মিথ ও দুর্ঘটনা

সুমন চৌধুরী বিকু | সোমবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ

মিথ মানুষের জীবনে সেই অনাদিকাল থেকেই একধরণের প্রভাব বিস্তার করে আসছে। এর যথাযথ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি নাই সেই তর্ক বা প্রমাণের দিকে না গিয়ে মননে মেধায় এগিয়ে থাকা হালের অতি আধুনিক মানুষটাও নিঃসন্দেহে এ ধারণায় প্রভাবিত। কিছু প্রচলিত বিষয় যেমন আমরা সেই ছোটকাল থেকেই জেনে আসছি যে, এই মুহুর্তে ঘটতে থাকা কিছু ঘটনা নিকট ভবিষ্যতে ঘটতে যাওয়া অন্য কোন ঘটনার ইঙ্গিত বহন করে। তার কয়েকটা উদাহরণ যদি দিই; যেমনটি লোকে বলে থাকে, চারদিকে লাইন ধরে বিষপিঁপড়া ছুটতে থাকা মানে খুব শীঘ্রই বৃষ্টি হতে যাচ্ছে। ঘরের আশেপাশে পেঁচার ডাক শুনতে পাওয়া মানে আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত। একসাথে অনেকগুলো কুকুর কান্না করা মানে আসন্ন অমঙ্গলের আভাস। কিংবা রাতেরবেলায় যম কোকিল ডাকা মানে কারো মৃত্যুর আগামবার্তা ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই ছোটবেলা থেকে এই বিশ্বাসে যখনই ঘরের পাশে গাছের ডালে কোন পেঁচা গম্ভীরভাবে থেমেথেমে অদ্ভূতরকমের বিশ্রীভাবে ডেকে যেতো কিংবা সন্ধ্যারাতে অদেখা কোন গাছের ডালে বসে উল্টোস্বরে যম কোকিল কু উ কু উ করে ডাকতো তখন সেই গাছের দিকে ঢিল ছুঁড়ে তাড়ানোর চেষ্টা করতাম। হতে পারে এরকম ঘটনাগুলোর সাথে সমান্তরাল সময়ে কথিত কার্যকারণ সম্পর্কিত ঘটনাগুলো কাকতালীয়ভাবে কোন একসময় ক্রমাগত ঘটতে থাকার ফলে স্থায়ীভাবে মানুষের ধারণায় প্রোথিত হতে থাকে এবং একটা সময় অনাবশ্যক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর এমনি করে কালের আবর্তে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এইসব প্রচলিত ধারণাগুলো বিস্তৃত হতে হতে মিথ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
এই মিথ এমনই এক অদৃশ্য শক্তি, আপনি হয়তো একদিকে ভাবছেন এসব স্রেফ কথার কথা আবার অন্যদিকে সে-ভাবনাকে চাপা দিয়ে নিজের অজান্তেই আপনার চিন্তার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। ফলে আপনাক স্বীকার করতেই হবে, যতোদিন পৃথিবী থাকবে ততোদিন এজাতীয় মিথের বলয় থেকে আপনার আমার বের হয়ে আসার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।
তবে এই যে মিথ, কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত বিচ্ছিন্ন কিংবা কাকতালীয় ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি বাদ দিলেও এটা ঠিক যে, মানুষের স্নায়বিক অনুভূতি, ইন্দ্রিয় এতোটাই শক্তিশালী যে, পীর দরবেশ জ্যোতিষী সাধুবাবা না হয়েও বেশীরভাগ মানুষ তার ইন্দ্রিয়জাত অনুভবে কিছুটা হলেও ভবিতব্য আঁচ করতে পারে। আমি অন্তত বলতে পারি এমনটা আমার ক্ষেত্রে হয়। ভাল খারাপ যাই ঘটতে যাক না কেন বেশ কিছু সময় পূর্বে থেকে আমার সামগ্রিক অনুভবে আমি ঠিক সেটা টের পাই। তার তাজা উদাহরণ যদি দিতে যাই, ঠিক আজকেও সেরকম কিছু হয়েছে। দিনের শুরু থেকেই কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছিল। মন বসছিল না কোন কাজে। দেহের সমস্ত অনুভূতি একত্রিত হয়ে জানান দিচ্ছিল কিছু না কিছু উল্টাসিধা তো ঘটবেই। আর বিকেল হতেই ছোটখাটো একটা গোলমাল দড়ি পাকাতে পাকাতে ঠিক গিট্টু লাগিয়ে দিল। তাও কি হয়, আরো কিছু যে বাকি রয়ে যায়।
