চট্টগ্রাম: পর্যটনে অপার সম্ভাবনার হাতছানি

নুসরাত সুলতানা | মঙ্গলবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ


ঘন সবুজ সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা, নদ-নদী বেষ্টিত আমাদের চট্টগ্রাম প্রাচ্যের রাণী হিসেবেই সুপরিচিত। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। পাহাড়, টিলা, লেক, সমুদ্র আর বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছগাছালি সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম পর্যটকদের বরাবরই মুগ্ধ করে। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পরিপূর্ণ জায়গা আমাদের দেশে আর কোথাও নেই। আর তাই চট্টগ্রাম হতে পারে পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনার দ্বার।
আমাদের চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে সারা বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, আছে পাহাড় ঘেরা সাজেক, বান্দরবান, নীলগিরি, নীলাচল, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি। আরো আছে সোনাদিয়া দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, ছেড়া দ্বীপ, হিমছড়ি, ইনানী, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, টেকনাফ, পতেঙ্গা সী বিচ, পার্কি বিচ, খৈয়াছড়া ঝর্ণা, চন্দ্রনাথ পাহাড়, মুহুরী প্রজেক্ট, সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক, ভাটিয়ারী কান্ট্রি ক্লাব, ভাটিয়ালি লেক, পাহাড় ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নেভাল একাডেমি, শাহ আমানত ব্রিজ। চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রে আছে সুপরিচিত ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে স্টেশন, অভয়মিত্র ঘাট, চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি, ডিসি হিল, বাটালি হিল, সবুজ পাহাড়ে ঘেরা পানিবেষ্টিত ফয়েজ লেক, টাইগার পাস, ওয়্যার সিমেট্রি। আছে নামকরা স্টেডিয়াম, পাঁচ তারকা মানের হোটেল, শান্তনিরীবিলি পরিবেশে সমুদ্রের পাড়ে সবুজে ঘেরা এয়ারপোর্ট, আছে সমুদ্র বন্দর সহ আরো অনেক অনেক পর্যটন এরিয়া।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আমাদের চট্টগ্রাম বিভাগেই অবস্থিত। একাধারে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ নিরবিচ্ছিন্ন কাদামুক্ত বালুকাময় সমুদ্র সৈকত হলো কক্সবাজার। শামুক ঝিনুক সহ নানা প্রজাতির প্রবাল সমৃদ্ধ এই সৈকত পর্যটকদের কাছে টেনে নেয় অবলীলায়। এই সৈকতের পাড়ে এলেই কানে বাজে সাগরের উর্মি মালার গর্জন। সৈকতের কাছেই আছে সারি সারি ঝাউ গাছের বিশাল বাগান। সৈকতের বালুকাবেলা যেমন পর্যটকদের কাছে টানে ঠিক তেমনি কক্সবাজারের সুউচ্চ পাহাড়ে আছে ৩০০ বছর আগে স্থাপিত জাদিরাম মন্দির, আছে বার্মিজ মার্কেট, রাডার স্টেশন, লাইট হাউস, ঝিনুক মার্কেট, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল এ্যকুরিয়াম; রেডিয়েন্ট ফিসওয়ার্ল্ড, মনোমুগ্ধকর হিমছড়ি ঝর্ণা, পাটোয়ার টেক সি বিচ যা প্রাকৃতিক এবং দেখতে অনেকটা সেন্টমার্টিন এর আদলেই গড়া। কক্সবাজার শহরের কলাতলী মোড় থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগর পাড়ে দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে কক্সবাজারের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মেরিন ড্রাইভের আশেপাশে গড়ে উঠেছে নামিদামি হোটেল মোটেল। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ ইনানী বিচ, কক্সবাজার শহরের লাবনী পয়েন্ট কিংবা কলাতলী পয়েন্ট সৈকত থেকে মেরিনড্রাইভ হয়ে হিমছড়ি কিংবা ইনানী যাওয়ার পথে পাহাড়ি সবুজে ঘেরা সুশীতল ছায়া বেষ্টিত বন এবং প্রকাণ্ড সৈকতে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শোঁ শোঁ শব্দ এবং দীর্ঘ বালুকাবেলার সৌন্দর্য সব ধরনের পর্যটককেই বিমুগ্ধ করে। যেতে যেতে পথে দেখা মিলবে লাল কাঁকড়ার ঝাঁক আর সাগর লতার কালারফুল ফুলের মেলা। মাত্র ১২ কিলোমিটার পথ পেরোলেই দেখা মিলবে অপরূপ পাহাড়ে ঘেরা প্রাণচঞ্চল হিমছড়ি ঝরনার। ঝরনার পাশেই আছে পাহাড়ে উঠার অনেকগুলো সিঁড়ি। উপরে উঠে সমুদ্রটাকে দেখতে অসাধারণ লাগে।
হিমছড়ি ঝর্ণা থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণে অপরূপ পাথুরে সৈকত ইনানী। বিশাল সাগরের জল রাশি যখন মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ে সৈকতের পাথরগুলোর উপর তা দেখতে এক অপরূপ স্বর্গীয় দৃশ্যের সূচনা করে। এই অপরূপ দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে চোখে পড়বে গভীর সমুদ্রে অসাধারণ সূর্যাস্ত। এই সৈকতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শামুক ঝিনুক সহ হরেক রঙের পাথরের বাহার। ইনানী থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে পাটোয়ারটেকের অবস্থান। পাটোয়ারটেক বিচ যেনো এক টুকরো সেন্টমার্টিন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট বড় অসংখ্য পাথরের উপর সাগরের ঢেউগুলো আছড়ে আছড়ে পড়ে এক অপরূপ দৃশ্যের সূচনা করে যা থেকে চোখ সরানো মুশকিল। এখানে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো প্রাকৃতিক মানের রেস্টুরেন্ট।
খুব সুন্দর ছোট্ট একটি দ্বীপ, সোনাদিয়া বালির দ্বীপ। ছোটো হলেও দেখতে অনেকটা সেন্টমার্টিনের মতোই এ দ্বীপ। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে মহেশখালীর দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই দ্বীপের সৌন্দর্যই আলাদা। পাহাড়, ঘন সবুজ প্যারাবন পেছনে ফেলে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে যেতে হয় এ সোনাদিয়া শহরে। ঐতিহাসিকরা এ দ্বীপকে সোনালী দ্বীপ বলেছেন। প্রতিবছর শীতে হাজার হাজার অতিথি পাখির ভিড় জমে বলেই এই দ্বীপকে ‘অতিথি পাখির স্বর্গরাজ্য’ বলা হয়। সাগর থেকে তোলা তরতাজা মাছ এই দ্বীপের বালুচরে রোদে শুকিয়ে চট্টগ্রামবাসীর সবচেয়ে প্রিয় খাবার শুটকি তৈরি করা হয়।
নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত টেকনাফে পৌঁছাতে কক্সবাজার শহর থেকে সময় লাগে দুই ঘণ্টার মতো। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই পৌঁছে যাওয়া যায় এই শহরে। এখানে আছে প্রেমের সাক্ষী ঐতিহাসিক ‘মাথিনের কূপ’। আছে ‘দেবতার পাহাড়’ ‘ব্রিটিশ বাঙ্কার’।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত একমাত্র সামুদ্রিক প্রবাল দ্বীপ হলো সেন্ট মার্টিন। চট্টগ্রাম বিভাগে অবস্থিত প্রকৃতির এক বিস্ময়কর প্রবাল দ্বীপটি টেকনাফ শহর থেকে মাত্র ৮ মাইল দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝেই অবস্থিত। এর প্রাচীন নাম নারিকেল জিঞ্জিরা হলেও পরবর্তীতে সেন্ট মার্টিন নামে অভিহিত করা হয়। এ দ্বীপের মূল আকর্ষণ হলো প্রাকৃতিক এ্যকুরিয়াম। যে এ্যকুরিয়ামে আছে জীবন্ত পাথর, আছে সামুদ্রিক কাঁকড়া, প্রাচীন প্রবাল, মুক্তা, কাছিম, আছে বিভিন্ন রকমের বিভিন্ন রঙের সুন্দর সুন্দর মাছ। দক্ষিণের স্বর্গ নামে পরিচিত এই দ্বীপে সারিসারি নারিকেল গাছ, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা গাঙচিল দেখা যায়। সৈকতে বসে স্নিগ্ধ বাতাসে কেয়াবন আর সাগর তীরের মায়াময় স্নিগ্ধতায় মন ভরে যায়। বাংলাদেশের মানচিত্রের সর্বশেষ বিন্দু হলো ছেঁড়াদ্বীপ। সেন্টমার্টিন শহরের মাত্র ৫ কি.মিটার দক্ষিণে এর অবস্থান। যদিও এখানে কোনো লোক বসতি নেই তথাপি নীল জলের এই দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্য মন ভরে উপভোগ করা যায়। এই দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন রকমের প্রবাল শামুক ঝিনুক।
চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের পূর্ব পাশে ডুলহাজারা রিজার্ভ ফরেস্টে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যসম্বলিত বনাঞ্চলে সাফারি পার্ক অবস্থিত। সাফারি পার্ক হল সরকার ঘোষিত নির্দিষ্ট এলাকা যেখানে বন্যপ্রাণীদের প্রাকৃতিকভাবে প্রতিপালন করা হয়। চিড়িয়াখানায় পশুপাখি বন্দি অবস্থায় থাকে। কিন্তু সাফারি পার্কে থাকে পশু পাখির অবাধ বিচরণ। গহীন বনে ঘুরে বেড়ানো পশুপাখি দেখতে হলে এ পার্কে যেতে হবে, যা পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
আমাদের দেশের সব মানুষের মূল আকর্ষণ এখন সাজেককে ঘিরে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম ইউনিয়ন সাজেক। রাঙ্গামাটির উত্তরে ভারতের মিজোরাম সীমান্তে এর অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা প্রায় ১৭০০ ফুটেরও বেশি। জেলা শহর থেকে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছোট বড় হাজারো পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই পৌঁছে যাওয়া যায় সাজেক। ছুটে চলা স্বচ্ছ সাদা মেঘ আর সবুজ পাহাড়ের দারুণ মিতালী মুগ্ধ করে পর্যটকদের। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা মেঘের আনাগোনা। সবুজ পাহাড় ঘেঁষে ঘেঁষে সাদা মেঘ গুলো ছুটে যাওয়ার সময় স্বর্গীয় দৃশ্যের সূচনা করে। সাজেকের সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্যই মুগ্ধ করে পর্যটকদের।
চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রোমাঞ্চকর অনেক জায়গার কারণে বাংলাদেশের পর্যটন ক্ষেত্রে অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবস্থানে আছে বান্দরবানের নাম। বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জলপ্রপাত গুলোর মধ্যে নাফাখুম অন্যতম। পাহাড় ও বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা সাঙ্গু নদীতে নাফাখুমের অবস্থান। ওখানে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহন বান্দরবান জেলা শহরেই পাওয়া যায়। জেলা শহর থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় বাংলাদেশের প্রশস্ততম জলপ্রপাত ‘জাদিপাই’ এ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক হ্রদ ‘বগা লেক’। প্রায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই লেক বান্দরবান শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পালপাড়ায় অবস্থিত ‘বুদ্ধ ধাতু জাতি মন্দির’। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি। সমতল ভূমি থেকে ২০০ ফুট উঁচু এ মন্দিরে রিকশা কিংবা অটো রিক্সায় করেও যাওয়া যায়। জিপে চড়ে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সর্পিল রাস্তায় রোমাঞ্চকর যাত্রা শেষে পৌঁছে যাওয়া যায় চিম্বুক পাহাড়ে। যা বাংলাদেশের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত। বান্দরবান শহরে আছে মিনি সাফারি পার্ক, চিড়িয়াখানা, ঝুলন্ত ব্রিজ, কৃত্রিম লেক এবং নৌকা ভ্রমণের সুবিধা।

