চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার সমস্যা ও উত্তরণের পথ

হাসান মারুফ রুমী | সোমবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

পাহাড়, ঝিরিঝরনা, খাল, নদী ও সমুদ্র নিয়ে অপরূপ সুন্দর চট্টগ্রাম। তার মনোরম প্রকৃতি এ অঞ্চলের মানুষকে করেছে অতিথিপরায়ণ। ঠিক তেমনি সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্জা এখানকার মানুষকে করেছে সাহসী ‘সিনা দি ঠেকাই ঝড় তুফান’ এর মতো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে সামুদ্রিক বন্দর ও বাণিজ্য হাজার হাজার বছর ধরে এ মাটি আকর্ষণ করেছে বিদেশি পর্যটক ও বণিকদের।

কিন্তু দুর্ভাগ্য চট্টগ্রামবাসীর, গত আট মাসে ১২ বার জলাবদ্ধতায় শিকার হয়েছেন। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি যেন সোনার হরিণ। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, নানান ব্যয়বহুল প্রকল্পই যেন সার। প্রকল্পের পর প্রকল্প, ব্যয় বৃদ্ধির পর ব্যয় বৃদ্ধি, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জলাবদ্ধতার প্রকোপ। প্রকল্প ও ব্যয় যত বাড়ছে জলাবদ্ধতা তত বাড়ছেহাঁটুপানি থেকে কোমর ও বুক সমান পানিতে।

চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের কাজ ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে শুরু করে সিডিএ। ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বাজেটের এ কাজ ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা। ৩ দফা সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব দিয়েছে সিডিএ। সেই সাথে বাজেট বৃদ্ধি করে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংশোধিত ডিপিপি প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। সর্বশেষ মার্চ পর্যন্ত ৭৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান কর্তৃপক্ষ।

এ প্রকল্পের অধীনে নগরীর কয়েকটি প্রধান প্রধান সড়ক উঁচু করা হলেও অলিগলি নিচু থেকে যায়। ফলে কোনো কোনো এলাকায় উঁচু রাস্তা ডিঙিয়ে জোয়ার বা বৃষ্টির পানি প্রবেশ করলে তা বের হওয়ার পথ থাকে না। ফলে জলাবদ্ধতা আরো জটিল রূপ লাভ করেছে। কোনো কোনো এলাকায় বাড়ির নিচতলা, দোকান, গুদাম দীর্ঘ সময় পানির নিচে থেকে পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছে।

নগরীর মহেশখাল, চাক্তাই খাল, চাক্তাই ডাইমেশন খাল, মির্জাখাল, ত্রিপুরা খাল, গয়নার ছড়া খাল, ডোমখালী খাল, হিজড়া খাল, বদর খাল, চশমা খাল নোয়াখাল, শিতল ঝরনাসহ ১৮টি খালের খনন, সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে। ৫ বছরের অধিক সময় আগে কাজ শুরু করলেও এখনো ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে না পারা সত্যিই দুঃখজনক। পাহাড় বিধৌত বালি আটকানোর জন্য ৪২টি সিলট্র্যাপ স্থাপনের একতৃতীয়াংশের কাজ শুরু হয়েছে মাত্র।

কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ সিডিএর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। দেশের সর্ববৃহৎ ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাইখাতুনগঞ্জসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউজ স্থাপন এ প্রকল্পের অংশ। তিন দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। শুরুতে এর বাজেট ছিল ২ হাজার ৩১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল একনেকে পাশ হলেও প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর। এ বছর মার্চ পর্যন্ত কাঠামোগত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬৭ শতাংশ।

জলাবদ্ধতা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ইদানীং দায়মুক্ত থাকতে চায়। জলাবদ্ধতা নিরসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে পুরনো প্রকল্প ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বারইপাড়া খাল এখনো শেষ করতে পারেনি চসিক। ৩২৫ কোটি টাকার বাজেটে ২০১৪ সালে হাতে নেওয়া এই প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কাজ হয়েছে মাত্র ৩৫ শতাংশ।

জলাবদ্ধতা নিরসনের আরেকটি প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৬ দশমিক ৬ মিটার উচ্চতায় ২১ কিলোমিটার ফ্লাড ওয়াল বা রিটেইনিং ওয়াল এবং ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর নির্মাণের কাজ। ২০১৮ সালে শুরু হয়েছে ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত শেষ হওয়ার কথা। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সময় বর্ধিত করা হলেও কাঠামোগত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র একতৃতীয়াংশ। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার আপত্তি ও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ করা নিয়েও সংশয় আছে।

