবাহ্‌ করা জায়েয নয়। নবীজির স্ত্রীগণ ঈমানদারদের মা, এ কারণে তাদের বিবাহ্‌ করা হারাম, উপরন্তু নবীজি হায়াতুন্নবী এ কারণে আল্লামা কাযী সানাউল্লাহ্‌ পানিপথি (রহ.) বর্ণনা করেন, বরং আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবন শহীদদের জীবনের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। আর বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ অতীব সুদৃঢ়। এমনকি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সহধর্মিনীদের বিবাহ্‌ করা জায়েজ নেই। শহীদদের বিপরীত। (শহীদদের স্ত্রীগণকে বিবাহ্‌ করা জায়েজ)
হায়াতুন্নবী বলেই নবীজি উম্মতের দরুদ শরীফ শুনতে পান
হায়াতুন্নবী হওয়ার কারনেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীবের উপর সর্বাবস্থায় দরুদ শরীফ পাঠ করার নির্দেশ করেছেন, তাঁর প্রতি দরুদ ও উত্তমরূপে সালাম প্রেরণ করো। (আলকুরআন, সুরা আহযাব, ৩৩:৫৬)

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি আমার রওজা শরীফের নিকটে আমার উপর দরুদ শরীফ পাঠ করে আমি তা শ্রবণ করি। আর যে ব্যক্তি দুর থেকে আমার উপর দরুদ শরীফ পাঠ করে তা আমার নিকট পৌছানো হয়। (মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং: ৯৩৪)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে হায়াতুন্নবীর আক্বিদার উপর অটল অবিচল রাখুন। ইহকালে নবীজির যিয়ারত ও পরকালে নবীজির শাফায়াত নসীব করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোরআনের সফলতা ও শ্রেষ্ঠত্ব : একটি পর্যবেক্ষণ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে