জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২২ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

সূরা আল মা‘উন’র শিক্ষা ও তাৎপর্য

সূরা আল মাঊন প্রসঙ্গ:
সূরা আল মাঊন মহা গ্রন্থ আল কুরআনের সূরাক্রম ১০৭, পারা ৩০, এতে রুকু সংখ্যা ০১, আয়াত সংখ্যা ০৭, শব্দ সংখ্যা ২৫, বর্ণ সংখ্যা ১২৫টি, সূরাটির প্রথমার্ধ মক্কী, শেষার্ধ মাদানী।
সূরার অনুবাদ:
১. আপনি কি দেখেছেন তাকে যে শেষ বিচারের দিনকে অস্বীকার করে; ২. সুতরাং সে হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দেয়; ৩. এবং মিসকীনকে খাদ্য দানে উৎসাহ দেয়না, ৪. সুতরাং দুর্ভোগ রয়েছে সেসব নামাযীর জন্য; ৫. যারা নিজেদের নামায থেকে ভুলে বসেছে; ৬. যারা লোক দেখানোর জন্য (ইবাদত) করে; ৭. এবং প্রয়োজনীয় ছোট খাটো সামগ্রী (অন্যদের) দিতে বারণ করে। (সূরা: আল মা‘ঊন, আয়াত: ১-৭)
সূরার আলোচ্য বিষয়:
১. কাফির ও মুনাফিকদের চরিত্রের বর্ণনা; ২. পরকালের প্রতিদান, প্রতিফল ও হিসাব নিকাশ অস্বীকারকারীদের বর্ণনা; ৩. ইয়াতীম, মিসকীনদের হক বিনষ্টকারীদের পরিণাম বর্ণনা; ৪. লোক দেখানো ইবাদতকারীদের শাস্তির বর্ণনা; ৫. মানুষের প্রতি অসহযোগিতামূলক আচরণের নিন্দা ও শাস্তির বর্ণনা।
সূরার শানে নুযুল:
প্রখ্যাত তাফসীর কার হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.)’র প্রণীত “তাফসীরে নুরুল ইরফানের” বর্ণনা মতে সূরাটির প্রথমার্ধ মক্কী, যা কাফির সর্দার আবু জাহ্‌ল অথবা আস ইবনে ওয়ায়েল প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। সূরাটির শেষার্ধ মাদানী যা মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই ইবনে সুলুল কপট মুনাফিক প্রমূখের আচরণ ও কর্মকান্ড প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। মক্কা মোকাররমায় যখন কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি মৃত্যুর সন্নিকট হতো আবু জাহ্‌ল সুযোগ বুঝে তার নিকট গিয়ে বলতো তোমার সন্তান সন্ততি ও ধন সম্পদ আমাদের দায়িত্বে সোপর্দ করে দাও। আমরা তোমার সন্তানের তত্ত্বাবধান প্রতিপালন, সুষ্ঠুভাবে করে যাব। মুমূর্ষু ব্যক্তিও কথা মতো সব সোপর্দ করে দিত। এরপর তারা মৃতব্যক্তির সম্পদ কুক্ষিগত করে সুকৌশলে সব কিছু গ্রাস করে ইয়াতীমদেরকে অধিকার বঞ্চিত করে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতো। একজন নির্যাতিত, ভূক্তভোগী, ইয়াতীম, নবীজির দরবারে হাজির হয়ে নিজের করুণ অবস্থা ব্যক্ত করলো, নবীজি ইয়াতীমটিকে নিয়ে তাদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, তোমাদের অন্তরে কি মহান আল্লাহ ও কিয়ামতের শাস্তির ভয় নেই? নবীজির বর্ণনা শুনে তারা কিয়ামত তথা পরকাল প্রসঙ্গে ঠাট্টা বিদ্রুপ শুরু করলো, এতে নবীজি ব্যথিত মন নিয়ে ফিরে এলেন, তখনই তাদের এহেন ঘৃণিত আচরণ ও কার্যকলাপ প্রসঙ্গে সূরার প্রথমাংশ নাযিল হলো। এতে ইয়াতীমদের প্রতি কাফির মুনাফিকদের আচরণ কতো নিষ্টুর ও নির্মম হতে পারে তা আলোচিত হয়েছে।
ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎকারী জাহান্নামী:
