কোরআনের সফলতা ও শ্রেষ্ঠত্ব : একটি পর্যবেক্ষণ

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

আল-কোরআন হচ্ছে মহাসফলতা ও চিরকল্যাণের অফুরন্ত ফল্গুধারা। মহান রাব্বুল আ’লামিন সূরা ফাতিরের ২৯ এবং ৩০ নং আয়াতে স্পষ্টভাবে বলছেন, ‘যারা আল্লাহ তায়ালার কিতাব পাঠ করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে, আমি তাদের যে রেযেক দিয়েছি তা থেকে যারা (আমারই উদ্দেশ্যে) গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে দান করে, (মূলত) তারা এমন এক ব্যবসার আশায় আছে যা কখনো ধ্বংস হবে না; (এর উদ্দেশ্য হচ্ছে,) তিনি যেন তাদের কাজের পুরোপুরি বিনিময় দিতে পারেন, নিজ অনুগ্রহে তিনি তাদের (পাওনা) আরো বাড়িয়ে দিতে পারেন; অবশ্যই তিনি ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী’। আর এই কোরআন শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানের উৎসমূল। সহীহ বোখারীতে বর্ণিত, ‘তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম, যে কোরআন নিজে শিখে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়’। সহীহ মুসলিম হাদীসে বর্ণিত, ‘এই কিতাবের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা বহু জাতির উত্থান ঘটান (অর্থাৎ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন করেন) আবার এই কিতাবের মাধ্যমে (অর্থাৎ এর নির্দেশ অমান্য করার কারণে) বহু জাতির পতন ঘটান’। মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে (মহাকালের দৃষ্টিতে যা ২৩ সেকেন্ডের সমান) কুরআন যে ইসলামী সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল, যে বিপ্লব ঘটিয়েছিল মানবসভ্যতার হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে এর কোন তুলনা পাওয়া যায়নি, যাবেও না কোনদিন। ১৭৭৯-১৭৮৪ সাল পর্যন্ত দুনিয়া ফরাসী বিপ্লব দেখেছে, ১৭৩৮ থেকে প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত বৃটেনে শিল্প বিপ্লব সাধিত হয়েছে, ১৯১৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় কম্যুনিষ্ট বিপ্লব ঘটেছে; কিন্তু এসব কোন বিপ্লবই সমস্যার স্থায়ী কোন সমাধান দিতে পারেনি। একটি সমস্যার সমাধান দিতে গিয়ে আরো ৫টি সমস্যার জন্ম দিয়েছে।

এসব বিপ্লবের ফলে যে সব মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়েছিল কিছুদিন পরই তা বহুলাংশে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু কুরআন যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম দিয়েছিল তা আজও শাশ্বত, সত্য। সে সকল মূল্যবোধ চিরঞ্জীব এবং সেই সকল মূল্যবোধের মাধ্যমেই দুনিয়ার সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব। উদাহরণস্বরূপঃ পাশ্চাত্যের কথাই ধরা যেতে পারে। এটা স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে, পাশ্চাত্য মানবগোষ্ঠী তাদের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সমস্যার অনেকটা সমাধান দিয়েছে। কিন্তু সেই সমাধান দিতে পারেনি যা ইসলাম দিয়েছিল। লন্ডন শহরে একদিকে দেখা গেছে সম্পদের প্রাচূর্য। কিন্তু অপরদিকে Oxford Street এবং Piccadilly Circus এর মত বিলাসবহুল এলাকায়ও দেখা গেছে মানুষের ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খেতে। পাশ্চাত্যে সামাজিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটেছে তা সত্যিই হৃদয়বিদারক। মানুষের মনে নেই শান্তি। ঘরে ফ্রিজ ভর্তি খাবার আছে তারপরও মানুষ হতাশায় ভোগে, আত্নহত্যা করছে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে শুধু যে জন্ম নিচ্ছে গনোরিয়া, সিফিলিস এবং হালজামানার এইডস- শুধু তা নয়, বরং যৌনাচার থেকেই সংঘটিত হচ্ছে শতকরা ৮৫ ভাগ অপরাধ। এমনিভাবে কুরআন বিবর্জিত সভ্যতা জন্ম দিয়েছে হাজারো সমস্যার। পাশ্চাত্যের নগ্নতা আজ যে সকল সামাজিক সমস্যার জন্ম দিয়েছে, তাদের তথাকথিত মূল্যবোধ যেভাবে তাদেরকে সমস্যার বেড়াজালে আবৃত রেখেছে তাদের এ থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় নেই। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে হেদায়াতগ্রন্থ আল্‌-কোরআনই একমাত্র অবলম্বন এই দুর্ভাগা জাতির জন্য। এই কোরআন আত্নশুদ্ধির এক মহৌষধ। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনুল করীমের বনী ইসরাঈল এর ৮২ নাম্বার আয়াতে বলছেন, ‘আমি অবতীর্ণ করি কোরআন, যা মু’মিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমাত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’।

