দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ২১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

করোনা ও ইউক্রেন লড়াইয়ে বদলে গেছে দুনিয়া, সাবধান হতে হবে

রাশিয়া ইউক্রেনের অসম লড়াই করোনা পরবর্তী পৃথিবীকে কতটা বিপাকে ফেলেছে তা এখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। দুনিয়ার এক প্রান্তে সর্বসুখ বলে যাদের বিশ্বাস তারা সেসব দেশে আসলেই বুঝতেন কথাটা এখন আর সত্য নয়। সিডনিতে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া মানুষকে বেজায় মন্দ পরিস্থিতিতে ফেলে রেখেছে। কিভাবে কখন এর থেকে পরিত্রাণ মিলবে কেউ বলতে পারে না। তবে এটা মানতেই হবে এসব দেশে সরকার রাষ্ট্র সঠিক ভাবে পাশে দাঁড়ায় বলে মানুষের কষ্ট লাঘব হয় । মানুষ খেয়ে পরে বাঁচতে পারে।

আমাদের দেশে এই যুদ্ধ যে আঘাত হানবে এটাই স্বাভাবিক। আজ এটা স্পষ্ট সরকার কি বিরোধী দল যে যাই বলুক মানুষ কষ্টে আছে। এক শ্রেণির আঙুল ফুলে কলাগাছে ব্যতীত সবাই এখন টানাটানিতে। বিশেষত মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্তের হাল নাজুক। বলাবাহুল্য বোঝার ওপর শাকের আটি রোহিঙ্গারা তৈরী করেছে আর প্রতিকূলতা। ওরা যখন দলে দলে আসছিল তখন যে তীব্র আবেগ আর অনুভূতি তখন আমরা সাবধান করলেও কেউ তা শুনতে চান নি। বরং সমালোচক বলে আমাদের দিকে আঙুল তোলা হয়েছিল। একবেলা খেয়ে তাদের খাওয়ানোর আবেগ এখন উধাও। কিভাবে তাদের ফেরত পাঠানো যায় সে আলোচনাই এখন সবাই করছেন। কিন্তু ইটস টু লেইট। খেয়াল করবেন আন্তর্জাতিক ফোরামে এমন কোন কথা উঠলেই সীমান্তে গন্ডগোল শুরু হয়ে যায়। রোহিঙ্গারা যে দেশ থেকে এসেছে সে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কথায় কাবু হবার কেউ নয়। তারা যদি না নেয় এরা ফেরত যাবে না। আর এ ফাঁকেই সমস্যা আরো গভীর আর মারাত্মক হয়ে উঠবে। যার কিছু নমুনা এখন স্পষ্ট।

বলছিলাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দাম বাড়ার কথা। তেল খাবার ঔষধ সহ বহু প্রয়োজনীয় জিনিস এখন ক্রমেই দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠ্‌েছ। খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব বলছেন সামনে না কি কঠিন সময়। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে কৃচ্ছতা সাধনের বিকল্প নাই। সে কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ বলেন না। মানেনও না। বিলাসিতা বা ব্যয়ের সময় এটা না। বুঝতে হবে দুনিয়া এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে কেউ কারো জন্য কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না । সাহায্য সহযোগিতা হয়তো চলবে তবে তা হবে অপ্রতুল । কাজেই আমাদের দেশ ও জনগণকে স্বাবলম্বী হবার পাশাপাশি মিতব্যয়ী হতেই হবে।

বাংলাদেশে, আন্তরিকতা আর বিলাসিতা সমার্থক হয়ে গেছে। যার কারণ রাজনীতি। রাজনীতি যখন টাকা আর পেশী নির্ভর হয়ে যায় তখন তার মাত্রাজ্ঞান থাকে না। আওয়ামী লীগের বিগত আমলে যেটুকু নৈতিকতা ছিল এখন তার ছিটেফোঁটাও নাই। কারণ এখন এই দলে, দলে দলে অনুপ্রবেশকারী। তারা ঢুকছে কিসের জোরে? টাকার জোরে। আর এই টাকা কি হাওয়ায় ওড়ে না গাছ থেকে পড়ে? সবাই এটা বুঝে গেছেন টাকা না থাকলে দাম নাই। আর জায়গা করে নিতে হলে টাকা লাগে। খেয়ে না খেয়ে যারা টাকার পেছনে ছুটছেন তাদের গল্প গুলো উন্নত দেশের মানুষদেরও ভয় ধরিয়ে দেয়। সমপ্রতি সিডনি বেরিয়ে যাওয়া এক পাতি নেতা বলছিল তার কাছে টাকা কোন ব্যাপার না। এদেশের মিলিয়ন ডলারের বাড়ি না কি সে চাইলেই কিনে নিতে পারে। হয়তো পারে। ভাগ্য ভালো এসব দেশে অভিবাসনহীন এমন কাউকে বাড়িঘর কিনতে দেয়া হয় না। কিন্তু বিষয়টা ভাবুন যার কোন নির্দিষ্ট চাকরী নাই ব্যবসা ও কি করেন বোঝা মুশকিল তার যদি এমন দাপট হয় তো বাকীদের কি হাল? আজকাল সিডনি বা লাস ভেগাসের ক্যাসিনোয় জুয়া খেলতে আসা বাংলাদেশীদের দাপটে অজি বা আমেরিকানরা ও থ বনে যায়। এই যে কালো টাকার জোয়ার এর সাথে সাধারণ মানুষের ভাগ্য জড়িত। এমন ধারা অব্যাহত থাকলে সরকার কি বাজার সামাল দিতে পারবেন?