বান্দরবান শহরের সবচেয়ে নিকটবর্তী পর্যটন স্পট হল ‘নীলাচল’। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এ পাহাড় থেকে পাখির চোখে দেখতে পাওয়া যায় পুরো শহরকে। এ যেনো এক অন্যরকম অনুভূতি। থানচি থানায় অবস্থিত ৩৫০০ ফুট উঁচু জায়গাটির নাম ‘নীলগিরি’। এটি বাংলাদেশের উচ্চতম ও আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট গুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও বান্দরবানে রয়েছে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান, সাংস্কৃতিক জাদুঘর, কেওক্রাডং পাহাড়, তাজিংডং পাহাড়, শুভ্রনীলা, চিংড়ি ঝিরি জলপ্রপাত সহ অনেক জলপ্রপাত।
আকাশের মেঘগুলো যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, আরেক জনপ্রিয় চন্দ্র পাহাড় কে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪০০ ফুট ওপরে পার্বত্য চট্টগ্রামের চন্দ্রপাহাড়। ওপরে বিস্তৃত নীল আকাশ। নিচে সবুজ ঘাসের গালিচা। সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং থেকে শুরু করে যেদিকে চোখ যায় দিগন্তরেখা পর্যন্ত চোখে পড়ে শুধু ছোট-বড় পাহাড়। গোধূলির আলো-আঁধারিতে সূর্যাস্তের লাল আভার সঙ্গে ভেসে উঠে পাখির ঢেউ, সারি সারি পাখি ছুটে চলে দিকদিগন্তে। সূর্যোদয়ের সময় তাকালে চোখে পড়ে সাঙ্গু নদীর আঁকাবাঁকা স্বচ্ছ জলের ধারা। ঘোর বর্ষায় জলের ধারায় অপরূপ স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা হয় চন্দ্র পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন এক অপার সৌন্দর্য অবগাহনের স্থান চন্দ্রনাথ পাহাড়; যাকে ঘিরে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হল খাগড়াছড়ি। পাহাড়, ঝর্ণা, ঝিরি ও কৃত্রিম লেক সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় খাগড়াছড়ি হতে পারে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। জেলা পরিষদ পার্ক, হেরিটেজ পার্ক, ঝুলন্ত ব্রিজ, রিছাং ঝর্ণা সহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের মুগ্ধ করে। বিখ্যাত আলুটিলার রহস্যময় সুরঙ্গ এখানেই অবস্থিত। পাহাড়ের চূড়া থেকে ২৬৬ টি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেই পৌঁছে যাওয়া যায় ২৮২ ফুট দৈর্ঘ্যের সেই স্বপ্নীল সুরঙ্গ মুখে। আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র ও রহস্যময় গুহার অনতিদূরেই অবস্থিত প্রাকৃতিক আরেক সৃষ্টি ‘রিছাং ঝর্না’। এই খাগড়াছড়িতেই আছে সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৭০০ ফুট উপরে ‘দেবতা পুকুর’। খাগড়াছড়ির প্রবেশ মুখে আছে নান্দনিক হ্রদ ‘রামগড় লেক’। ইংরেজি িএর অনুরূপে প্রায় ২৫০ মিটার লম্বা এ হ্রদের মাঝখানে যোগাযোগের জন্য আছে সুদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বন জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত ‘তৈদু ছড়া ঝর্ণা’। পানছড়ি উপজেলায় আছে ‘শান্তিপুর অরণ্য কুটির’। এখানে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বুদ্ধমূর্তি।
চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৭৭ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গামাটির অবস্থান। রাঙ্গামাটির অন্যতম আকর্ষণ হল কাপ্তাই লেক। এখানকার নৌকা ভ্রমণে পাওয়া যায় রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। রাঙ্গামাটি ঝুলন্ত সেতু, শুভলং ঝর্ণা, শেখ ইকোপার্ক, কর্ণফুলী নদী, নৌ বাহিনী একাডেমি, এসব দর্শনীয় স্থান নৌপথে ভ্রমণের মাধ্যমে ঘুরে দেখা যায়। রাঙ্গামাটির অন্যতম বৌদ্ধবিহার ‘রাজবন বিহার’। শহরের যান্ত্রিক কোলাহলমুক্ত এই পরিবেশ পর্যটকদের মনে দেয় প্রশান্তি। রাঙ্গামাটির প্রায় ৩৫ ফুট লম্বা ঝুলন্ত সেতু পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। এ সেতুকে ‘সিম্বল অফ রাঙ্গামাটি’ বলা হয়। রাঙামাটি শহরের অনতিদূরে ‘শুভলং ঝর্ণা’ র অবস্থান। প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু শুভলং ঝর্ণা থেকে বিপুল জলধারা আছড়ে পড়ে কাপ্তাই লেকে যা অপরূপ দৃশ্যের সূচনা করে। সুবিশাল কাপ্তাই লেক আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ। একটি দ্বীপে আছে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য চমৎকার ‘পেদা টিংটং’ রেস্টুরেন্ট।
