পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সংস্কৃতির পরিবর্তন

ড. আজাদ বুলবুল | মঙ্গলবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ


পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অনিন্দ্য সুন্দর জনপদ। পাহাড় অরণ্য ঝরনাধারা আর লেক শোভিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য নিদর্শন এই জনপদে বাস করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষজন। দশ ভাষাভাষী এগারোটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে অক্ষুন্ন রেখে তিন পার্বত্য জেলার পচিশ উপজেলায় বসবাস করে আসছে। পাহাড় মাড়িয়ে দাপিয়ে বেড়ানো চেঙ্গীঁ মাইনী, কাচালং, কর্ণফুলী, রাইংখিয়াং, শঙ্খ ও মাতামুহুরী নদীর দু’পাড়ে গড়ে উঠেছে অধিকাংশ পাহাড়ি জনপদ। অবশ্য কেউ কেউ নদী তীরের চেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় বসতি স্থাপনে অধিক আগ্রহী। গহীন অরণ্যে, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগে, আধুনিক জীবন যাপনের সুবিধাদি থেকে নিজেদের বঞ্চিত রেখে এক অপার আনন্দে তারা জীবনের স্বাদ খুঁজে নেন আরন্যক পরিবেশে। নিজেদের ক্ষুদ্র ভাষাটিকে আঁকড়ে ধরে,নিজস্ব লোকধর্মের আচারাদি পালন করে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে বহুকাল ধরে তারা আপন সংস্কৃতি সংরক্ষণ করে আসছিলো। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রভাব তাদের আদি সংস্কৃতির মর্মমূলে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতির আগ্রাসন আদিবাসীদের পুরাতন ধ্যান ধারনা আর রীতিনীতিকে বদলে দিতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে। ফলে উপজাতীয় সংস্কৃতির বর্ণিল বর্ণাঢ্য নানা উপকরণ এখন লুপ্তপ্রায়। তাদের সাংস্কৃতিক নানা অনুষঙ্গ বদলে যাচ্ছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। কোনো ধরনের উদ্যোগই এই বদলে যাবার তোড়জোড়কে রুখতে পারছে না।
একদা পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীকে বলা হতো ‘প্রায় যাযাবর’ সে সময় উর্বর জমির খোঁজে অর্থাৎ জুম ভূমির খোঁজে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গমন করতো। পাহাড়ের ঢালুতে জুম চাষের মাধ্যমে উৎপন্ন শস্যাদি দিয়েই চলতো সারা বছরের সংস্থান। বাঁশ কাঠ দিয়ে বানাতো বাসগৃহ। জুমে উৎপন্ন তুলো থেকে সুতো বানিয়ে কোমর তাঁতে বুনে তৈরি করতো পরিধেয় বস্ত্র। পানীয় জলের স্বল্পতা, খাদ্যাভাব, বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ, রোগ-শোক সব কিছুকে তারা নিয়তি হিসাবে মেনে নিতো। কিন্তু এখনকার দৃশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম।
পাহাড়িদের যাযাবর জীবন থেমে গেছে বহু আগে। নিরুপায় না হলে এখন কেউ জুমচাষে আগ্রহী হয় না। পাহাড়ের জঙ্গল কেটে আগুনে পুড়িয়ে বর্ষার প্রথম বৃষ্টির পর ধান, মরিচ, কাপার্স, তিল না বুনে লাগানো হয় আম, লিচু, কাঁঠাল, আনারস, কলাসহ নানা ফলদ গাছ। এতে কষ্টও কম হয় নগদ লাভও উঠে আসে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘আম্রোপালি’ বহু আগেই উত্তরবঙের ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলী আমকে হারিয়ে দিয়েছে স্বাদ, গন্ধ আর মিষ্টতায়।
গৃহায়নের কথা যদি বলি-এইতো কয়েক দশক আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করতো বাঁশ কাঠের মাচাং ঘরে। বুনো প্রাণিদের থেকে রেহাই পেতে মাটি থেকে কয়েক হাত উঁচু এই মাচাং ঘরের ছাউনি দেয়া হতো মুলি বাঁশের তজ্জা নয়তো কুরুক পাতা দিয়ে। ২/৩ বছর পর পর বদলাতে হতো ছাউনি। এখন শ্রমসাধ্য আর স্বল্পায়ু বিবেচনা করে মাচাং ঘর তৈরিতে আগ্রহী নয় কেউ। ইট সিমেন্টের পাকা মেঝে আর লাল সবুজ বাহারি টিনের ঘরের প্রতিই অধিক আগ্রহী পাহাড়িরা।