২০১৯২০২০ অর্থবছরে জাইকার করা গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহরের ৪১টি ওয়ার্ডে দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ১৮৩০ টন গৃহস্থালি, ৫১০ টন সড়ক ও অবকাঠামগত এবং ৬৬০ টন মেডিকেল বর্জ্য। উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সংগ্রহ করে ২ হাজার টন। বাকি বর্জ্য নালানর্দমা, খালবিল, নদী ও উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকে, যা জলাবদ্ধতার অন্যতম আরেকটি কারণ।

চট্টগ্রাম শহর কেন জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে বারবার : জলাবদ্ধতার সমস্যা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ২০২২ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি জলাবদ্ধতার ৫টি সমস্যা চিহ্নিত করে।

. অতিবর্ষণ ও একই সঙ্গে কর্ণফুলীতে পূর্ণিমার সময় অতিরিক্ত জোয়ার। ২. খালের সংস্কার কাজের চলমান অংশে মাটি থাকার কারণে খাল সংকোচন। ৩. নগরের খাল ও নালা নর্দমা বেদখল। ৪. নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে এবং ৫. নিয়মিত খালনালা থেকে মাটি উত্তোলন না করা।

এছাড়া বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নিয়মিত পরিষ্কার না করার কারণে প্রধান খালগুলোতে ৪০৫০ ভাগ কাদা বা বালি জমে ভরাট হয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগ খালে উপরিভাগে ৩০৪০ সেন্টিমিটার পুরু আবর্জনা জমে আছে।

খালগুলোতে ১৩৪টি অবৈধ প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। সিল্ট ট্যাপগুলোর সবগুলোই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রধান খালগুলোতে প্রায় ৬৫টি কালভার্ট নিচু হওয়ার কারণে পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। বিশেষত বৃষ্টি বা জোয়ারের সময়। খালের উপর নির্মিত শতাধিক কালভার্ট যথাযথভাবে বিন্যস্ত না হওয়ার কারণে পানিপ্রবাহের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।

কোনো কোনো সড়ক উঁচু করার কারণে রাস্তায় দু পাশের পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এর ফলে অলিগলিদোকান, গুদাম ও বাড়ির নিচতলা নিচু হয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরে অবস্থিত পাহাড়গুলো বালুময়। ফলে এর গাছ কাটলে বা নিয়মিত পাহাড় কাটার কারণে বৃষ্টির পানির সাথে পাহাড়ি বালি এসে খালগুলো ভরাট হয়ে যায়। পরিকল্পনার ত্রুটির কারণে অনেক ক্ষেত্রে জলাবদ্ধতা না কমে উল্টে বেড়ে যায়। যার প্রমাণ গত কয়েক বছরের জলাবদ্ধতা।

জলাবদ্ধতা নিরসনে আমাদের প্রস্তাবনা :

. নিয়মিত খাল ও নালা পরিষ্কার করে অবাধ পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা, খাল ও নালার সক্ষমতার পুর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা। আগ্রাবাদ কালভার্ট সক্রিয় করা।

. দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধার ও খনন করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।

. খালের উপর নির্মিত অবিন্যস্ত নিচু কালভার্টগুলোকে যথাযথভাবে বিন্যস্ত ও নিচু কালভার্টগুলো অপসারণ করে যথাযথভাবে পুনঃনির্মাণ করা।

. চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন উৎপাদিত সকল বর্জ্য পরিবেশসম্মত উপায়ে সংগ্রহ ও অপসারণ করে খালনদী ভরাট ও দূষণের কবল থেকে রক্ষা করা।

. ছোটবড় সকল নালা সংস্কার করে পানিপ্রবাহের উপযোগী করে তোলা।

. সকল পাহাড়কে সংরক্ষণ করা। এক ইঞ্চি পাহাড়ও কাটা যাবে না। পাহাড়ে মাটি ধরে রাখতে সক্ষম গাছ লাগানো। পাহাড় দখলের সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং পাহাড়কে দখলমুক্ত করা।

. যথাযথ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা।

. জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে গৃহীত প্রকল্পসমূহের ভুলত্রুটি চিহ্নিত ও সংশোধন করে দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন করা।

. প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থানগুলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

১০. উন্নয়ন, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নাগরিক সেবা এবং বাজেট প্রণয়ন, কর সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ক্ষমতা সমেত শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে আইনী সংস্কার করা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, পরিবেশকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুবিধা বঞ্চিতদের একজন
পরবর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গা সংকটের শেষ কোথায়