শুধু ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের হাতছানি দেয়। এ জন্য বিভিন্ন স্পট তৈরি করে আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে কাছে ধরা দেয় ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সৌন্দর্য যেন ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। এখানে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে শীত এক রূপে ধরা দেয়, কিন্তু বর্ষায় ধরা দেয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং নবরূপে। শীতে পাহাড় কুয়াশা ও মেঘের চাদরে ঢাকা থাকে, সাথে থাকে সোনালি রোদের মিষ্টি আভা। আবার বর্ষায় চার দিক সবুজের সমারোহে ভেসে ওঠে। এ সময় প্রকৃতি যেনো নতুন যৌবন ফিরে পায়। বর্ষায় মূলত সাহসী অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ট্যুরিস্টদের পদচারণায় বেশি মুখর থাকে এ পার্বত্যাঞ্চল। তখন এখানে ঝর্ণা, হ্রদ কিংবা নদীপথগুলো নতুন রূপে সেজে ওঠে যা দেখার জন্য অসংখ্য পর্যটক ভিড় করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা থাকলেও নিরাপত্তাহীনতা, অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অগ্রগতি নেই পাহাড়ের পর্যটনে। পাহাড় ঘিরে পর্যটন পিপাসু মানুষের আর্কষণ বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা। নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক পর্যটক বেড়াতে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পর্যটন শিল্পকে বাঁচানোর জন্য নানান সময় নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও সাফল্যের মুখ দেখছে না সম্ভাবনাময় এ খাতটি। নানা প্রতিকূলতায় পিছিয়ে রয়েছে পর্যটনের এই বিশাল খাত।
চট্টগ্রামে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ খাতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে কিছু অতি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন: অবকাঠামগত উন্নয়ন, বিমানবন্দর কিংবা যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক বিনোদন কেন্দ্রের সুব্যবস্থা, পর্যটকের জন্য পুলিশ কেন্দ্র স্থাপন করা, বিভিন্ন সময়ে পর্যটন মেলার আয়োজন করা, পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত গাইডের ব্যবস্থা করা, পাঠ্যসূচীতে পর্যটন বিষয়ে কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা, ওয়েবসাইটে প্রচারণা চালানো, পর্যটন বিষয়ে গবেষণার উপর গুরুত্বারোপ করা, পর্যটন এলাকায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানি সরবরাহ সুনিশ্চিত করা, ভালো মানের প্রয়োজনীয় সংখ্যক হোটেল নির্মাণ করা।
সরকারি ও বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে খুলে যাবে চট্টগ্রামের অপার সম্ভাবনার দ্বার।
লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রযুক্তির বিকাশে অপরাধের সঙ্গে পুলিশের চ্যালেঞ্জও বেড়েছে : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধপার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সংস্কৃতির পরিবর্তন