চট্টগ্রামে একাত্তরের দুটি বিক্ষুব্ধ নাট্যসন্ধ্যা

ড. ইউসুফ ইকবাল | মঙ্গলবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ


একাত্তরের পুরো মার্চ মাস বাঙালির জীবনের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও অগ্নিতাড়িত উত্তাল সময়ের শ্রেষ্ঠ সাক্ষী। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভয়-ভীতি ও জীবনের মায়া ত্যাগ করে গর্জে ওঠা সাহসী বাঙালির মহত্তম মাস একাত্তরের মার্চ। এ মাসেই রচিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়। পকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলার আপামর গণ-মানুষ এ সময় প্রচণ্ড উত্তাপে উত্তাল হয়ে ওঠে। যার যা আছে তা-ই নিয়ে মানুষ এগিয়ে এসেছে। শিল্প-সংস্কৃতির সুকোমল মাধ্যমগুলোর কর্মীরাও সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অপরিসীম সাহসে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরা এ সময় পালন করেছে সাহসী ভুমিকা। পুরো মার্চজুড়ে তারা দ্রোহের আগুন ছড়িয়েছেন নাটকের আশ্রয়ে। এ সময় শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দুরন্ত সাহস নিয়ে তারা খোলা মাঠে লক্ষ জনতার সামনে উচ্চারণ করেছে বিক্ষুব্ধ নাট্যসংলাপ।
বাঙালির হাজার বছরের অধিকার ও মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় একাত্তর । একাত্তরের মার্চ সে চুড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতি কাল। মার্চের প্রথম দিনেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৭মার্চে রেসকোর্স মাঠে ভাষণের ঘোষণা প্রদান করেন। এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। অনেকেরই ধারণা ছিল সেদিন বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করবেন। সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মার্চের ৭তারিখ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে প্রদান করেন ঐতিহাসিক ভাষণ। কিন্তু, এ ভাষণে তিনি সরাসরি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেননি। পরবর্তীকালে তিনি বলেছেন, ঘোষণা দিলে পাকিস্তানীরা আক্রমণের যৌক্তিকতা তুলে ধরার সুযোগ পেত। তিনি চেয়েছেন পাকিস্তান আগে আক্রমন করুক- পরে প্রতিরোধে ঝাপিয়ে পড়বে বাঙালি। তবে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি সংলাপে ছিল তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। ভাষণ শেষে তিনি ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সমগ্র ভাষণে খুঁজে পাওয়া যায়- যুদ্ধের পরোক্ষ ঘোষণা, যুদ্ধের কারণ, প্রস্তুতির ধরণ ও মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃত রূপরেখার পরিচয়। এর পর উত্তাল হয়ে ওঠে বাঙালির জীবন। ৭ই মার্চের ভাষণের ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ রাতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত করে পাকিস্তানী বাহিনী। সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার লিখিত ঘোষণা হস্তান্তর করেন। ঘোষণাটি ওয়ারলেস যোগে চট্টগ্রাম এলে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে তা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করে প্রচার করা হয়। সেদিন থেকেই শুরু হয় স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ। বাঙালি ঝপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে।
