সবার উপরে মানুষ সত্য

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ২৬ জুন, ২০২১ at ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ

১৭ জুন সকালে দৈনিক আজাদী’র শেষের পাতায় তিনজন নির্যাতিত নারীর ছবি ছাপা হয়। প্রথমজন রাঙ্গুনিয়ার সিরাজ খাতুন, দ্বিতীয়জনের কাগুজে নাম পরিমনি, আর তৃতীয় জন ‘ছিন্নমূল’ এর মিনু বেগম। তবে সেদিনের খবরে নির্যাতিত নারীর তালিকায় এই তিনজনই ছিলেন, তা কিন্তু নয়। অন্যদিনগুলোর মতোই এই সংখ্যা অগুনতি। হতাহত, প্রতারিত, নিগৃহীত, নিঃস্ব নারীদের খবরে ঠাসা সংবাদপত্র। খবরের বাইরের খবরের কথা নাইবা বলি।

এই তিন নারী স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। বয়সের ব্যবধানও হয়তো খুব বেশি নয়। তবে আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণে আমাদের সুনাগরিক, যারা নিজেদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলে দাবি করেন তাদের মনে প্রথমা ও তৃতীয়ার জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর গল্প কোন দাগই কাটতে পারে না। মধ্যমা’র গল্পে বুঁদ হয়ে আছে আমাদের স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
রাঙ্গুনিয়ার সিরাজ খাতুন ভালোবেসে মনের মানুষের হাত ধরে ঘর ছাড়েন এক দশক আগে। বিয়ের পরই জানতে পারেন তার স্বামী একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। ফেরার কোন পথ নেই। কোথাও থিতু হতে না পেরে স্বামীসহ আশ্রয় নেন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবিরে। ত্রাণ পেতে সুবিধা হবে মনে করে স্বামীর ইচ্ছেতেই নাম লেখান রোহিঙ্গা শরণার্থীর খাতায়। সন্তানের মা হন দু’দুবার। স্বামী তার শরণার্থীই হোন কি, কপর্দকশুন্য, স্বামীই তো। আর তাই স্ত্রীর ওপর অত্যাচার চালাতে ভুল হয় না। এক সময় মন উঠে গেলে স্ত্রী সন্তাানকে ফেলে চলে যেতেও বাঁধে না তার। রোহিঙ্গা পরিচয়ে দশক পার করে নিঃস্ব হয়ে সিরাজ খাতুন ফিরে আসেন ভাই বেরাদরের কাছে, ফেলে আসা গাঁয়ে। হারানো কন্যাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হবে পরিবার- সে কপাল করে আসেননি সিরাজ। দুই দুইটি সন্তানসহ বসিয়ে বসিয়ে কেইবা খাওয়াবে তাকে! অতঃপর সিদ্ধান্ত হয় ওমানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তাকে। আরব দেশে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে গিয়ে কত শত মেয়ে কফিনে চড়ে ফিরে এসেছে জানার পরও আরব দেশ অভিমুখে মেয়েদের পাঠানোয় কোন ছেদ পড়েনি। রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক কোনভাবেই এ-বিষয়ে কার্যকরী কোন উদ্যোগ নেওয়ার দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না।
ফিরে যাই সিরাজ খাতুনের গল্পে। নাগরিক সুবিধা পাই কি না পাই, টাকা কামানোর জন্য বিদেশ যেতে চাই বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে পরিচয়পত্র- পাসপোর্ট। পাসপোর্টের আবেদন করতে গেলে আঙুলের ছাপ বলে দেয় তিনি একজন রোহিঙ্গা। আর যায় কোথায়? ন’মাসের দুধের শিশুসহ সোজা কারাগারে।
আশার কথা, মানবাধিকার সংগঠন সিরাজের হয়ে লড়ছে। আদালত জামিন মঞ্জুর করেছে। খুব শিঘ্রই তিনি মুক্তি পাবেন। মুক্ত জীবনে সন্তাানদের নিয়ে সসম্মানে ও নিরাপদে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আমরা তাকে দেব কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে ভরসা করতে ভয় হয়।
চিত্রনায়িকা পরিমনির গল্প বোধকরি বাংলাদেশের সতের কোটি মানুষ জানে। তবে গল্পের অন্তরালে প্রতিদিন ডালপালা ছড়িয়ে চলেছে নতুন নতুন গল্প। এইসব গল্পের সূত্র ধরে কোন অতলে পৌঁছে যায় সমাজ তা নিয়ে নানা আশংকা দানা বাঁধে। এঙ ফাইলসের মতো শেষ অবধি সবকিছু অমীমাংসিত থেকে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমাদের অতি উৎসাহী আমজনতা অবশ্য খুব দ্রুত আগ্রহ হারিয়ে অন্য কোন বিষয়ে বুঁদ হয়ে যাবে। বলাবাহুল্য মেয়ে বিশেষত, রূপালী পর্দার নায়িকা বলেই রঙ মাখানো খবর ও ছবি নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই জনতার। অনেকে আবার মুখিয়ে আছে কোন না কোনভাবে তাকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে মুখোস পরা অনেক সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের বাঁচিয়ে দিতে। এই মুহূর্তে পরিমনি প্রসঙ্গ জাতীয় পর্যায়ে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। খোদ জাতীয় সংসদেও আলোচিত হচ্ছে। আইন তার নিজের গতিতে চলুক।
