তায়েফ : সবচেয়ে মজলুম যেখানে আমাদের বিশ্বনবী

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২২ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

তায়েফের গোলাপ কয়েকটি বিলাসবহুল সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কথিত আছে, তায়েফ শহরে যে তুর্কী দুর্গ রয়েছে তাতে ১৯১৭ সালে সংঘটিত আরবের লরেন্স যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের কবর পাওয়া যায়। আল্‌-হাদা হসপিটাল এবং আল্‌-হাদা পর্বতমালার উপরে শেরাটন হোটেল থেকে যে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায় তা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এখান থেকে তায়েফের অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতি উপলব্ধি করা যায় এবং সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়। আল্‌-সাফা নামক একটি ছোট্ট গ্রাম, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ থেকে ২৫০০ মিটার উঁচুতে সারওয়াত পর্বতমালার উপরে অবস্থিত। যে গ্রামটি কৃষিপণ্যে সমৃদ্ধ এবং ফলমূলের বাগানভর্তি গ্রামটি দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। তায়েফ এলাকাটি গ্রীষ্মের সময় তাপমাত্রা চরমে উঠে না, এটি বেশ শীতল এলাকা-বৃষ্টিপাত কম। থাকিফ উপজাতীয় লোকেরা এখনো তায়েফ শহর এবং তার আশেপাশের এলাকায় বসবাস করে। এখানে জন্মগ্রহণকারী লোকেরা জগদ্বিখ্যাত, যেমন: ইবনে ইউসুফ, যিনি উমাইয়া খিলাফতের ইরাকি গভর্ণর ছিলেন, সেনাপতি মোহাম্মদ বিন কাসিম, ইরাকের রাজা ফয়সল, নাঈফ বিন আবদুল আজিজ, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান বিন আফফান (রাঃ), উম্মে আল্‌-কোরআন বিশ্ববিদ্যালয় শরীয়া ফ্যাকাল্টির সদস্য হামিদ আল্‌-ওতাবি, ব্রুনেই দারুস্‌সালাম এর তৃতীয় সুলতান শরীফ আলী, প্রথম অটোমান সংবিধানের স্থপতি মি.পাশা, প্রথম সৌদি অলিম্পিক পদক বিজয়ী (১৯৭০) হাদি সোয়ান আল্‌-স্যামাইলি, আদ্দাস-অল্প বয়সী খৃষ্টান ক্রীতদাস ছেলে, তিনি তায়েফের পশ্চিম প্রদেশ থেকে প্রথম ব্যক্তি-যিনি ইসলাম কবুল করেছিলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস- যিনি ছিলেন আমার প্রাণপ্রিয় রাসূল (সাঃ) এর চাচাত ভাই, যাঁকে বলা হত জ্ঞানের সাগর। অসংখ্য হাদিস এবং পবিত্র কোরআনের আয়াত তাঁর মুখস্ত ছিল। একজন সুবিজ্ঞ ফকিহ্‌ ও পবিত্র আল্‌-কোরআনের তাফসিরের ক্ষেত্রে একজন শীর্ষস্থানীয় মুফাস্‌সির ছিলেন। মুসলিম বিশ্বে তাঁকে রইসুল মুফাস্‌সিরিন বা সাইয়্যিদুল মুফাস্‌সিরিন বলা হয়। তাঁকে বলা হত আল হিবর বা হিবরুল উম্মাহ্‌ অর্থাৎ মহাজ্ঞানী বা আল্‌-বাহ্‌র অর্থাৎ সাগর। যে কোনো দ্বীনি জিজ্ঞাসার জবাব তিনি প্রজ্ঞার সাথে উপস্থাপন করতেন। এক অনন্য ইসলাম ধর্মবিশারদ হিসেবে তাঁকে মনে করা হত। আর এজন্যেই তাঁর উপাধি হিবরুল উম্মাহ্‌। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ১৬৬০। কারো মতে ২৬৬০। বুখারি ও মুসলিম শরীফে যৌথভাবে ৯৫টি, এককভাবে বুখারিতে ১২০টি এবং মুসলিমে ৪৯টি। তিনি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর হিজরতের তিন বছর পূর্বে মক্কায়, শে’বে আবু তালিব’-এ জন্মগ্রহণ করেন। আল্লামা ইবনে কাসির বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) স্বীয় জন্মের ব্যাপারে এভাবে বর্ণনা করেন যে, যখন হযরত নবী করিম (সাঃ) শে’বে আবু তালিবে অন্তরীণ অবস্থায় জীবন যাপন করছিলেন, সে সময় একদিন আমার পিতা নবীজির খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে মুহম্মদ (সাঃ)! উম্মুল ফজল তো সন্তান প্রসবা-গর্ভবতী।’ নবী করিম (সাঃ) এই খবর শুনে বললেন, ‘চাচা, আল্লাহ আপনাদের চক্ষুদ্বয় শীতল করুক (অর্থাৎ চোখ জুড়ানো সন্তান দান করুক)।’ ইবনে আব্বাস বলেন-যখন আমার সম্মানিত মা-এর পবিত্র গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করলাম তখন আমার পিতা আমাকে এক টুকরো কাপড়ে জড়িয়ে কোলে করে নবীজির কাছে নিয়ে গেলেন। নবী করিম (সাঃ) আমার মুখে উনার একটু থুথু মোবারক দিয়ে ‘তাহনিক’ করলেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, নবীজি শিশু আবদুল্লাহর মুখে একটু থুথু মোবারক দিয়ে তাহনিক করেন এবং এই বলে দোয়া করেন- (আল্লাহুম্মা ফাক্কিহহু ফিদ্দিন ওয়া আল্লিম হুত তাবিল) অর্থাৎ- ‘হে আল্লাহ! আপনি তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা দান করুন এবং তাকে তাফসিরের অগাধ জ্ঞান দান করুন।