খাদ্যের বিষয়েও চলে এসেছে নানা পরিবর্তন। এক সময় গৃহস্থ ঘরে অতিথি গেলে প্রথমেই তার দিকে বাড়িয়ে দেয়া হতো পানির কত্তি (জগ বিশেষ), বাঁশের ডাবা (হুক্কা) ও পান সুপারি। আহারের সময় দেয়া হতো সুগন্ধি চালের ভাত, সেদ্ধ শাক, মরিচ ভর্তা, সব্জি তরকারি থাকতো তিতা, টক, কষাটে নানা উপকরণ পাশাপাশি শুটকী নাপ্পির তরকারি। এখন সেসব পুরানো খাবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমিলা চালতার টক,তিতা বেগুন, করোলার জায়গা দখল করেছে মোগলাই খানা। পোলাও, কোর্মা, বিরিয়ানী, রেজালা, কালিয়া নিয়েই এখন কারবার।
পোশাকের কথা যদি বলি চাকমা রমনীরা পরতেন পিনন, খাদি। মারমা নারীরা পরতেন থামি, আংগি। ত্রিপুরাগণ পরতেন রিনাই রিসা। ঐতিহ্যবাহী এই পোশাকের মাধ্যমে তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় বোঝা যেত। বর্তমানে তরুণীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকের চেয়ে সালোয়ার, কামিজ, পাজামা, ফ্রক পরতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। অনেকেই প্যান্ট গেঞ্জি, টিশার্ট পরেন আগ্রহভরে। আর কর্মজীবী মহিলাগণ বাঙালি শাড়িকেই গ্রহণ করেছে অফিসিয়াল পোশাক হিসেবে।
আদিবাসী ধর্মাচারণ পূজা পার্বনেও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। অরণ্যচারী উপজাতীদের সংস্কৃতির যে বিবরণ গবেষকগণ লিখে গেছেন নানা অভিসন্দর্ভে, বাস্তবে সে সব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় চাকমাদের গাং পুজা, থানমানা, মা লক্ষ্মী মা পূজা, সিদ্দি বা শিরনী প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে আধুনিক বৌদ্ধ ধর্মের নান্দনিক প্রভাবে। চাকমা অচাই, বৈদ্য, তান্ত্রিক, গুণিনরাও অপাংতেয় হয়ে গেছে আধুনিক চিকিৎসা আর ঔষধ পত্রের কাছে। মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খিয়াং, চাক, পাংখোয়া উসুই, লুসাই, সব আদিবাসী সমাজেই লেগেছে পরিবর্তনের ঢেউ। বদলের হাওয়া লেগেছে সবকটি সমাজে। পুরাতন রীতি নিয়মকে আঁকড়ে ধরে যারা এখনো টিকতে চান আমরা তাদেরকে পশ্চাৎপদ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন অভিধা দিয়ে সমব্যথী হবার ভান ধরি। উন্নয়নের নামে দারিদ্র্য বাণিজ্য করি। অভাবী ও ক্লিষ্ট মুখের ছবি তুলে দাতা গোষ্ঠীর করুণা ভিক্ষা করি। বৈদেশিক সাহায্যের রমরমা বাটোয়ারায় উন্নয়ন সংস্থার উন্নতি ঘটে। দুর্গম দূররণ্যে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা সংগ্রামী ও অভাবী উপজাতিদের ভাগ্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে না। তেন্যা বা গামছা ফেলে তারা প্যান্ট পরে। সিলুম ফেলে কোর্তা গেঞ্জি গায়ে দেয়। ওয়াংক্লাই, নাফিই ছেড়ে সালোয়ার, পাজামায় অভ্যস্ত হয়। অরণ্যের উদারতা সরলতার মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো চালাকি শেখে, চাতুর্য্য শেখে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি গ্রহণ করতে গিয়ে তাদের মন্দ বিষয়গুলোও আত্মস্থ করে। এভাবেই নব্বই এর দশকে শুরু হওয়া ‘পাহাড়ি সংস্কৃতিকে’ বৃহত্তর সংস্কৃতির সাথে সমন্বিত করার উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কথাসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম: পর্যটনে অপার সম্ভাবনার হাতছানি
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে একাত্তরের দুটি বিক্ষুব্ধ নাট্যসন্ধ্যা