জীবনে আজকের আগে তিনবার ব্যাটারিচালিত রিক্সায় উঠেছি,তার মধ্যে দু’বার ছোটখাটো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কেউ না দেখে মতো কানটানা খেয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর জীবনেও এই রিক্সায় উঠবো না। নাকে খত দিতে হয়নি কারণ দুর্ঘটনার সময়ই অটোমেটিক নাকে খত খেয়ে ফেলেছিলাম। এই যানটার অতিমাত্রিক বিশেষত্ব হচ্ছে এটা অনেকটা পাগলা ঘোড়ার মতো। ঘোড়া যেমন যত লাগাম টানবেন ততো বেশি দৌড়বে তেমনি এটাও যতো থামাতে চাইবেন ততো বেশী গতিতে ছোটে! আর তখন চালকের আসনে যিনি থাকেন তাকে আমার ঠুঁটো জগন্নাথ মনে হয়। সাধারণ রিকশাগুলো তিন চাকার হলেও ওজনের দিক থেকে সামনের আর পেছনের অংশে মোটামুটি ব্যালেন্স থাকে। কিন্তু এটার ক্ষেত্রে পেছনের অংশে ভারি ইঞ্জিন আর ব্যাটারি থাকার ফলে পেছনের অংশ তুলামূলকভাবে অনেকগুণ বেশি ওজনসম্পন্ন হয়। এই অসুবিধার কারণে আমি একবার চিতপটাং হয়েছিলাম। বেশ কয়েকবছর হয়। এখনো মাঝেমাঝে আচমকা সেই ব্যাথাটা অনুভব করি। আর কখনো এমন রিকশায় উঠবো না ভেবে বছরখানেক আগে উঠে পড়েছিলাম আরো একবার।
এনায়েতবাজারের দিক থেকে আসার পথে পুরাতন বিআরটিসি বাস ডিপোর উত্তর গেটে সে সময়ে রাস্তার নীচে থাকা ড্রেনের উপরের কাল্‌ভার্টেও কিছু অংশ ভেঙ্গে গিয়ে ছোট্ট একটা গর্তের মতো হয়েছিল। সব গাড়িই সচেতনভাবে ওই গর্তটা পাশ কাটিয়ে চলে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য। কিন্তু আমার ঘোড়ার মতো উড়ালপঙ্খীরাজ অনিয়ন্ত্রিত গতি নিয়ে সেটা পারেনি। ফলস্বরূপ যা হবার তাই হলো, চোখের পলকে ভূপতিত হলাম। সেবার শরীরের কোথাও কোথাও জখম হয়েছিল। কিছুকাল আগে রাত সাড়ে নয়টার দিকে চেরাগির মোড়ে দাঁড়িয়েছিলাম রিক্সার জন্য। করোনার সময়ে রাত সাড়ে নয়টা প্রায় সুনসান রাস্তা। খুব একটা মানুষজন নেই, নেই রিক্সাও। শুধু ওই একটা ব্যাটারিচালিত রিক্সা নিয়ে তার চালক দাঁড়িয়েছিল। আমি অন্য একটা রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ব্যাটারিচালিত রিক্সায় উঠবো না জেনেই উনার সাথে কোন কথা বলার আবশ্যকতা ছিল না। শেষে ওই চালক গায়ে পড়ে কোথায় যাবো জিজ্ঞেস করাতে শেষমেশ উঠে গেলাম, তাও অন্য কোন রিক্সার দেখা মিলছিল না বলে। একে তো ফাঁকা রাস্তা, সেই সুযোগে লাগামছাড়া গতিতে সাঁইসাঁই করে ছুটলো রিক্সা। আমার মনে পড়ে গেলো আগের দুইবারের অভিজ্ঞতার কথা। মনে মনে আশা করতে লাগলাম যাতে ভালোয়-ভালোয় পৌঁছতে পারি। কিন্তু ওই যে বলছিলাম মন খারাপের গল্প, সমূহ বিপদের আশংকা আগে থেকে আঁচ করতে পারার কথা; সেইমতে বিকেলের ঘটে যাওয়া গন্ডগোল আর গিট্টু লাগার সদ্য অনুভবের রেশ কাটতে না কাটতে আমি কি আর জানতাম যে আজকের বিপদের ষোলকলা তখনো পুর্ণ হয়নি!