৭ই মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই ১৮ দিন বাঙালি জাতীর জীবনে সবচেয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কাল। একদিকে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণার স্পষ্ট ইঙ্গিত অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের নির্মম দমন নিপীড়নের আশংকা। সময়ের এই অগ্নিতাড়িত কালখন্ডে চট্টগ্রামে মঞ্চস্থ হয় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার দিকনির্দেশনামূলক দুটি দ্রোহী নাটক। বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণের সম্প্রসারিত নাট্যভাষ্য হিসাবে নাটক দুটো রচনা করেন মমতাজউদদীন আহমদ (১৯৩৫-২০১৯)। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শেষাংশকে শিরোনাম করে নাটক দুটি রচিত। প্রথম নাটক ‘এবারের সংগ্রাম’ রচিত হয় ১৪ মার্চ রাতে। এটি মঞ্চায়িত হয় ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘি মাঠে। দ্বিতীয় নাটক ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ রচিত হয় ২১ মার্চ। এটি মঞ্চস্থ হয় চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দানে- কালরাত্রির আগের দিন, অর্থাৎ ২৪ মার্চ। নাটক দুটিতে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, দমন-নিপীড়ন এবং বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর বাস্তবচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। রচনা ও মঞ্চায়নের সময়কাল বিবেচনা করলে নাটক দুটোর গুরুত্ব ও ভূমিকা সহজেই অনুমেয়। পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের নির্মম দমন নিপীড়নের আশংকা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাটকদুটো মঞ্চায়িত হয়। প্রতিপক্ষের বেয়নেটের সামনে বসে উত্তপ্ত সংলাপে খোলা মঞ্চে প্রকাশ্য প্রতিবাদের এমন নজির বিশ্ব নাট্য-ইতিহাসে বিরল।
মমতাজউদদীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপের মাঝে বসে তিনি নাটক রচনা, নির্মাণ ও পরিবেশন করেছেন। একারণে, মুক্তিযুদ্ধের যুগপৎ আবেগ ও উত্তাপ তাঁর নাটকের সংলাপে প্রবলভাবে প্রবহমাণ। যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব থেকেই তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন মঞ্চে ও ময়দানে। স্বাভাবিক কারণেই তাঁর নাটকে মুক্তিযুদ্ধ ও তার প্রেক্ষাপটটি স্ব-মহিমায় সমুজ্জ্বল। জাতির ক্রান্তিলগ্নটি তিনি বিশ্বস্তভাবে উন্মোচন করেছেন নাটকের ক্যানভাসে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল কালখণ্ডে বসে নাটক রচনা ও খোলামঞ্চে তা প্রদর্শন করে মমতাজউদদীন আহমদ প্রতিবাদী ভুমিকা পালন করেছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা সুবিদিত। চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরাও সে ইতিহাসের গৌরবময় অংশীদার। একাত্তরের অগ্নিতাড়িত উত্তাল কালখণ্ডে বীর চট্টলার ঐতিহাসিক লালদিঘি মাঠে নাটকের মধ্যদিয়ে ধ্বনিত হয়েছিল প্রতিবাদ প্রতিরোধের বিশ্বস্ত ইশতেহার। সেদিন জাতির ক্রান্তিলগ্নে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দেশমাতৃকার স্বপক্ষে তারা উচ্চারণ করেছে জাতীর কাঙ্ক্ষিত সংলাপ। চারদেয়ালের ঘেরাটোপের সীমাবদ্ধ মঞ্চে নয়, একেবারে খোলাপ্রান্তরে আপামর গণমানুষের সামনে অভিনীত হয়েছে নাটক। একাত্তরের উত্তাল মার্চে রচিত ও মঞ্চায়িত ‘এবারের সংগ্রাম’ ও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তার সার্থক উদাহরণ। জাতির ক্রান্তিলগ্নে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মঞ্চস্থ ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে এই দুটি নাটকের বিষয়, চরিত্র এবং মঞ্চায়নের প্রেক্ষাপটসহ পূর্বাপর প্রতিবেশ বাস্তবতার সাম্যক পরিচয় নিচে তুলে ধরা হলো।
একাত্তরের মার্চে দুঃসাহসী এই নাট্যকর্মে নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মীদের সংঘবদ্ধ করার কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে তৎকালীন ‘শিল্পী সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ সংঘ’। এ সংঘ গঠনের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তৎকালীন চাকসু জিএস আবদুর রব। ৮ মার্চ অধ্যাপক আবুল ফজলের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গঠিত হয় উক্ত ‘শিল্পী সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ সংঘ’।