ইয়াতীমের অধিকার সুরক্ষায় কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য সতর্ক বাণী রয়েছে, অন্যায়ভাবে এতিমকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, ইয়াতীমের হক আত্মসাৎ করা, ইয়াতীমকে লাঞ্ছিত করা, অপমানিত করা, ইয়াতীমকে কষ্ট দেয়া, ইয়াতীমের প্রতি দুর্ব্যবহার করা ইয়াতীমের সাথে প্রতারণা করা ইত্যাদি নিকৃষ্ট আচরণ মূলত: দ্বীনের প্রতি অবিশ্বাস ও ইসলামের অনুশাসন তথা কুরআন সুন্নাহর বিধিমালাকে অস্বীকার করার শামিল। দ্বীনের প্রকৃত আদর্শ, শিক্ষা ও তাৎপর্য যারা অনুধাবন করে ধর্মীয় আদর্শিক ও মানবীয় গুণাবলী তাদের চরিত্রে বিকশিত হয়। মুসলমান হয়ে যারা ইয়াতীমের প্রতি অনীহা অবজ্ঞা অমনোযোগিতা ও অসহযোগিতামূলক মনোভাব যারা পোষণ করে তারা অভিশপ্ত। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করে তারা নিজেদের পেটে আগুন ভর্তি করছে এবং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের অগ্নিতে প্রবেশ করবে। (৪-সূরা, নিসা: ১০)
পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে, “ইয়াতীমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও, খারাপ মালের সাথে ভালো মালের রদ-বদল করো না, আর তাদের ধন-সম্পদ নিজেদের ধন-সম্পদের সাথে সংমিশ্রিত করে তা গ্রাস করো না। নিশ্চয় এটা বড়ই মন্দ কাজ। (সূরা: নিসা: ২)
নামাযের প্রতি আ’লস্য প্রদর্শনকারী কারা?
বর্ণিত সূরার ৫ নং আয়াতের তাৎপর্য প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করলেন, দুর্ভোগ সেই মুনাফিক নামাযীদের জন্য। যারা মানুষের সামনে হলে লোক দেখানোর জন্য নামায পড়ে কিন্তু একাকী হলে লোকচক্ষুর অন্তরালে গেলে আর নামাযের খবর থাকেনা। হযরত মাসরুক ও আবু যোহা (রা.) বর্ণনা করেন, নামায অবহেলা করার অর্থ হলো সময়মত নামায না পড়া। বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের বর্ণনায় বসে বসে সময় ক্ষেপণ করে সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় সন্নিকট হলে মোরগের ন্যায় চারটি ঠোকর মেরে নামায পড়াকে মুনাফিকের নামায হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, একাদশ খণ্ড, কৃত: আল্লামা ইবনে কাছীর (র.), পৃ: ৬০৪)
“তাফসীরে নূরাল ইরফানে” আয়াতের সংশ্লিষ্ট তাফসীরে উল্লেখ হয়েছে নামাযের প্রতি আলস্য প্রদর্শন করা বিভিন্নভাবে হতে পারে, লোক দেখানো মানসিকতা নিয়ে নামায আদায় করা, নামায কখনো না পড়া বা নিয়মিতভাবে না পড়া, সঠিক সময়ে না পড়া, অমনোযোগীতা ও বেপরোয়াভাবে নামায পড়া, যেমন হাতের আস্তিন তুলে দিয়ে রুমাল কাঁধ অথবা মাথার উপর থেকে ঝুলিয়ে ও জামার বোতাম খোলা রেখে নামায পড়া বেপরোয়া অলামত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। (তাফসীরে নূরুল ইরফান)
লোক দেখানো ইবাদত শিরকতুল্য:
ইসলাম নিহক প্রদর্শনীমূলক রীতিনীতি সর্বস্ব ধর্মের নাম নয় বরং পরম করুণাময় আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠা, একাগ্রচিত্ততা ও আত্ম-সমর্পণের নাম ইসলাম। যাদের আত্মা নামাযের রুহানিয়ত দ্বারা সঞ্জীবিত নয় তারা আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন থেকে বঞ্চিত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য নামায পড়ল সে শিরক করল। (মুসনাদে আহমদ)
আয়াতে মা‘উন শব্দের তাৎপর্য:
ব্যবহারের নিত্য প্রয়োজনীয় ছোটখাটো জিনিসকে মা‘উন বলা হয়। যেমন লবণ, আগুন, পানি, সূইচ, কোদাল, কুঠার, পাতিল ইত্যাদি। হযরত ইবনু আবু নাজীহ (র.) মুজাহিদ (র.) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আলী (র.) বলেন, মা‘উন অর্থ যাকাত। যেহেতু যাকাতের নগন্যতা বা স্বল্পতা হচ্ছে চল্লিশতম অংশ। উপরোক্ত বর্ণনার সারকথা হল উপকৃত হওয়ার সুযোগ দিয়ে অন্যজনের সহযোগিতা না করা। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, পৃ: ৬০৬)