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর- কেউ কোনো কোরআনের আয়াত তেলওয়াতের সাথে সাথে তিনি বলে দিতে পারতেন কোন ঘটনার প্রেক্ষাপটে আয়াতটি নাযিল হয়েছিল। তাঁর নামাকরণে একটি মসজিদ রয়েছে, যার নাম মক্তব আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, যেখানে আমরা কাফেলার সবাই ড. গিয়াস উদ্দীনের সাথে দোয়াতে শরীক হলাম এবং দু’রাকাত দুখুলুল মসজিদের নামাজ আদায় করলাম। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সাহাবী। মহানবী (সাঃ) এর আবদুল্লাহ নামক চারজন বিশিষ্ট সাহাবী ছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। তিনি কোরাইশ বংশের হাশেমী শাখার সন্তান। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর সর্বকনিষ্ঠ চাচা হযরত আব্বাস (রাঃ) এর জ্যেষ্ঠ ছেলে। তিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর প্রিয়পাত্র। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) ইবনে আব্বাস সম্পর্কে বলেন, ‘ইবনে আব্বাস তোমাদের অপেক্ষা বড় বিদ্বান।’ উমর (রাঃ) তাঁর সম্পর্কে আরও বলতেন যে, ‘সে বয়সে তরুণ, জ্ঞানে প্রবীণ।’ ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) তাঁর সমপর্কে বলেন, ‘কুরআনুল কারিমের তাফসির বর্ণনার সময় মনে হয় যেন তিনি (ইবনে আব্বাস) একটি স্বচ্ছ পর্দার অন্তরাল হতে অদৃশ্য বসু্ত্তসমূহ প্রত্যক্ষ করছেন।’ হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলতেন, ‘ইনি কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার।’ হযরত ইবনে ওমর (রা) বলতেন, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তৎসমপর্কে ইবনে আব্বাস এই উম্মতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বার্ধক্য জীবনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তিনি ইবনে জুবায়েরের শাসনামলে ৬৮ হিজরী, ৬৮৭ খৃস্টাব্দে তায়েফে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া তাঁর নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। তালাল মাদ্দাহ-তিনি আরবী গানের আইকন, যাঁর প্রাথমিক কর্মজীবন ছিল পোস্ট অফিস। তাঁর অসাধারণ গান ‘জেইনা মিন এ তায়েফ’ ব্যাপক খ্যাতি লাভ করে। গানটিতে তায়েফ শহরটির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং এর আকর্ষণীয় আবহাওয়া, সৌন্দর্য্য বর্ণনা করা হয়েছে। মসজিদে আব্বাস জিয়ারতের পর আমরা কাফেলার সবাই মসজিদে আদ্দাস পরিদর্শন করতে গেলাম। যাঁর নাম অনুসারে এই মসজিদ তিনি হলেন আদ্দাস। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর বিশ্বস্ত গোলাম হযরত যায়েদ (রা) কে সাথে নিয়ে যখন মক্কা থেকে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তায়েফ শহরে পৌঁছলেন ইসলামের বাণী প্রচারের জন্য, তখন রাসূল (সাঃ) কে পাথরে পাথরে আঘাতের মাধ্যমে আহত করে রক্তাক্ত করেছিল তায়েফের কিশোর যুবকরা। এই আদ্দাস-ই পানীয় পান করিয়েছিলেন এবং আমাদের নবীজি উতবাহ্‌ ও সায়বাহ্‌ এর মালিকানাধীন একটি আঙ্গুরের ক্ষেতে আশ্রয় নেন। সেই আদ্দাস নামক খৃষ্টান বালকটি রাসূল (সাঃ) এর চরিত্রগুণে অভিভূত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তিনি তায়েফের প্রথম বিশ্বাসী মুসলমান। ইসলাম গ্রহণের স্থানটিতে মসজিদে আদ্দাস নির্মিত হয়। তায়েফবাসীদের নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ দেখেও আমার রাসূল (সাঃ) দু’হাত তুলে হেদায়াতের জন্য দোয়া করেন। এরপর নবীজি বলেন, ‘এ জাতির মঙ্গল কি করে হবে, যাঁরা তাদের নবীকে রক্তাক্ত করেছে।’ আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর গোটা নবুয়তী জীবনে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন তায়েফের মাঠে। সহীহ্‌ বোখারী ও মুসলিম শরীফে উল্লেখিত রয়েছে, হযরত আয়েশা (রা) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনার নবুয়তের ময়দানে কঠিন দিন কোনটি? তিনি বলেন, ‘তায়েফের ময়দান।’ তায়েফের নিষ্ঠুর আচরণ আমার নবীজিকে জিন্দেগীভর কাঁদিয়েছে। তায়েফের প্রতি ইঞ্চি বালুকারাশিতে এখনও ক্রন্দন শুনি রাসূল (সাঃ) এর পবিত্র রক্তের। সাহসী যৌবনকে জাগিয়ে তুলি অপ্রতিরোধ্য স্পৃহায়, জাগ্রত করি শাহাদাতের তামান্না।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধআজ আহমেদ খালেদ কায়সারের কবিতার বইয়ের পাঠ উন্মোচন