চট্টগ্রামের সকল প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাকামী শিল্পী সাহিত্যিক শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী এ সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সাথে যুক্ত ছিলেন। আত্মপ্রকাশের অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করার লক্ষে ‘শিল্পী সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ সংঘ’ লালদিঘি মাঠে প্রতিবাদী সংগীত ও নাটক পরিবেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মার্চের উত্তপ্ত সময়ে চট্টগ্রামে বসে নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ রচনা করেছেন ‘এবারের সংগ্রাম’।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ‘এবারের সংগ্রাম’ রচিত হয় একাত্তরের ১৪ মার্চ। অভিনীত হয় পরদিন, ১৫ মার্চ সন্ধ্যায়। চট্টগ্রামের লালদিঘি মাঠে লক্ষাধিক স্বাধীনতাকামী জনতার সামনে অভিনীত হয় ‘এবারের সংগ্রাম’। নাট্যকারের উপস্থিতিতে এবং তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
একাত্তরের ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় লালদিঘি ময়দানের পরিবেশ ছিলো টানটান উত্তেজনাময়। লক্ষ প্রতিবাদী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে ময়দান ও তার আশপাশের রাস্তা ছিলো পরিপূর্ণ। সে অগ্নিতাড়িত সন্ধ্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন- “লালদিঘির মাঠ লোকে লোকারণ্য। তখন লালদিঘি মাঠ ছিলো অনেক বড়। মাঠে লোক ধারণের স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রধান রাস্তা, খুরশিদ মহল, বৃটিশ কাউন্সিল ছাদে পর্যন্ত সাধারণ জনগণ। অনেকেই ধারণা করেন তিন লাখের উপর লোক সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন” (ডা. মাহফুজুর রহমান, ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র চট্টগ্রাম, ১৯৯৩, পৃ.২৩৯)।
নাটক, সংগীত ও আলোচনা অনুষ্ঠানের জন্য সেদিন লালদিঘি মাঠে নির্মাণ করা হয়েছিল বিশালাকার মঞ্চ। মার্চের উত্তাল আবহের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মঞ্চ ও আশপাশ সাজানো হয়েছিলো। এতে সমকালীন দ্রোহী চেতনা ছড়িয়ে পড়েছিল দর্শকের মাঝে। ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন-“বিরাট মঞ্চ আকারে ও উচ্চতায়। মঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী রশিদ চৌধুরী ও ডা. কামাল এ খান। সন্ধ্যার পর মঞ্চের পেছনে শয়ে শয়ে মশাল জ্বালান হলো। মশালের আলো ও ধোঁয়া সম্পূর্ণ পরিবেশকে মুহুর্তে দিল পাল্টে। উন্মাদনা ও আগুনের মতো জ্বলে ওঠার এবং জ্বালিয়ে দেবার এক দুর্বার আকাঙ্ক্ষায় জনগণ একতাবদ্ধ” (ডা. মাহফুজুর রহমান, ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র চট্টগ্রাম, ১৯৯৩, পৃ.২৩৯)।
‘এবারের সংগ্রাম’ নাটকের সংলাপ চট্টগ্রামের মুক্তিকামী জনতাকে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মানুষকে জাগিয়ে তোলার যে সুতীব্র শক্তি রয়েছে নাটকের, তার চূড়ান্ত পরিচয় সেদিন ফুটে উঠেছিল। নাটক চলাকালে দর্শক স্বতস্ফূর্তভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। নাটকটির মঞ্চায়ন সম্পর্কে লেখক বলেন- “একাত্তরের পনেরই মার্চ, সন্ধ্যার অন্ধকার মাঠে তখন মশাল জ্বলছে খোলা মঞ্চের চারদিকে। বিদ্রোহী শিল্পীরা লক্ষের অধিক দর্শকের সামনে নাটকটি অভিনয় করলেন। সেই রাতে খোলা মঞ্চের স্বাদ পেয়ে এবং সরল দর্শকের উল্লাস শ্রবণ করে আমার বিশ্বাস আরো গভীর হলো” (মমতাজউদদীন আহমদ, ‘আমার নাট্যভাবনা’, সম্পা. মমতাজউদদীন আহমদ, বিশ্বসাহিত্য ভবন, ঢাকা, ২০০০, পৃ.