জীবন ছিনিয়ে আনার গল্প

বিচিত্রা সেন | শুক্রবার , ৩১ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

নামটিই কেমন আধ্যাত্মিক। উচ্চারণ করার সাথে সাথে কেমন একটা দৃশ্যকল্প চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বলছিলাম, ‘পরমায়ু পাখি হয়ে আসে’ বইটির কথা। এটাকে কী বলা যায়? বড় গল্প? নাকি নিরীক্ষামূলক উপন্যাস? নাকি আত্মকথন? মাত্র চুয়ান্ন পৃষ্ঠার বইটি আকারে ছোট হলেও, গভীরতায় বিশালত্বের দাবী রাখে। বইটির ফ্ল্যাপে এটিকে গল্প বললেও, এ যেন ঠিক গল্প নয়। একটি দুঃসহ ভ্রমণের বৃত্তান্ত। যার মধ্যে উপন্যাসের জীবনদর্শনও লুকায়িত। বইটি লিখেছেন আশির দশকের সাড়া জাগানো গল্পকার দেবাশিস ভট্টাচার্য। তাঁর গল্প যাঁদের পড়া আছে, তাঁরা জানেন তাঁর গল্পগুলো নেহায়েত কাহিনিমাত্র নয়, এ যেন গভীর জীবনদর্শনের চিত্র।

পরমায়ু পাখি হয়ে আসে’ বইটি প্রকাশ করেছে চন্দ্রবিন্দু। আগাগোড়া উত্তমপুরুষে লেখা বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ এর অমর একুশের বইমেলায়। বইটি শুরু হয়েছে লেখক কর্তৃক একটি ছোট্ট মেয়ের স্মৃতিচারণ দিয়ে। যে মেয়েটি লেখকের দেখা পেয়েছিল সৈকতে। মেয়েটি হারগেঁজা ফুলের একটি মালা লেখকের গলায় পরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘সুস্থতা অনেক বড় আশির্বাদ ঈশ্বরের মানুষের জন্য। একজন ব্যক্তি সুস্থ থাকলে সয়সম্পত্তি, টাকাপয়সা, বিত্তবৈভব সবই সে আয়ত্ত করতে পারে। কিন্তু শরীর সুস্থ না থাকলে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। রোগের চাপে সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। শরীর, মন দুইই বিগড়ে যায়।’

গল্পটির চমক হলো যে ছোট মেয়েটিকে দিয়ে কাহিনির শুরু তাকে কিন্তু শেষপর্যন্ত আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তাঁর উদ্ধৃতিটির সত্যতা পুরো গল্প জুড়ে বিরাজমান থাকে। মেয়েটির স্মৃতি কেন লেখক স্মরণ করেছেন তা আমরা বুঝতে পারি কাহিনির গতি কিছুটা এগিয়ে গেলে। ঘটনার সূত্রপাত ২০১৩ সালে কাদের মোল্লাসহ রাজাকার আলবদরদের বিচারের দাবীতে সাধারণ মানুষের রাজপথে নেমে আসার চিত্র দিয়ে। লেখক নিজেও এ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। সাধারণ মানুষের এ আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে নব্য রাজাকাররা পুরানো রাজাকারদের নেতৃত্বে এক ভয়ংকর খেলায় মেতে ওঠে। তারা বাসে, ট্রাকে, বিভিন্ন যানবাহনে পেট্রোল বোমা ছুঁড়তে থাকে। প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই পাওয়া যেত আগুনে ঝলসে যাওয়া বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মৃত্যুর সংবাদ। ঠিক এ সময়েই একদিন অফিস থেকে ফেরার সময় লেখক মুখোমুখি হন ভয়ংকর অভিজ্ঞতার। তাঁরই সামনে পেট্রোল বোমা মেরে কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারলেও তাঁর বড় ছেলে তখনো বাড়ি ফেরেনি। চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে লিডারের ফোন আসে। লিডার জানতে চান লেখক নিরাপদে আছেন কিনা। লেখক স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন তাঁরা সবাই অরক্ষিত অবস্থায় আছেন। যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। লেখক তখনো জানেন না সে রাতটি তাঁর জন্য কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেবে। তারিখটা আগস্টের চার/পাঁচ হবে। তখন রাত দশটা।

