চিন্তাশীল মেধাবী প্রাবন্ধিক

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী | শুক্রবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ

সংবাদপত্র জগতের বয়সী বটবৃক্ষ অরুণ দাশগুপ্ত কবি হিসেবে খ্যাতিমান। চিন্তাশীল মেধাবী প্রাবন্ধিক হিসেবেও তার সুনাম অনেক। গুণী এই সাহিত্য সম্পাদকের কথা বলার স্টাইল চমৎকার, সহজে মন কেড়ে নেয়। তিনি কথা বলতেন অনেকটা অভিজাত উচ্চারণ ঢঙে। চলনে-বলনে, আচার-আচরণে, পোশাক-আশাকে ধোপ-দুরস্ত অভিজাত জমিদার উত্তরসূরী এ ব্যক্তিত্ব পড়তেন প্রচুর। শিল্প, সাহিত্য, নন্দনতত্ত্বে তার পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। তিনি বলতে শুরু করলে অনর্গল বলে যেতে পারতেন। যেন বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টায় তার কথার তুড়িতে। বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই তার সমান দখল ছিল। বলা যায় বয়সী জ্ঞানবৃক্ষ। তিনি চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের শ্রদ্ধা জাগানিয়া মুখ হিসেবে জীবনের অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করে সর্বাংশে এক আলোকিত মানুষ হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
অরুণ দা আমাদের দা’মণি যেহেতু দৈনিক আজাদী’র মতো জনপ্রিয় পত্রিকার ‘সাহিত্য সম্পাদক’ ছিলেন, সঙ্গতভাবে বলা যায়, তিনি অনেককে কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক বানিয়েছেন। অনেকেরই লেখক পরিচিত তার হাত ধরেই দীপ্রমান। আজাদী’র সাহিত্য সাপ্তাহিকী পাতায় আমারও অনেক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। প্রবন্ধ পাঠালেই তা ছাপার হরফে দেখতে পেতাম। প্রবন্ধের প্রতি তিনি আমাকে বেশ উৎসাহী করতেন। বলতেন, আজকাল প্রাবন্ধিক খুব কম তৈরি হচ্ছে। আপনার প্রবন্ধ ভালো আপনি প্রবন্ধ নিয়ে কাজ করুন।
পাণ্ডিত্যে-জ্ঞানে-অভিজ্ঞতায় অনন্য এ মানববৃক্ষকে সৃজন-মননের নিক্তির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। তিনি তার দিব্য দৃষ্টি দিয়ে লেখকদের প্রবণতাকে চিহ্নিত করতে পারতেন। আমৃত্যু অকৃতদার এ মানুষটি সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সাথে তার ঘর-গৃহস্থি করেছেন। তার লিখন শৈলী ও ব্যাকরণিক শুদ্ধতা সংবাদ পরিবেশনের কলাকৌশলকে এক নান্দনিক উচ্চতা দিয়েছিল, যা অনেক সাংবাদিকের অনুকরণীয় আদর্শ ছিল।
অরুণ দার কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষা সংশ্লিষ্টতার ভেতর দিয়ে, তিনি প্রথম জীবনে কলকাতার এক বিখ্যাত বিদ্যাপীঠের লাইব্রেরীয়ানও ছিলেন। ওপার বাংলা থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি স্বদেশে ফিরে এসে সরকার হাট হাইস্কুল, মীরেরসরাই নিজামপুর হাইস্কুলসহ কয়েকটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি কলেজেও শিক্ষকতা করেছেন।
তিনি ১৯৭৩ সালে দেশের অন্যতম প্রাচীন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী’তে যোগ দেন। দৈনিক আজাদীতে তার সাংবাদিকতা পেশার সময়কাল ৪৮ বছর। তিনি দৈনিক আজাদীর ‘সিনিয়র সহযোগী সম্পাদক’ ও ‘সাহিত্য সম্পাদক’ হিসেবে ২০১৫ সালে অবসর নিলে আজাদী সম্পাদক এম. এ. মালেক প্রতিভাবান এ ব্যক্তিত্বকে আমৃত্যু কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেন।
অরুণ দাশগুপ্তের লেখালেখি প্রচুর। প্রবন্ধ, কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রকলা, গল্প সবক্ষেত্রে তিনি বিচরণ করেছেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও লিটলম্যাগে ছড়িয়ে আছে তার লেখা। কিন্তু গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বেশ উদাসীন। এটাকে তিনি বাহুল্য মনে করতেন। নিতান্তই প্রকাশকের উদ্যোগে তার দুটি মাত্র বই ‘রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান’ ও ‘যুগপথিক কবি নবীনচন্দ্র সেন’ প্রকাশিত হয়’। “খাণ্ডবদাহন” নামে তার একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি রেডি থাকলেও জীবদ্দশায় তা আর প্রকাশের মুখ দেখলো না। তিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কারও লাভ করেন। ২০০৭ সালে ‘বৌদ্ধ একাডেমি পুরস্কার’, ২০১৭ সালে ‘সিটি করপোরেশন সাহিত্য পুরস্কার’, ২০১৭ সালে ‘কালধারা সাহিত্য পুরস্কার’ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি তার কর্মের জন্য দেশের বিশেষত চট্টগ্রামের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। বিনম্র শ্রদ্ধা তার আত্মার প্রতি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবুজ আগুনে জ্বলছো তুমি
পরবর্তী নিবন্ধগুণী সাহিত্য সম্পাদক