চারপাশেই গহীন আঁধার

মোস্তফা কামাল পাশা | সোমবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক খাত তদারকির অলাভজনক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) দেশ থেকে মুদ্রা পাচারের ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল ৬ বছরে মুদ্রা পাচার হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, মার্কিন ডলারে ৪৯৬৫ কোটি ডলার। এই হিসাবে বছরে গড়ে ৭৩ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে ২০১৫ সালে। সংস্থার সিনিয়র অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ রিক রাইডেন ১৬ ডিসেম্বর এক ইমেইল বার্তায় বলেছেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘে নিয়মিত বৈদেশিক বাণিজ্যের বার্ষিক তথ্য না দেয়ায় তারা পরবর্তী বছরগুলোর পাচারের অঙ্ক যোগ করতে পারেনি। জিএফআই বিশ্বের শীর্ষ অর্থ পাচারে যুক্ত শীর্ষ ৩০ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় রেখেছে বাংলাদেশকে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারতের পরেই অর্থ পাচারে বাংলাদেশের অবস্থান। ওই ৬ বছরে যে অর্থ পাচার হয়েছে তা বাংলাদেশের ২০২১-২২ সালের বার্ষিক বাজেটের সমান। প্রতি বছর গড় পাচার করা টাকায় তিনটা পদ্মা সেতু গড়া সম্ভব। বাংলাদেশ ফিনানশিয়াল ইনটেলিজেন্ট ইউনিট প্রধান জিএফআই’র প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে ‘কনফিউজড’ বলে জানিয়েছেন। অথচ সংস্থাটি বিভিন্ন দেশের ২০১৮ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করলেও বাংলাদেশ জাতিসংঘে ২০১৬ সাল থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যের তথ্য না দেয়ায় পরবর্তী তিন বছরের পাচারের তথ্য দিতে পারেনি বলে জানায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছ, বৈদেশিক বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েস, ওভার ইনভয়েস এবং দুর্নীতির মাধ্যমেই বেশিরভাগ অর্থ দেশ থেকে পাচার হচ্ছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ১৮% ভূয়া বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। উদাহরণ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক বছরে বাংলাদেশ তিন বিলিয়ন ডলার রপ্তানি দেখালেও যুক্তরাষ্ট্রের হিসেবে চার বিলিয়ন ডলারের আমদানি নথিভুক্ত দেখানো হয়। মাঝখানের এক বিলিয়ন ডলার পুরোই পাচার হয়ে গেছে। জিএফআই প্রতি বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থ প্রবাহ নজরদারিও পাচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আর্থিক স্বচ্ছতা ও পাচার ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে পরামর্শ এবং কারিগরি সহায়তাও দেয়। তাও বিনামূল্যে।
জিএফআই ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক গ্রুপ (আইসিআইজে), পানামা, প্যারাডাইস ও পেন্ডোরা পেপার্সে দেশের অর্থ পাচার সংক্রান্ত বহু ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছে। অনেক রাঘব বোয়ালের নামও এসেছে। কানাডায় বাংলাদেশী বিলিয়নিয়াদের বেগমপাড়া নিয়ে বহু কাহিনি দেশ বিদেশে ঝড় তুলেছে। কিন্তু কোন তদন্ত বা বিচারের খবর আলোতে নেই। বর্তমান আধুনিক ব্যবস্থায় খুব দ্রুতই পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ থাকলেও তা প্রয়োগ করা হচ্ছেনা, অজ্ঞাত কারণে। অথচ খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক, কোকোর পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। যারা বেপরোয়া অর্থ পাচার করছে, তারা খুবই প্রভাবশালী। প্রশাসন, আর্থিক খাতসহ সব সেক্টরেই তাদের শক্ত খুঁটি রয়েছে। নাহলে এত বেপরোয়াভাবে দেশ ও জনগণের সম্পদ কীভাবে লুন্ঠন করে যাচ্ছে তারা?
আর্থিক খাতের ভয়াল এই অসুখ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামতও দিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী এবং মুজিব জন্মবার্ষিকীর মত আনন্দ উদযাপনের ঘনঘটায় বিপুল অর্থ পাচারের প্রতিবেদন জাতির কপালে এক খাবলা কালি লেপ্টে দিয়েছে। এত বিপুল অর্থ অবৈধ পথে প্রতি বছর পাচার হতে থাকলে দেশ কীভাবে সমৃদ্ধির সুবর্ণ তোরণে প্রবেশ করবে ? প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। কিন্তু শর্ষেও মাঝে ভূতের নিবাস থাকলে কীভাবে কী ?
জিএফআই প্রতিবেদন এবং পানামা, প্যারাডাইস, পেন্ডোরা পেপার্স কেলেঙ্কারি যদি সত্য হয়, তাহলে কেন টাকা ফেরত আনার পাশাপাশি দায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না? প্রশ্নটা জাতির বিবেকের কাছে বিষাক্ত কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকবেই।

স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী এবং মুজিব জন্মবার্ষিকীর মত আনন্দ উদযাপনের ঘনঘটায় বিপুল অর্থ পাচারের প্রতিবেদন জাতির কপালে এক খাবলা কালি লেপ্টে দিয়েছে। এত বিপুল অর্থ অবৈধ পথে প্রতি বছর পাচার হতে থাকলে দেশ কীভাবে সমৃদ্ধির সুবর্ণ তোরণে প্রবেশ করবে ?

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধমিথ ও দুর্ঘটনা