ঘুচে যাক প্রদীপের নিচের অন্ধকার

সুবর্ণা দাশ মুনমুন | শনিবার , ২৬ জুন, ২০২১ at ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ

পিতৃতান্ত্রিকতা,পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, নিরাপত্তাহীনতা, পারিবারিক ব্যস্ততা, সঠিক মূল্যায়নের অভাব সত্ত্বেও বাইরের জগতের সঙ্গে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়ছে দিন দিন।
নারী আন্দোলন, নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার এসব শব্দ এখন আর শুধুমাত্র কিছু বিশেষ দিনে বিশেষজনদের মুখে চর্চিত বিষয় নয়। আবার অন্যভাবে বলা যায় আন্দোলন, স্বাধীনতা, অধিকার এসব শব্দের আগে ‘নারী’ শব্দটি এত বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে যে ‘নারী’ শব্দটি নিজেই একটি উপসর্গে পরিণত হয়েছে। নারী আজ তার আপন যোগ্যতা এবং চেষ্টায় ঘরে বাইরে সমান কর্মমুখর।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদ থেকে শুরু করে প্রতিটি দায়িত্বশীল পেশায় এখন নারীরা স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। বর্তমানে জাতীয় সংসদে নারী নেতৃত্ব ১৯.৭%। সারাদেশে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন ১০৬ জন নারী। মোট কর্মরত ইউ এনওদের মধ্যে যার হার প্রায় ২৫ শতাংশ। এছাড়া সরকারের জন প্রশাসনে নারী সচিব আছেন ১০ জন। ৬ জন জেলা প্রশাসক(ডিসি) এবং ১৬ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(এডিসি) নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে।
নারী নেতৃত্ব এবং নারীর এগিয়ে চলার এমন বিস্তৃত তথ্য আমাদের চোখের সামনে থাকলেও কিছু কিছু ঘটনা আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রদীপের নীচের অন্ধকার রয়ে গেছে বরাবরের মতোই। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী কোন বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকেন। কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তারা। দেশের অনেক জায়গায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন নারী কর্মকর্তারা, আর সেখানেই যত আপত্তি সংসদীয় কমিটির। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করেছেন, “বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু হলে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের বাদ রাখতে হবে।” এক্ষেত্রে নারীর বিকল্প হিসেবে একজন পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট বা সমমানের কর্মকর্তা দিয়ে গার্ড অব অনার দেয়ার সুপারিশ করেন তারা।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এ-সুপারিশ সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ-ধরণের সুপারিশ অসাংবিধানিক ও দেশের নারী সমাজের প্রতি অসম্মানজনক বলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের নারী সংগঠন ও নারী নেত্রীরাও। এ-বিষয়ে সংসদীয় কমিটির ব্যাখ্যা হল, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার সময় সংশ্লিষ্ট উপজেলার ইউএনওরা উপস্থিত থেকে ফুলের মালা দেন কিন্তু স্থানীয় এলাকা থেকে অনেক সময় এ-বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়। কেননা ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী যেহেতু নারী ইউএনওরা কবরস্থানে যান না, সে কারণে বিকল্প কোন পুরুষ কর্মকর্তা যেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনারে উপস্থিত থাকেন।
সংসদীয় কমিটির এমন সুপারিশ দেশের সংবিধানের সাথে নিতান্তই সাংঘর্ষিক। যখন সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করে। সংবিধানের ১৯- এর ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ আর ১৯ এর ২ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘নারী বা পুরুষ কারো প্রতি ধর্মীয় বিবেচনায় বৈষম্য দেখানো যাবে না।
সংসদীয় কমিটি যুক্তি দেখিয়েছেন, যেহেতু নারী ইউএনওরা জানাজায় অংশ নিতে পারেন না তাই ‘গার্ড অব অনার’ এর প্রক্রিয়া থেকেও তাদের সরে যেতে হবে কিন্তু জানাজা আর গার্ড অব অনার যে এক বিষয় নয় তা দেশের একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। গার্ড অব অনারের পুরো প্রক্রিয়া থেকে নারী ইউ, এনও দের সরিয়ে রাখার এ-বিষয়টি দেশের সমগ্র নারী সমাজের জন্য অসম্মানজনক। এমনকি খোদ জাতীয় সংসদেই সুপারিশের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষমতাসীন দল ও জোটের সাংসদরা।
আমরা, দেশের সাধারণ নাগরিকরাও চাই এমন বৈষম্যমূলক চিন্তাধারার অবসান হোক। দেশের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর ক্ষমতায়নকে আরও বেশি পাকাপোক্ত করতে এ-সিদ্ধান্তের সামঞ্জস্য বিধান এখন সময়ের দাবী। যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখেছিলেন, একটি উদার সংবিধান, একটি স্বাধীন দেশের জন্যে, তাঁদের শেষযাত্রার শ্রদ্ধা জানানোর রীতিটুকুতে যেন নিয়ম লংঘন না হয় তাঁদেরই রক্তে কেনা সংবিধানের।
রাষ্ট্রযন্ত্রের পাদপ্রদীপের আলোয় যারা নিজ যোগ্যতাগুণে ঔজ্জল্য ছড়িয়ে চলেছেন, তাদের পদাধিকারকেই অগ্রবর্তী বিবেচনায় রাখা হোক। কে নারী আর কে পুরুষ- এমন চিন্তাধারার অচলায়তন ভেঙ্গে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হোক সমতা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবার উপরে মানুষ সত্য
পরবর্তী নিবন্ধঅস্ত্রসহ তিন চোর গ্রেপ্তার