গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি চাই

রেজাউল করিম স্বপন | সোমবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি সংকট। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ও রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ করায় বিশ্বে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ রাশিয়া বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম তেল ও ২য় বৃহত্তম গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশও প্রচণ্ড জ্বালানি সংকটে পড়ে যায়। যা সামাল দিতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। উচ্চতর মূল্যের জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে কৃচ্ছতা সাধনের পথ বেছে নেয়।
বাংলাদেশের প্রধান জ্বালানি হলো তেল, গ্যাস ও কয়লা। দেশে তেল ও গ্যাস যানবাহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পে ব্যবহৃত হয়। আর কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানির মধ্যে বাংলাদেশে গ্যাসের প্রচুর মজুদ আছে বলে দেশি বিদেশি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সেজন্য দেশে গ্যাস ভিত্তিক প্রচুর শিল্প কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা ও গ্যাসক্ষেত্রের যথাযথ জরিপ ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সারাদেশে গ্যাস মজুদের সঠিক হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি।এটি একটি বড় ব্যর্থতা। কারণ গ্যাসের সঠিক অনুসন্ধান ও উত্তোলন না করে গ্যাস আমদানির দিকে ঝুঁকে আমরা অর্থনীতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছি। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গ্যাসের অভাবে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প কারখানা উৎপাদন করতে পারছে না। দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট, সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭৫ কোটি ঘনফুট। আমদানিকৃত এলএনজি থেকে সরবরাহ করার কথা ৮৫ কোটি ঘনফুট। কিন্তু স্পট মার্কেটে দাম বাড়ায় সরবরাহ করা হচ্ছে ৪৫ কোটি ঘনফুট।
বিগত ২০২১ সালে শুধু বিদ্যুৎখাতে এলএনজি সরবরাহের জন্য সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ৬ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এলএনজি ভিত্তিক ৬ হাজার ৪৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১১ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এই ভর্তুকি দিতে হয়। প্রশ্ন হলো এলএনজি ভিত্তিক ১১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার প্রয়োজনীয়তা ছিলো কিনা? কারণ পণ্য হিসাবে এলএনজির বাজার অনুমান করা কঠিন। জ্বালানির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসাবে এলএনজি আমদানিকে বিবেচনা করা সঠিক নয়, বিশেষ করে বিদ্যুৎখাতে। এদিকে সিপিডির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থ বছরে প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) এলএনজি আমদানিতে খরচ হয়েছে ৩১ টাকা ৫৩ পয়সা। আর বিদ্যুৎখাতে প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি করা হয় ৪ টাকা ৪৫ পয়সায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে খরচ বাড়বে ৭২%। গড়ে প্রতি ইউনিট এলএনজি কিনতে হবে ৩৪ টাকা ৩৭ পয়সায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখন চাহিদার ৪২% গ্যাস পাচ্ছে। তবে ক্যাপটিভে (শিল্পে নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুৎ) চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস দেয়া হচ্ছে। ডিসেম্বর’ ২০২১এ এলএনজির দাম স্পট মার্কেটে ৫ ডলার থেকে বেড়ে ১২ ডলার হয়ে যায় এবং জানুয়ারি’ ২২ এ ৩০ ডলার হয়। উচ্চ মূল্যের এই জ্বালানি বনেদি বা বিত্তশালীদের জ্বালানি হিসাবে পরিচিত। নিজস্ব জ্বালানি সম্পদের অভাবে জাপান ও কোরিয়া এটি আমদানি করে তাদের জ্বালানি চাহিদা মিটিয়ে থাকে। তবে গ্যাস সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ২০১৮ সালে যখন এলএনজি বাজারে ক্রেতা হিসাবে ঢুকে তখন দেশীয় বিশেষজ্ঞদের অনেকেই নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন না করে উচ্চ মূল্যে এলএনজি আমদানির বিপক্ষে মত দেন। তাদের যুক্তি ছিলো দীর্ঘমেয়াদে এটা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশ দেশীয় গ্যাসে চাহিদা পুরণ করে। এরপর গ্যাসের চাহিদা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান তৈরি হয়ে সংকট তৈরি হয়। এর সহজ ও যৌক্তিক সমাধান ছিলো দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন। অথচ কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে উদ্যোগ না নেয়ায় সহজ সুযোগ নষ্ট হয়।