১০৬)। লালদিঘির মাঠে নাটকটির ঐতিহাসিক প্রদর্শনীর পর পুরো মার্চজুড়ে চট্টগ্রামের শিল্পএলাকা, বন্দরএলাকা, আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় এবং শহরের বাইরে রাঙ্গুনীয়া কলেজ মাঠে পথনাটক হিসেবে নাটকটি প্রদর্শিত হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তি আকাঙক্ষা এবং শাসকবর্গের অত্যাচার ও বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর চিত্র রয়েছে ‘এবারের সংগ্রাম’ নাটকে। পশ্চিম পাকিস্তান শুরু থেকেই পূর্বপাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছে। শাসনের নামে শোষণের মানসিকতাটি এক পর্যায়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের মাঝে স্থানগত বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। আবার সংস্কৃতি, ঐতিহ্যসহ জীবনাচারণেও রয়েছে দূরত্ব। বিভাগোত্তর কালে নতুন করে দেখা দেয় অর্থনৈতিক দূরত্ব। পশ্চিম পাকিস্তানের অনুদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ বঙ্গের উন্নয়ন ক্রমশ বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। পূর্ব বাংলায় বন্যা, ক্ষরাসহ নানামুখী প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও পশ্চিমাদের নির্লিপ্তি ও ঔদাসীন্য ক্রমশ ক্ষুব্ধ করে তোলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ এ বঙ্গের জনগণকে। এ ক্ষোভ সৃষ্টি করে স্বাধিকারের দাবি, স্বাধিকারের দাবি সময়ের অনিবার্যতায় পরিণত হয় স্বাধীনতার দাবিতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাকপ্রস্তুতি অর্থাৎ মুক্তির দাবিতে জনদ্রোহের স্বরূপটি ফুটে উঠেছে মমতাজউদদীন আহমদের ‘এবারের সংগ্রাম’ নাটকে। একাত্তর সালের উত্তাল সময়ে শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নাটকের সংলাপে তিনি যুক্ত করেছেন সংগ্রামী চেতনা। অবশ্য এর জন্য নাট্যকার আশ্রয় নিয়েছেন রূপকের। বাদশা-উজীর-সিপাহসালার প্রভৃতি চরিত্রের মধ্যদিয়ে সামন্তপ্রভু অর্থাৎ পাকিস্তানি শোষকের শোষণ প্রক্রিয়াকে উন্মোচন করেছেন। সেই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকের ঔপনিবেশিক মানসিকতাটিও ফুটে উঠেছে এ নাটকে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে বাঙালির দ্রোহী-চৈতন্যের নাট্যচিত্র মমতাজউদদীন আহমদের ‘এবারের সংগ্রাম’। বাঙালির আত্ম-উপলব্ধি, ঐক্যবদ্ধতা এবং সংঘবদ্ধ সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল হয়ে ‘এবারের সংগ্রাম’ আমাদের নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি সময়ের সামনে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির ঔপনিবেশিক মানসিকতা, শাসনের নামে শোষণের নগ্নরূপ উপস্থাপিত হয়েছে এ নাটকে অত্যন্ত সফলভাবে। শাসকগোষ্ঠীর এই শোষণ-শাসন এবং নেতিবাচক মানসিকতার যাঁতাকল থেকে মুক্তির আকাঙক্ষাই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। মমতাজউদদীন আহমদের ‘এবারের সংগ্রাম’- এ সেই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ বাঙালির মুক্তির আহ্বানই ধ্বনিত হয়েছে সংগ্রামী চেতনার যোগ্য শব্দাস্ত্রে।
মার্চের উত্তপ্ত কালখণ্ডের ২৪ মার্চ- চট্টগ্রামের চকবাজারে- প্যারেড মাঠে অভিনীত হয় ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ । প্রায় ৮০ হাজার দ্রোহীজনতা ছিল এ নাটকের দর্শক। সময়টি জাতীর জীবনের জন্য একটি ভয়াবহ পর্যায়। চট্টগ্রামে এদিন থেকে শুরু হয়ে যায় জনযুদ্ধ। পাকিস্তান থেকে বাঙালি নিধনের লক্ষে পাঠানো সোয়াত জাহাজ ভর্তি অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের মধ্যদিয়ে এ জনযুদ্ধের সুত্রপাত। ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন- “২৪ মার্চ ডক শ্রমিক লীগের উদ্যোগে সোয়াত জাহাজ ঘেরাও হয়। হাতে লোহার রড নিয়ে শত শত শ্রমিক সোয়াত ঘেরাও করে রাখে” (ডা. মাহফুজুর রহমান, ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র চট্টগ্রাম, ১৯৯৩, পৃ.২৪৩)।
‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মঞ্চায়নের দিন বাঙালি নিধনের লক্ষে সোয়াত জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে আনীত অস্ত্র বাঙালি শ্রমিকরা খালাশে বাধাদানের পরিপ্রেক্ষিতে বন্দর এলাকাসহ পুরো চট্টগ্রামজুড়ে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ নাটক মঞ্চায়নের এক দিন পর বর্বর পাকিস্তানি নির্বিচারে হত্যা করেছে নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালিকে। এই দুই ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ে, অর্থাৎ ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের আগের দিন এমন ভয়াবহ সময়ে পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে বক্তব্য নিয়ে জনসমক্ষে নাটক মঞ্চায়ন তৎকালীন নাট্যকর্মীদের দুঃসাহসই বটে। প্রবল স্বদেশপ্রেম এবং দ্রোহীচেতনার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।
নাটকটির প্রদর্শনী চলাকালে সংবাদ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি অস্ত্রবাহী জাহাজ এমভি সোয়াত থেকে অস্ত্র নামাতে বাধা দিচ্ছে জনতা এবং প্রতিরোধকারী জনসাধারণের উপর গুলিবর্ষণ করছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এ সংবাদে তুমুল বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মাঠের দর্শক। নাটক শেষে প্রায় হাজার হাজার দর্শক মিছিল সহযোগে স্বতঃস্ফুর্ত আবেগে ছুটে গিয়ে প্রতিরোধ করেছে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্রখালাসের প্রচেষ্টা। এ নাটকের মঞ্চায়নের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখক বলেন- “স্বাধীনতার সংগ্রাম লিখেছি একাত্তরের একুশে মার্চ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে এ নাটকের রচনা। সেদিন ছিল ২৪ মার্চ। চট্টগ্রাম কলেজ মাঠে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। বন্দরে জ্বলছে আগুন, পথে পথে ব্যারিকেড। দশ সহস্র দর্শক এনাটক দেখে ভীষণ রকম আলোড়িত হয়ে শত্রু চরিত্রগুলোকে ক্ষোভের জ্বালায় জুতো ছুঁড়ে মেরেছে। অভিনয়ের শেষে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে মিছিল করে দর্শক ছুটে গেছে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াতে (মমতাজউদদীন আহমদ, ‘আমার নাট্যভাবনা’, সম্পা. মমতাজউদদীন আহমদ, বিশ্বসাহিত্য ভবন, ঢাকা, ২০০০, পৃ.১০৬)। এ নাটকের অভিনেতা ও চট্টগ্রামের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও নাটকের একনিষ্ঠ কর্মী মাহবুব হাসানও অনুরূপ স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন- “নাটক যে জনসাধারণকে কতখানি উদ্বুদ্ধ করতে পারে তার প্রমাণ এই ২৪ তারিখে দেখেছি। নাটক চলাকালীন সময় তাহের সোবহান খবর নিয়ে এলেন যে- বন্দরে ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে বাধা দিচ্ছে জনসাধারণ। তাই পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি চালাচ্ছে। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে দর্শকদের মধ্যে এবং নাটক শেষে প্রায় দশ হাজার দর্শক স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে মিছিল করে ছুটে গেছে বন্দরে প্রতিরোধে অংশ নেবার জন্য। এ ধরণের ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নাই” (মাহবুব হাসান, ‘চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলন: প্রগতিশীল ধারা’, সম্পা. মাহবুব হাসান, সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত, চট্টগ্রাম, ১৯৯১, পৃ.১০০)। ডা. মাহফুজুর রহমানও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন- “নাটক চলাকালীন সময়ে তাহের সোবহান সংবাদ আনলেন চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্র খালাশে বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তুরেছে। পাকিস্তানিরা গুরি চালিয়েছে- হতাহতের সংখ্যা প্রচুর। মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হলো পরিস্থিতি এবং নাটক বন্ধ করার। কিন্তু জনগণের দাবি এ তো নাটক নয়- এ আমাদের কথা- নাটক চলবে। নাটক শেষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রায় ত্রিশ হাজার জনসাধারণ সেই প্যারেড মাঠ থেকে মিছিল করে বন্দরের দিকে রওনা হলো প্রতিরোধে অংশগ্রহণের জন্য” (ডা. মাহফুজুর রহমান, ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র চট্টগ্রাম, ১৯৯৩, পৃ.২৪০)।
‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটকটিও নাট্যকারের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়। এতে তিনি নিজেও অভিনয় করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকবৃন্দের ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর বিষয়টি মমতাজউদদীন আহমদ-এর নাটকে ঘুরে ফিরে এসেছে। ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটকেও একই বিষয় ভাবনা লক্ষ্য করা যায়।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ‘এবারের সংগ্রাম’ এবং ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটকদুটো মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে রচিত। তাই বিষয়ভাবনা এবং বক্তব্যকথার বিচারে নাটকদুটো প্রায় অভিন্ন। তবে দ্বিতীয় অর্থাৎ ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটকে স্বাধীনতার দাবি অনেক বেশি স্পষ্ট এবং সরাসরিভাবে উঠে এসেছে। সেই সাথে পশ্চিমাদের দমন-নিপীড়নের চিত্রও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটকে অনেক বেশি মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাককালে স্বাধীনতাকামী্ল গণমানুষের মনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তার রচিত এই প্রতিবাদী নাটকদুটি।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে লিখিত ও মঞ্চস্থ এ নাটক দুটোতে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির আকাঙক্ষা এবং শাসকবর্গের অত্যাচার ও বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর চিত্র ফুটে উঠেছে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। নাটকদুটো পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামবাসীর মনে জাগিয়ে তুলেছিলো বিক্ষুব্ধতা, প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার তীব্র-আকাঙক্ষা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় যে দ্রোহীচেতনা এবং নবনাট্যচিন্তার উন্মেষ ঘটেছে- বলা যায়- মমতাজউদদীন আহমদ রচিত এ নাটক দুটো সে চিন্তা-চৈতন্য উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ময়দানে এবং খোলামঞ্চে নাটক দুটো অভিনীত হয়ে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের গণমানুষের মনে সঞ্চার করেছে তীব্র প্রতিবাদী চেতনা। সে সাথে গণমানুষের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে অনিবার্য করে তুলেছে। স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে পথনাটকের মাধ্যমে যে দ্রোহী চেতনা এবং নবনাট্য আঙ্গিকের উন্মেষ ঘটেছে মমতাজউদদীন আহমদের ‘এবারের সংগ্রাম’ ও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নাটক দুটো সে চেতনার পথিকৃত। সময়ের সাহসী উচ্চারণ হিসাবে এবং গণমানুষকে উদ্দীপিত ও সংঘবদ্ধ করতে নাটক ও সংলাপের অপরিমেয় শক্তির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে চট্টগ্রামের লালদিঘি ও প্যারেড মাঠের বিক্ষুব্ধ নাট্যসন্ধ্যা দুটি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : শিক্ষক ও নাট্যগবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সংস্কৃতির পরিবর্তন
পরবর্তী নিবন্ধআরকান রাজ্যে চট্টগ্রামের কবি : বাংলা কবিতার নিঃশঙ্ক স্বাধীন অভিপ্রকাশ