আন্তর্জাতিক বাজার এখন ত্রাহি ত্রাহি জপতে ব্যস্ত। সরকারগুলো আগাম হিসেব নিকেশ করে রাখছে কিভাবে তাদের নাগরিকদের সাহায্য করা যায়। এমন হয়তো হবে না যে দেশগুলো রাস্তায় বসে যাবে। তার বড় উদাহরণ শ্রীলংকা। তাদের ভাবমূর্তি বা আর্থিক স্তরের অবনতি হলেও দেশ ধ্বংস হয়ে যায় নি। বরং সমপ্রতি বলা হয়েছে শ্রীলংকা উন্নয়নশীল থাকবে তবে উন্নত বলা যাবে না। একধাপ দু ধাপ পিছালেও তাদের জনগণ আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। মনে রাখা ভালো মানুষের হাতে টাকা না থাকলে তারা খাবার কিনবে পোশাক কিনবে না । ফলে পোশাক শিল্পের আয় কমবে। কমবে আরো নানা খাতে রপ্তানী। যারা রক্ত পানি করা টাকা বিদেশ থেকে দেশে পাঠায় তাদের এই টাকার নাম রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্সে টান পড়লে বাংলাদেশের মূল জায়গায় টান পড়বে।

এপর্যন্ত যেটুকু শক্তি আর ভরসা তার মূল কিন্তু ঐ খাত। বিদেশের অর্থনীতি নাজুক বা মন্দা হলে দেশে টাকা যাবে না । যোগান কমে যাবে। তখন কাঁদলেও রেমিট্যান্স বাড়ানো সম্ভব হবে না। এ জন্যই বলা হয় রিজার্ভ ফান্ড। যা ভবিষ্যতের জন্য জমানো থাকে। সে জমানো টাকা দেদারসে খরচ করে রাজনৈতিক বা দলীয় উৎসব করলে প্রমাদ গুণতে হবে। এ কারনেই অনেক কিছু কাটছাঁট করার বিকল্প নাই। বলাবাহুল্য সরকারের দায় সবার আগে। বিরোধী দলগুলি মানুষের কথা ভাবে বলে মনে হয় না। দেশশাসন থেকে সরকারকে হঠানো আর নিজেরা সে জায়গা দখল করা ছাড়া তাদের আর কোন ভাবনা নাই। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংসের মুখে। এটা বড় ভয়ের জায়গা তৈরী করে রাখছে। কারণ এরাই সমাজের সেইফগার্ড। আপদে বিপদে তাদের ভূমিকা মানুষকে আগলে রাখা। পথ দেখানো। রাজনীতিকরণ আর লুটপাট চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যত অনিরাপদই থাকবে ।

একজন প্রবাসী বাংলাদেশী হিসেবে আমার দুর্ভাবনার জায়গা ঐখানে সীমাবদ্ধ। সম্ভাবনার মূল জায়গাটা মানুষ। বাংলাদেশের মেহনতী মানুষ সত্তর দশক আশির দশকের কঠিন সময় পার করেছে অটুট মনোবল আর নিজেদের প্রাণশক্তির ওপর ভরে করে। আজকেও তারা পিছিয়ে থাকবে না। কিন্তু মনে রাখা ভালো রোহিঙ্গা সমস্যার মতো আবেগ সর্বস্ব সমস্যা আর লুন্ঠনের মতো সামাজিক ব্যাধির প্রতিকার চাই। তা না হলে কোনকিছুই কাজ করবে না। বিশ্ব ব্যাপী যে ভাবনা দুর্ভাবনা বা সমস্যার গভীরে যাবার চেষ্টা তা অনুধাবন করার ভেতরেই আছে সমাধান। মুখের কথা বা ভাষণে কাজ হবে না। সামাজিক মিডিয়ার সুফল যেমন অজস্র তেমনি কুফল হচ্ছে ভ্রান্তি। প্রচার অপপ্রচারে যে ভ্রান্তিবিলাস তৈরী হয় তা থেকে মুক্ত থেকে নিজেদের ভবিষ্যত নির্মাণ জরুরি।

রাজনীতি পারবে বলে মনে হয় না। পারতে হবে মানুষকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বকে সামনে রেখে জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে তা সম্ভব। আর সম্ভব সুষ্ঠু গণতন্ত্র আর সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত হলে। কঠিন সময় মোকাবেলা করার জন্য চাই পরিকল্পনা আর তার যথাযথ প্রয়োগ। তাহলেই ভয় ফিকে হয়ে আসবে। মানুষ বাঁচবে মানুষের মনের আনন্দে।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রাকৃত