প্রাকৃত

আবু মুসা চৌধুরী | শুক্রবার , ২১ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

আমার বোগেনভেলিয়ার চিকন পাতলা ডাল ঠোঁটের তীক্ষ্ণ কারুকাজে ছিঁড়ে, এবং নানা জায়গা থেকে আরো কতো কিছু যোগাড় করে, ঝুলবারান্দার গ্রিলের জালি ঘেঁষে, হাত-ছোঁয়া দূরত্বে ওদের নীড় রচনা শুরু। আর এই মহতী কর্মকাণ্ডে পুরুষটির নিষ্ঠা ও তৎপরতাও ব্যাপক। আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই কর্তাটির।
আমার স্ত্রী দেখে অবাক। বলে, ‘এ্যাই, দেখো, দেখো- আমার বাগানবিলাসে তোমার কাক দু’টো বাসা বানাচ্ছে।’

বললাম, ‘ভালোই তো। ওরা আমাদের বিশ্বাস করেছে, ভরসা রেখেছে, আস্থায় এনেছে, তাই নির্ভয়ে ডিম্ব পাড়ার ব্যবস্থা করছে। তোমার অসুবিধা কী ?’
ছেলেমেয়েদের বারণ করে দিলাম- ‘খবরদার, ওদের ডিস্টার্ব করবে না একটুও।’
০২.
ধীরে ধীরে বায়সদম্পতির মধুর মিলনের ফসল উৎপাদনের মৌসুমি ঠিকানা চমৎকারভাবে সৃজিত হলো।
০৩.
একদিন বউ লাঠি নিয়ে চিৎকার করে ওঠে- ‘এই, তোরা আমার ফুলগাছ নষ্ট করছিস, আজ তোদের একদিন কী আমার একদিন…..’
ওমা, কোত্থেকে কুচকুচির পতি টিঙটিঙে কুচকুচ বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রিলের ফোঁকর দিয়ে ঢুকে পড়তে চায় ভেতরে। তারস্বরে চেঁচাতে থাকে- ক্রা, ক্রা, ক্রা…
গগনবিদারী আর্তনাদে ওর সমস্ত জ্ঞাতি-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব এসে জড়ো হয়। চিৎকার, চেঁচামেচি, হট্টগোলে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
আমি বউয়ের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে আদুরে গলায় বলি, ‘এতো নিষ্ঠুর হচ্ছো কেন ? যাও তুমি, আমি ওদের বুঝিয়ে বলছি। তোমার বোগেনভেলিয়া আর নষ্ট করবে না।’

‘তোমার কথা ওইগুলো শুনবে ? আর, তুমি কি ওদের সঙ্গে কথা বলো নাকি ?’
আল মাহমুদের কবিতাটা শোনো…
‘একবার পাখিদের ভাষাটা যদি
শেখাতেন সোলেমান পয়গম্বর।
জানতাম পাতাদের আড়ালে তারা
খড় দিয়ে কেন গড়ে ঘর সুন্দর ;
সোলেমান নবী পশু-পাখিদের ভাষা বুঝতে পারতেন। আমিও পারি কিছু কিছু।’
বউ দৃষ্টিতে আমাকে ভস্ম করে রান্নাঘরে চলে যায়।
আমি কুচকুচ আর কুচকুচিকে বলি- ‘তোদের এখন ক্রুশিয়াল টাইম। ভাইল দিয়ে চলতে হবে। তোদের মা-জননীকে খেপাস না। তাহলেই সর্বনাশ। আর আমি তো আছি। নো টেনশন। তোদের সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া চালিয়ে যা….
ওরা আশ্বস্ত হয়। মধুর স্বরে কা কা করে আমায় ধন্যবাদ জানায়।

০৪.
কাক দু’টির সঙ্গে আমার ভাব দীর্ঘদিনের। খাওয়ার পর কাঁটা ও হাড্ডি-গুড্ডি ঝুলবারান্দার গ্রিলের ফাঁকে রেখে দিতাম।
কাকগুলো ছুটে এসে ক্ষুধা নিবারণ করতো। ক’দিন পর খেয়াল করলাম- আমার প্রাতঃরাশ বা দ্বিপ্রাহরিক আহারের সময় ওগুলো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নারকেল গাছের ওপর কিংবা পার্শ্ববর্তী দালানের কার্নিশে। উচ্ছিষ্ট দেওয়ার পর সে কী কাড়াকাড়ি, ঝগড়া, মারামারি। কিছুতেই নিবৃত্ত করা যায় না। আমিও চালাকি করে দুর্বলগুলোর জন্য আলাদা রেখে দিতাম।
ব্যপারটা আমাদের প্রাত্যহিক রুটিনে পরিণত হলো। রাতের আহারের কাঁটা বা যথাস্থানে হাড় যথারীতি রেখে দিতাম। সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখতাম- ওই, আমার দেয়া উপহার সম্পূর্ণ সাবাড়।

এর মধ্যে দু’টো কাক আমার বেশ ন্যাওটা হয়ে ওঠে। সময় নেই, অসময় নেই; এসেই ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। বলে- ‘খিদে পেয়েছে। খাবার দাও।’ আমি বলি, ‘কোত্থেকে দেবো ?’