মুনাফিকের চরিত্র হলো তারা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বা যে কোন প্রকার কল্যাণধর্মী সহযোগিতা বা আল্লাহর বান্দার উপকার সাধনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। মুনাফিকদের ইবাদতও নিস্ফল, পারস্পরিক লেনদেনেও অপরিচ্ছন্ন। হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! মানুষকে যে জিনিস প্রদান থেকে বিরত থাকা বা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হালাল নয় তা কি? নবীজি এরশাদ করেছেন পানি, আগুন, লবণ এগুলো তো মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস। হে আয়েশা যে ব্যক্তি কারো প্রয়োজনে আগুন দিল সে যেন তাকে পূর্ণ খাবার সাদকা করল, যে আগুন দ্বারা তা প্রস্তুত করেছে। (দিয়াশলাই এর অন্তর্ভুক্ত) যে কাউকে লবণ দান করেছে সে যেন পূর্ণ খাবার সাদকা করেছে, যে কাউকে পানি দান করেছে সে যেন প্রাণ সঞ্চার করেছে। [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, পারা: ৩০, পৃ: ১০৭৫ কৃত: আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসি (র.)]
মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে দ্বীনের মর্ম অনুধাবন ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ ইরফানুল হক
চন্দ্রঘোনা, রাঙ্গুনীয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: এক শ্রেণির মুসলমান কবরে, মাজারে ও পীরকে সিজদা করে থাকে, এ ব্যাপারে শরীয়তের বিধান জানতে চাই।
উত্তর: ইসলামী শরীয়তে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা করা শির্ক ও কুফরী। আর যদি কাউকে সম্মানার্থে সিজদা করা হয় তা নিশ্চিতভাবে হারাম ও কবীরা গুনাহ। (“আয্‌যুবদাতুয যাকিয়্যাহ ফী তাহরীমি সুজুদিত তাহিয়্যাহ,” পৃ: ২১, কৃত: ইমাম আহমদ রেযা, “আহকামে শরীয়ত,” খণ্ড:২য়, কৃত: ইমাম আহমদ রেযা, পৃ: ২৩৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আমি যদি কাউকে সিজদা করার আদেশ দিতাম তাহলে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম স্বামীকে সিজদা করার জন্য। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ১১৬০, মিশকাত শরীফ, হাদীস নং: ৩২৭০)
কবরে সিজদা করা হারাম, ইবাদতের নিয়্যতে হলে কুফরী (শরহে ফিকহ আকবর, পৃ: ২৩০, আনোয়ারুল হাদীস, পৃ: ২৪৯, কৃত: মুফতি জালাল উদ্দিন আমজাদী, রদ্দুল মুহতার, ৬/৩৮৩), নবীজি এরশাদ করেছেন সাবধান! তোমরা কবরকে সিজদার স্থান বানিও না। (মুসলিম হাদীস, ৫৩২), সম্মানার্থে কোন পীর, বুজুর্গ বা কবরে সিজদা করা হারাম ও কবীরা গুনাহ। এ সম্পর্কিত ইমাম আহমদ রেযা (র.) লিখিত “আযযুব্‌দাতুয যকীয়্যাহ” কিতাবটি প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য এতে কুরআনের অসংখ্য আয়াত ও চল্লিশটি হাদীস শরীফ ও মুজতাহিদ ফকীহ ও ইমামগণের দেড়শতাধিক দলিলের আলোকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা হারাম প্রমাণ করেছেন। পূর্ববর্তী নবীদের শরীয়তে তাজিমী সিজদা বৈধ ছিল, আমাদের শরীয়তে তা হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামে তাজিমী সিজদার পরিবর্তে পরস্পর সালাম বিনিময় করার নির্দেশ করা হয়েছে। (ইমাম আহমদ রেযা আওর রদ্দে বিদআত ওয়া মুনকিরাত, পৃ: ২৪৩, কৃত: আল্লামা ইয়াসিন আখতার মিসবাহী)

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলামের দৃষ্টিতে নিরাপদ সড়ক উপহার দেয়া আমাদের দায়িত্ব
পরবর্তী নিবন্ধতায়েফ : সবচেয়ে মজলুম যেখানে আমাদের বিশ্বনবী