অদ্ভূতভাবে সেই আগের বিআরটিসি এলাকাতেই ঘটলো অঘটন। ‘ওখানে ওভারপাসের নীচ দিয়ে কদমতলীমুখী হবার আগে কিছু ভাঙ্গাচোরা এবড়োথেবড়ো অংশ ছিল প্রধান সড়কের উপর। যেহেতু এই জাতীয় রিক্সাগুলোর গতি চলন্ত অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করা আসলেই দুরূহ আর সে কারণেই ওই ভাঙ্গা অংশে রিক্সার একটা্‌ চাকা পড়তেই রিক্সাটা ডানপাশে পুরোটাই কাত হয়ে গেলো। এতোটাই কাত হয়েছিল যে অপ্রস্তুত আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেলাম। একজন লোক দৌড়ে এসে আমাকে উঠতে সাহায্য করলো। ডান হাতের কনুইটা শক্ত পাথুরে রাস্তায় লেগে জখম হয়ে রক্ত বেরোয়। আর পায়ের গোড়ালির দিকেও ব্যাথা অনুভব করি। আমি উঠে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে এমনই স্বগতোক্তি করি, ‘এজন্যই ব্যাটারিচালিত রিক্সায় উঠতে চাইনা’’। সাথেসাথেই রিক্সাচালক দায় এড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়েই হয়তো বলে ওঠে,‘আপনি ধরে বসবেন না!’ হায় কপাল! ব্যাটা কি জানে যে, তার রিক্সায় অতি মহান একজন যাত্রী সওয়ার হয়েছে, যিনি কিনা অনায়াসে অন্যের দায়ও নিজের উপর নিয়ে মহান সাজার মতো অচল মাল! ব্যাথা পাবার পর ও টু শব্দটি না করে প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে ফের চুপচাপ চলতে থাকার মতো এমনও কোন যাত্রী একদিন তার রিক্সায় উঠেছিল এ-কথা হয়তো তিনি আজীবন মনে রাখবেন। আমি এটাই ভাবতে চেয়েছিলাম আসলে, দুর্ঘটনা স্রেফ দুর্ঘটনাই। তিনি সচেতনভাবে নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, একটা দুর্ঘটনা নিজের ইচ্ছেতে ঘটুক। বিশেষ করে রিক্সার চাকা গর্তে পড়ার একটা মূখ্য কারণ আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম; হতে পারে এটাই প্রধান কারণ নয়। ঠিক ওই সময়ে ওভারপাস দিয়ে যাবার মুখে একটা মিনি ট্রাককে দাঁড় করিয়েছিল ট্রাফিক পুলিশের একজন কনস্টেবল। ওই মিনি ট্রাকের হেড লাইটের তীব্র আলো বিপরীতমুখী রিক্সাচালকের চোখ বরাবর পড়াতে গর্তটা টের পায়নি বলে মনে হলো। কিছুদূর যাবার পর আমার মনে হতে লাগলো রিক্সাচালক অনুতপ্ত, বিস্মিত, বিমূঢ় এবং উদ্বেলিত। অনুতপ্ত এই কারণে, তিনি আত্মরক্ষার খাতিরে প্রথম দিকে ঝাঁঝালো গলায় আমার তরফ থেকে সম্ভাব্য আক্রমনাত্মক বকাবকি থেকে পরিত্রাণ এবং নিজের দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে ‘আপনি ধরে বসবেন না ’ টাইপ কথা বলার পরও কোন প্রতিক্রিয়া না দেখা। দ্বিতীয়ত রিক্সা পুনরায় চলতে শুরু করার পর তিনি বারবার বলেছিলেন, ‘একটু দাঁড়াই, আপনার কোথাও লেগেছে কিনা, রক্ত পড়ছে কিনা দেখে নেন’, পক্ষান্তরে আমি বলছিলাম আরে, সমস্যা নেই। আপনি চালান।’ এটা শোনার পর লোকটার আদৌ হয়তো বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, আমি ব্যাথা পাইনি। শেষ পর্যন্ত এই ধারণা থেকে রিক্সা যখন গন্তব্যে পৌঁছাল তখন পকেট থেকে ভাড়ার টাকা বের করার সময় তিনি কৌতূহল মেটাতে ঠিকই আমার কনুইতে হাত দিয়ে দেখে নিলেন। আমি আর কিছু বলার মতো সুযোগ না দিয়েই হনহন করে বাসার দিকে চলতে থাকলাম। এবার নিশ্চিত লোকটা আমাকে আজব প্রকৃতির আর এক নম্বরের বোকা ভেবে আপনমনে বিদ্রুপের হাসি হাসবে। আবার কখনো অকারণে কথাগুলো মনে পড়লে দুঃখের মাঝেও এক ঝলক হাসবে। কিংবা কখনো গল্প-আড্ডায় পরিবারের মানুষগুলোকে বা সমবয়েসী বন্ধুদেরকে অদ্ভূত প্রকৃতির একটা চরিত্রের গল্প শোনাবে। আর আমি, কিছু তাজা যন্ত্রণার দৌলতে এক টুকরো সুখানুভূতি নিয়ে ঘরে ফিরলাম। একদিন পর অবশ্য টের পেয়েছি শরীরের অনেক জায়গায় তীব্র ব্যাথা।
এরকম ছোটছোট কিছু বিপদের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর নিশ্চয়
আমাকে অনেকবার বড় কোন বিপদ থেকে রক্ষা করেন।

হতে পারে এরকম ঘটনাগুলোর সাথে সমান্তরাল সময়ে কথিত কার্যকারণ সম্পর্কিত ঘটনাগুলো কাকতালীয়ভাবে কোন একসময় ক্রমাগত ঘটতে থাকার ফলে স্থায়ীভাবে মানুষের ধারণায় প্রোথিত হতে থাকে এবং একটা সময় অনাবশ্যক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচারপাশেই গহীন আঁধার
পরবর্তী নিবন্ধপূর্বাশার আলো ও তাহের ফাউন্ডেশনের শীতবস্ত্র বিতরণ