সুবিধা বঞ্চিতদের একজন

নন্দিতা চক্রবর্তী | সোমবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

একজন সুবিধা বঞ্চিত ছাত্রের নাম ‘প্রান্ত দাস’। যে অদম্য মনোবলে জয় করে নিতে পেরেছে সব প্রতিকূলতাকে, সব প্রতিবন্ধকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্বপ্ন বুননের প্রথম সোপানে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে। ২০০৫ সালে ভোলা জেলার ‘চকঢোস’ গ্রামে বাবা দরিদ্র কৃষক বাবুল দাস ও মা কৃষ্ণা রানী দাসএর ঘর আলো করে জন্ম নেয় ছোট্ট প্রান্ত। কিন্তু বিধাতা হয়তো সেদিনই তার ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন জীবনের কঠিনতম বাস্তবতাকে। জন্মেই হারালো মাকে। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন যেতে না যেতেই বাবা পুনরায় বিয়ে করে সংসারী হলেন বটে, কিন্তু ছোট্ট প্রান্তএর দায়িত্ব নিতে রাজী হন নি তার সৎমা। দেখাশোনা করবার কেউ থাকে না সেই ছোট্ট শিশুটির।

এমন অবস্থায় ইচ্ছেঅনিচ্ছায় ছোট্ট প্রান্তের দায়িত্ব নেন কাকী ‘রূপালী রানী দাস’। তাদের অভাবের সংসারে বাড়তি একজন শিশু বড় হওয়ার ও ভরণপোষণ অনেকটাই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও তাকে আগলে রেখেছিলেন কাকা ‘সুনীল চন্দ্র দাস’। যখন সে ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগলো তখন শুরু হলো তার ছোট ছোট হাতে এওর ফাইফরমাশ মিটানো, সারাদিন মাঠে গরু চরানো ও দুধ বিক্রি ছিল তার কাজ। এই করেই কাটতে লাগলো তার শৈশব এর সোনালি সময়গুলো। যখন সবাই বই নিয়ে স্কুলে যেতো তখন তার সারাদিন কাটতো রাখাল হয়ে। ছোট্ট শিশুটি এতো পরিশ্রমের পরও গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে গরু বেঁধে বারান্দায় বসে শিক্ষকদের পড়া শুনতো আর নিজেই পড়তো। শিশুটির পড়ালেখার প্রতি এতো আগ্রহ দেখে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দেন। সকালে দুধ বিক্রি আর সারাদিন রাখালের কাজ করেও সে বিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু পরিবার তার পড়াশোনার বিষয় মেনে নিতে পারে না। তখন শুরু হয় তার উপর অত্যাচার, কোনও কোনও দিন ঠিকমতো ভাত জুটতো না, শারীরিক অত্যাচার সবকিছু মিলিয়ে ছোট্ট প্রান্তদিশাহারা অবস্থা। এই দুঃসহ সময়ে শিশু ‘প্রান্ত’ একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে স্থানীয় এক কাঠমিস্ত্রীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু অভাবের সংসারে সে বোঝা হয়ে দাঁড়ালেও মনে মনে তিনি ভেবেছিলেন ছেলেটির জন্য তাঁর কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এই আশায় তিনি প্রান্তকে নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম শহরে কালুরঘাট মোহরা এলাকায় এবং একটা গ্রীল ওয়ার্কশপের কাজ জুটিয়ে দেন। সারাদিন ওয়ার্কশপে কাজের পরেও রাতে সে বই নিয়ে বসতো। যা দেখে দোকান মালিক তাকে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবেন এবং এমন একটা বিদ্যালয়ের খোঁজ করেন যেখানে ছেলেটি পড়াশুনার পাশাপাশি হাতেকলমে কাজ শিখতে পারবে। তাঁর এই ইচ্ছার কথা স্থানীয় ডা. আবুল কাসেম সাহেবকে জানালে তিনি প্রান্তকে সাথে নিয়ে ইউসেপ বাংলাদেশপরিচালিত ‘এ. কে. খান ইউসেপ টেকনিক্যাল স্কুল মোহরা কালুরঘাট চট্টগ্রাম’ এই বিদ্যালয়ে আসেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সারা রাত গ্রীল ওয়ার্কশপে কাজ করেও সকালে যথারীতি বিদ্যালয়ের পড়ালেখা চালিয়ে যায়। শিক্ষকদের সহযোগিতা, অনুপ্রেরণা, প্রেষণা তার সব ক্লান্তি দূর করে তাকে স্বপ্ন দেখাতো সুন্দর আগামীর। যার ফলস্বরূপ সে ‘এস এস সি’ পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ প্রাপ্ত হয় ও সরকারি পলিটেকনিক্যালে পড়বার সুযোগ পায়। যে শিশুটি হারিয়ে যেতো অন্ধকারের গহীনে তার মধ্যেই উঁকি দিলো সম্ভাবনার ছায়া। ইউসেপের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া হাজারো ‘প্রান্ত যারা আজ পরিচিত হয়েছে নিজেদের পরিচয়ে। প্রান্তের জন্যেও রয়েছে তেমনি সোনালি দিনের হাতছানি। যখন প্রতিদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে কোন হারিয়ে যাওয়া কিশোর, ধর্ষিত হচ্ছে শিশু, মাদকের নেশায় অন্ধকারের হাতছানি সেখানে প্রান্তের মতো অভিভাবকহীন, শেকড় বিহীন কেউ কেউ স্বপ্ন বুনছে সুন্দর ভবিষ্যতের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাই সাহস ও মনোবল
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার সমস্যা ও উত্তরণের পথ