ওরা কাঁদে। চেঁচায়। আমার পত্রিকা পাঠ বা লেখালেখি বিঘ্ন ঘটে। ভেতর থেকে বউয়ের চোখ এড়িয়ে রুটি বা বিস্কিট এনে দেওয়ার পর, কাঙাল দু’টো শান্ত হয়।
আমার ওই কাক দু’টোর নামকরণ করেছি অনেক চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার পর। কুচকুচ আর কুচকুচি। কী যে মসৃণ কৃষ্ণবর্ণ ওদের পালকের রূপ- জেল্লা বেরিয়ে আসতে চায়। চেহারাও বড়ো মায়াময়।

ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর ওদের ভাষাটা আয়ত্ত করার চেষ্টা করি। কিঞ্চিৎ সফলও হয়েছি।
খাবার দেওয়ার সময়, দূর নারকেল গাছে বসে থাকা ওরা মিগ বিমানের মতো বিদ্যুৎবেগে চোখের পলকে এসে যায়। আর ওগুলোর এমন শ্যান দৃষ্টি- এতো দূর থেকে ওই খাবারের সামান্য খণ্ডাংশের ছোট্ট টুকরোও কীভাবে যে দেখতে পায়!
ধাড়িগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমার কুচকুচ আর কুচকুচি সুবিধে করতে পারে না। ওরা খাবারের কাছে এলেই ষণ্ডাগুলো ঠোঁট উঁচিয়ে-খুঁচিয়ে তাড়িয়ে দেয়। বুদ্ধি করে ওদের জন্যে আলাদাভাবে রেখে দিই।

০৫.
শীতের পর পরই আমার পোষা ওই কাক দম্পতির বিশেষ তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। বসন্ত আসে। প্রকৃতি ও মানুষের পাশাপাশি ওদের মনেও রঙ লাগে। বায়স-দম্পতি সৃজন করতে থাকে ওদের লেভার রুম।
ধীরে ধীরে কুচকুচির শরীর ভারী হতে থাকে। বেচারি সারাদিন বসে বসে ইতিউতি চায়। আর ওর পতিপ্রবর সজাগ প্রহরীর মতো আশপাশে ঘাপটি মেরে থাকে।
আমার বউ বারান্দায় টবে জল সিঞ্চনের জন্য এলেই ওদের অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। কুচকুচ হয়ে ওঠে মারমুখি। কুচকুচি উদ্বিগ্ন। বউকে বলি, ‘তোমাকে ওরা ভয় পায়। বিশ্বাস করতে পারছে না।’
আমি ওদের সুদৃশ্য ডিম দেখার প্রতীক্ষায় থাকি।

০৬.
দিন গড়িয়ে যায়। কুচকুচির এখন অধিক ভিটামিন, প্রোটিন প্রয়োজন। ওর ডায়েট বাড়িয়ে দিই। মজ্জাসহ হাড় এবং অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করতে থাকি। কিন্তু আশ্চর্য এখন সে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বেশ অনাগ্রহী। উদাসীন। অন্য কাক এসে ওকে দেওয়া খাবার লুটপাট করে খায়। কুচকুচি ফিরেও তাকায় না। বুঝলাম- আসন্ন মাতৃত্বের আনন্দে ও গৌরবে সে আচ্ছন্ন। ডিম্ব-সম্ভাব্য নাদুস-নুদুস ওই বেচারির সুদিনের প্রত্যাশিত সেই স্বর্ণালি ক্ষণটির জন্যে অধীর আগ্রহে আমার অপেক্ষা।
মাঝে মাঝে মনে প্রশ্নের উদয় হয়- আচ্ছা, পশু-পাখিদের জগতে কি সিজারিয়ান- এর প্রচলন রয়েছে ? সালিম আলি সহ আরো অনেকের বই-পত্র ঘেঁটেও এর কূল-কিনারা পাই না।

০৭.
চৈত্র ফুরিয়ে আসছে। বসন্ত বিদায়লগ্নে। গ্রীষ্মের আগমনী চারপাশে। কুচকুচি বসে বসে ওর সুদৃশ্য বাসায় তা দেয়। ঝিমোয়। আমি ঝুলবারান্দায় বসে কমলকুমার পড়ি। গান শুনি। বউয়ের সঙ্গে গল্প করি।

নববর্ষ সমাগত। এ বছর কালবৈশাখি হবে কি ? অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুক। আমার কাক দম্পতির পলকা বাসার কী হবে? কফির মগে চুমুক দিয়ে কান পেতে শুনি- ভেসে আসা- ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও…..।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে
পরবর্তী নিবন্ধকত উজির নাজিরের জীবন গেল, আড্ডা কিন্তু থামেনি