এ পর্যায়ে ‘ছিন্নমূল’ এর মিনু বেগমের গল্পটা শোনা যাক।
বায়েজিদ- ফৌজদারহাট লিংক রোডের পাশে ছিন্নমূল মানবসন্তানদের আবাসভূমি, যাকে কাগজে কলমেও ‘ছিন্নমূল’ বলে ডাকা হয়। সেখানে স্বামী সন্তান নিয়ে কোনমতে জীবনযাপন করছিল মিনু। প্রতিবেশী মর্জিনা চাল ডালের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যায় এক জায়গায় আর বলে দেয় কিছুদিনের জন্য ‘কুলসুম’ নাম নিতে। কোন এক কুলসুম ‘পোশাক শ্রমিক কোহিনুর হত্যা মামলায়’ অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড পেয়েছিল। কৌশলে মিনুকে কুলসুম সাজিয়ে পাঠানো হয় কারাগারে। ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রের গল্প সত্যি হয় এমনি করে! ‘আয়নাবাজি’র আয়না স্বেচ্ছায় এবং মেলা অর্থের বিনিময়ে আইনের চোখে ধুলো দিয়ে অন্যের হয়ে কারাবাস করত। বলা যায়, এটাই ছিল জীবনযুদ্ধে বারবার হেরে যাওয়া আয়না’র পেশা। কিন্তু ছিন্নমুলের মিনু ফাঁদে পড়ে যায়, যাপন করে হাজতজীবন। আইনের উর্দি পরা কর্মীগণ কুলসুমের খোঁজে এসে ধরে নিয়ে যায় ‘নকল কুলসুম’ মিনু কে। মিনুর স্বামী তিনটি সন্তানের কোন দায়িত্ব না নিয়ে চলে যায় অন্য কোথাও। সন্তানরা বড় হতে থাকে এতিমখানায়।
অবশেষে উচ্চ আদালতের এক আইনজীবীর কাছে ধরা পড়ে গোঁজামিল। ততদিনে মিনুর জীবন থেকে হারিয়ে যায় তিন তিনটি বছর। স্বামী পালিয়ে দায়মুক্ত হয়েছে। এক শিশুপুত্র মরে বেঁচেছে। নিবেদিতপ্রাণ আইনজীবীর ছোটাছুটির ফলে অবশেষে ঘোষিত হয় মিনুর মুক্তির বারতা। আদালত নির্দেশ দেয় প্রকৃত কুলসুমকে খুঁজে বের করতে। এতবছর পর রহস্য উন্মোচিত হলেও ধোঁয়াশা কাটে না। আসল কুলসুম কিন্তু থানা-পুলিশ কিংবা আদালতের কাছে একেবারে অচেনা নয়। হত্যা মামলার প্রথম পর্যায়ে দু’বছর জেল খেটে জামিনে মুক্তি পেয়েছিল সে। ন’বছর পর কুলসুমের এভাবে বদলে যাওয়া কারও চোখেই ধরা পড়েনি! অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একজনের অপরাধের সাজা মাথায় নিয়ে অন্যজনের কারাভোগের ঘটনা আমাদের দেশে এই প্রথম নয়, হয়তো এই শেষও নয়।
সিরাজ খাতুন ও মিনু বেগমের গল্প আমাদের সমাজে চলমান বহুমুখী অসংলগ্নতার সাক্ষ্য দেয়। দারিদ্র ও বিচারহীনতার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে রচিত হয় অসহনশীলতা ও অমানবিকতার উপাখ্যান। একজন সিরাজ কিংবা একজন মিনু নয়, আমাদের সমাজে সবার অলক্ষে জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য সিরাজ ও মিনু। মানবাধিকার কর্মী কিংবা মানবিক আইনজীবীর চোখ এড়িয়ে যায় অনেক ঘটনা। তাছাড়া মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানবাধিকার কর্মী ও নিবেদিতপ্রাণ আইনজীবীই বা ক’জন আছেন আমাদের সমাজে, যারা সিরাজ মিনুদের দুর্ভোগের বৃত্তান্ত খুঁজে বেড়াবে, তাদেরকে আলোর দিশা দেখাবে! আমাদের মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী সুশীল নাগরিকগণ এসব খবরে তেমন উৎসাহও বোধ করেন না। অপরাধবান্ধব সমাজে বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে কুলসুমদের যেমন বাঁধে না, তেমনি বাঁধে না আমাদের সমাজের বিবেক বলে খ্যাত উঁচুতলার বাসিন্দাদের। সমাজবিরোধী মানব সন্তানেরা শোভন পোশাকে সজ্জিত হয় সমাজ অধিপতি সেজে থাকেন আর সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। জনপ্রতিনিধিগণতো কোন সমস্যার অস্ত্বিত্ব আছে বলেই মনে করেন না। আর তাই পরিমনির খবর ‘ভাইরাল’ হলেও রাঙ্গুনিয়ার সিরাজ খাতুন কিংবা ছিন্নমুলের মিনু বেগমের খবর আমাদেরকে মর্মাহত করে না। আমরা আস্ফালন করে যাই ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধির, বস্তুগত উন্নয়নের, উচ্চশিক্ষার ঊর্ধ্বগতির, আধুনিকতার, সর্বোপরি নারীর ক্ষমতায়নের। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে যে-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সুবিচারের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল তা থেকে ধীরে ধীরে অনেক দূরে সরে এসেছি আমরা। আর্থ-সামাজিক অবস্থান দেখে মানুষের গুরুত্ব ও মর্যাদা নির্ধারণ করার এই প্রাগৈতিহাসিক ধ্যানধারণার অবসান হওয়া বড় প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে চিকিৎসক সংকটে সেবা ব্যাহত
পরবর্তী নিবন্ধঘুচে যাক প্রদীপের নিচের অন্ধকার