তারপরের ব্যাপারটি আমরা লেখকের ভাষায় জানি, ‘সামান্য ভাত খেয়ে একটু জল খেতে যাচ্ছিলাম। সবাই যে যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। জল কিছুতেই ভেতরে যাচ্ছে না মনে হলো বারবার নাক মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। ব্যাপারটা প্রথমে আমাকে অবাক করলো। এমন তো হওয়ার কথা নয়। বারবার মনে হচ্ছিল আমার শরীর জল নিতে পারছে না।’ এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পাঠক দ্রুত এগিয়ে যায় পরবর্তী বয়ানে। রুদ্ধশ্বাসে আমরা জানতে পারি লেখকের ততক্ষণে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। এমন বৈরী পরিস্থিতেও দ্রুত তাঁকে সীতাকুণ্ডের একটা বেসরকারি জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের মহানুভবতায়।

এখানেই শেষ নয়, সবেমাত্র শুরু। এ হাসপাতালে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিয়ে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, হাতে আছে মাত্র তিনঘণ্টা সময়। এর মধ্যেই চট্টগ্রাম মেডিকেলে পৌঁছে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। তারপর সে এক দুঃসহ যাত্রা। পথে পথে অবরোধকারীদের হাতে বাধা। শেষ পর্যন্ত লেখকের আয়ুর জোরে ঠাঁই হয় চট্টগ্রাম মেডিকেলে। শুরু হয়ে যায় তাঁর চিকিৎসা। তারপর লেখকের আর কিছু মনে নেই। তিনদিন পরে যখন তাঁর জ্ঞান এলো, তখন তিনি জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য স্রষ্টা এবং ডাক্তারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, লেখককে যেতে হবে আরও অনেক দূর। তাঁর যে অনেক কাজ বাকি।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে এক সপ্তাহ থাকার পর তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হলো। এরপর শহরে তাঁর জেঠাসের বাসায় এক সপ্তাহ থাকার পর তিনি বাড়ি গেলেন। এরমাঝে তিনি জেনে গেছেন তাঁর হার্টে ব্লক আছে। অতিদ্রুত তা অপারেশন করতে হবে। তিনি আরও ভালো চিকিৎসার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এরপরের কাহিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুধু পড়ে যেতে হয়। একজন লেখকই হয়তো পারেন এমন করে নিজের অন্তিম মুহূর্তের প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে নিখুঁতভাবে অক্ষরে অক্ষরে ফুটিয়ে তুলতে। তাঁর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে সুস্থ হয়ে চট্টগ্রাম ফিরে আসা পর্যন্ত এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, আমরা যেন চলচ্চিত্রের মতো তা শুধু দেখে যাই। এ বর্ণনায় যেমন আছে একজন মৃত্যুপথযাত্রীর দুঃসহ পথ পাড়ি দেওয়ার গল্প, তেমন আছে ভারতের মানবিক চিকিৎসা ব্যবস্থার বর্ণনা। শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে ওঠেন। তবে অচেতন অবস্থায় দেখা একটি স্বপ্ন তাঁকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। সেই স্বপ্নে তিনি পরমেশ্বরের কাছে তাঁর আয়ু প্রার্থনা করেছিলেন, বিনিময়ে মহাদেবের পাখি যেন লেখকের জন্য পরমায়ু নিয়ে আসে।

দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘পরমায়ু পাখি হয়ে আসে’ এক মৃত্যুপথযাত্রীর জীবন ফিরে পাওয়ার গল্প। তবে এ গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে লেখকের দুঃসহ ক্ষণ যাপনের অভিজ্ঞতা। পোড় খাওয়া পাঠক এ গল্প পড়ে সাহস পাবে, পাবে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। লেখক তাঁর পরমায়ু নিয়ে আরও অনেকদিন লিখে যাবেন এটাই পাঠকের প্রত্যাশা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআম্মার ঘরদোর
পরবর্তী নিবন্ধবেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূতের সাথে মেট্রোপলিটন চেম্বার নেতৃবৃন্দের মতবিনিময় সভা