এদিকে পেট্রোবাংলা নিজেই প্রক্ষেপণ করেছে, ভবিষতে গ্যাসের চাহিদা বাড়বে ও উৎপাদন কমবে। কিন্তু অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি, আমদানিতে জোর দিয়েছে। সেজন্য গ্যাসের সরবরাহ কমার সংকট অবহেলা জনিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, গত ২২ বছরে গড়ে ১টি অনুসন্ধান কুপ খনন করা হয়েছে, যা না করার মত। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, স্থলভাগে ৩ ভাগের ২ ভাগ ও সমুদ্রের পুরোটা এখনো অনুসন্ধানের বাহিরে। অথচ দেশীয় উৎস হতে গ্যাস অনুসন্ধান, উৎপাদন ও সরবরাহের জোর দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো। বলতে দ্বিধা নেই, বিগত এক দশকে দেশে বিদ্যুৎ খাতে যে সাফল্য এসেছে গ্যাসখাতে তার ছিটেফোঁটা ও নেই। অথচ গ্যাস বাংলাদেশের প্রধানতম জ্বালানি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকার পরও প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের বেশির ভাগ নির্ভর করে আমদানিকৃত জ্বালানির উপর। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ছিলো ৯০% যা ২০২২ সালে নেমে এসেছে ৫০%। কারণ দেশে গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের মূল্য ২-৩ ডলার। আর এলএনজির মূল্য প্রায় ৫০ ডলার। এরপর ও পেট্রোবাংলা গ্যাস অনুসন্ধানে মনোযোগী হতে পারছে না। যদিও তারা ২০০৯ সালে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নের জন্য গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (জিএফআই) নামে একটি ফান্ড গঠন করেছিলো। যাতে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত জমা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। তবে সমপ্রতি এলএনজি আমদানির জন্য এই তহবিল থেকে ২০০০ কোটি টাকা ঋন নিয়েছে পেট্রোবাংলা। গতবছর এই তহবিল থেকে ৩০০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তাই সরকারকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন পথে যাবে তারা? মনে রাখতে হবে দেশীয় জ্বালানি জোগান ব্যবস্থাপনার ধারা স্বনির্ভর ও সাশ্রয়ী আর আমদানি করা জ্বালানির যোগান ব্যবস্থাপনা পরনির্ভরশীল ও ব্যয়বহুল। তবে বিগত ২০ বছরে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে যে ধারা চলছে তাতে নিজস্ব জ্বালানির উপর হঠাৎ করে নির্ভরতা বাড়ানো অসম্ভব। অথচ স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে সরকার বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেল অয়েলের কাছ থেকে তাদের আবিষ্কৃত ও পরিচালিত ৫টি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র কিনে নেয়। আজও এসব গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাস আমরা স্বল্প মূল্যে ব্যবহার করছি। বর্তমানে দেশে গ্যাস সরবরাহের একচেটিয়া আধিপত্য মার্কিন শেভরন তেল কোম্পানির যা দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ৫০%। গ্যাস সরবরাহে একটি ব্লকের কুপ ও কোম্পানির আধিপত্য থাকা ঠিক নয়। কারণ কোনো কারণে ঐ স্থানে কোনো সমস্যা হলে দেশে গ্যাস সরবরাহে ধস নেমে আসবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প কারখানায় উৎপাদন মারাত্মক ব্যহত হবে। দেশের সবচেয়ে বেশি মজুদ থাকা তিনটি গ্যাস থেকে কমছে গ্যাস উৎপাদন। তুলনামূলক কম মজুদ থাকা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে বেড়েছে কয়েক গুণ উৎপাদন। কারিগরি পরিকল্পনা ও দক্ষ প্রযুক্তির ব্যবহার না হওয়ায় মজুদ থাকার পরও উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এরজন্য জ্বালানি বিভাগের অবহেলা ও অদক্ষতাই দায়ী। তবে কর্মকর্তাদের অভিমত হলো, তেল গ্যাস অনুসন্ধান কাজে গতি না থাকায় নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করা যাচ্ছে না।
দেশে বর্তমানে ২৮ টি গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। গ্যাস মজুদের দিক থেকে সবচেয়ে বড় গ্যাস ক্ষেত্র তিতাস থেকে দৈনিক উৎপাদন ৪১০ মিলিয়ন ঘনফুট। ৫০ বছর ধরে উৎপাদনে থাকা এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে গত জুন পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ৫ হাজার ১৮৬ বিলিয়ন ঘনফুট। বাকী আছে আরো ২ হাজার ৬৯৬ বিলিয়ন ঘনফুট। দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস ক্ষেত্র কৈলাসটিলা থেকে গত মার্চ পর্যন্ত উৎপাদন করা হয়েছে ৭৮৮ বিলিয়ন ঘনফুট। আরো মজুদ আছে ১ হাজার ৯৭০ বিলিয়ন ঘনফুট। এতে দৈনিক উৎপাদন ৬৮ মিলিয়ন ঘনফুট। রশিদপুর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত উৎপাদন করা হয়েছে ৬৮৩ বিলিয়ন ঘনফুট। আরো মজুদ আছে ১ হাজার ৭৫০ বিলিয়ন ঘনফুট। এতে দৈনিক উৎপাদন ৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট।
তবে গ্যাস মজুদের দিক থেকে ৪র্থ হলেও উৎপাদনে শীর্ষে আছে বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র।তারা ২৭টি কুপ হতে দৈনিক উৎপাদন করে ১ হাজার ২৩৫ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস। বর্তমানে এই গ্যাস ক্ষেত্রে মজুদ আছে ৭৬৪ বিলিয়ন ঘনফুট। তবে কুপ খননের কাজ আরো বেগবান হলে উৎপাদন বাড়তো। ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে মোট ৫০টি উন্নয়নকুপ খনন করা হয় যার মধ্যে ২২টি করেছে বহুজাতিক কোম্পানি ও বাকীগুলো করেছে দেশীয় কোম্পানি। তাই বলা যায়, গ্যাস অনুসন্ধানের জরিপ ও উত্তোলনের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক ছিল না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধচালের বাজার নিম্নমুখী
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়া থেকে শিয়াল ধরে এনে মাংস বিক্রি