এই আয়াতের ব্যাখায় তাফসীর ইবনে কাসীরে এসেছে, যে কিতাবে সন্দেহের লেশমাত্র নেই, মহান আল্লাহ তাঁর সেই কিতাব সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, এই কিতাব অর্থাৎ কুরআন ঈমানদারদের অন্তরের রোগসমূহের জন্য উপশমস্বরূপ। সন্দেহ, কপটতা, শির্‌ক, বক্রতা, মিথ্যার সংযোগ ইত্যাদি সব কিছু এর মাধ্যমে বিদূরিত হয়। ঈমান, হিকমাত, কল্যাণ, করুণা, সৎকাজের প্রতি উৎসাহ ইত্যাদি এর দ্বারা লাভ করা যায়। যে কেহই এর উপর ঈমান আনবে, একে সত্য মনে করে এর অনুসরণ করবে, এ কুরআন তাকে আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে দাঁড় করিয়ে দিবে। পক্ষান্তরে যে অত্যাচারী হবে এবং একে অস্বীকার করবে সে আল্লাহর রাহমাত থেকে দূরে সরে পড়বে। কুরআন পাঠ শুনে তার কুফরী আরও বেড়ে যাবে। সুতরাং এই বিপদ স্বয়ং কাফিরের পক্ষ থেকে তার কুফরীর কারণেই ঘটে থাকে।, কুরআনের পক্ষ থেকে নয়। এতো সরাসরি রাহমাত ও প্রশান্তি। সূরা হা-মীম আস সাজদাহ এর ৪৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘বলঃ মু’মিনদের জন্য ইহা (কুরআন) পথ নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধত্ব। তারা এমন যে, যেন তাদেরকে আহবান করা হয় বহু দূর হতে’। সূরা তাওবার ১২৪ ও ১২৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ করা হয় তখন কেহ কেহ বলে, তোমাদের মধ্যে এই সূরা কার ঈমান বৃদ্ধি করল? অবশ্যই যে সব লোক ঈমান এনেছে, এই সূরা তাদের ঈমানকে বর্ধিত করেছে এবং তারাই আনন্দ লাভ করেছে। আর যাদের অন্তরসমূহে রোগ রয়েছে, এই সূরা তাদের মধ্যে তাদের কলুষতার সাথে আরও কলুষতা বর্ধিত করেছে, আর তাদের কুফরী অবস্থায়ই মৃত্যু হয়েছে’। হযরত কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, ‘মু’মিন এই পবিত্র কিতাব শুনে উপকার লাভ করে। সে একে মুখস্থ করে এবং মনে গেঁথে রাখে। আর অবিশ্বাসী কাফির এর দ্বারা কোন উপকারও পায় না, একে মুখস্থও করে না, এর রক্ষণাবেক্ষণও করে না। আল্লাহ একে উপশম ও রাহমাত বানিয়েছেন শুধুমাত্র মুমিনদের জন্য। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘লোহায় যেমন মরচে পড়ে, তেমনি মানব হৃদয়েও মরচে পড়ে। জিজ্ঞেস করা হল: তা পরিষ্কার করার উপায় কি? রাসূল (সাঃ) বললেন, কুরআন তিলাওয়াত এবং মৃত্যুর স্মরণ।

লেখক: সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃতির উদারতার মাঝে নিজেকে হারাতে চাই
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা