গরম তেলের ঝলসানি

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ৫ জুন, ২০২৩ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

উহ্‌, মাগো! চোখে কিছুই দেখছি না। কাঁধ, মাথা, গলা, নাকমুখ সব গরমে ঝলসে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে গরম হেভিঅয়েলের তীব্র গন্ধ ও চিট্‌িচটে ভাব সারাগায়ে জড়িয়ে আছে। আমি এক দৌড়ে ইঞ্জিনরুম থেকে বের হয়ে, জাহাজের একোমোডেশানের একটা কমন বাথরুম পেয়ে সেটায় ঢুকে পানির ট্যাপ ছেড়ে ফ্লোরের উপরেই শুয়ে গেলাম। দুতিন মিনিটের জন্যে মনে হয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম; চোখ মেলে দেখি আমার মুখের সামনে উদ্বিগ্ন হয়ে অনেকেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। চিফঅফিসার আর সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার আমাকে ঝাঁকানি দিয়ে জেগে রাখানোর চেষ্টা করছে; আর খুব আলতো করে আমার গা থেকে গরম তেল সরানোর চেষ্টা করছে। কয়েকজন মিলে অনেক অনেক সাবধানে ওয়ানপিস্‌ বয়লারস্যুটটা শরীর থেকে খুলবার চেষ্টা করছে। আমি ব্যথায়যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। তারাও ঠিক বুঝছে না, কোথায় ধরলে আমি ব্যথা পাবো, পাবো না।

১৯৯০ সালের অক্টোবরের ৮ তারিখ। আমি তখন তেলের ট্যাঙ্কার এম টি ইয়াহ্‌রে প্রিন্স (M.T. Jahre Princeএ থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করি। নরওয়ে থেকে রওনা দিয়ে নর্থআটলান্টিক পাড়ি দিয়ে অ্যামেরিকায় টেক্সাসের দিকে যাচ্ছি। খুবই সুন্দর একটা নির্বিঘ্ন ভয়েজ চলছিলো, জাহাজটা অ্যামেরিকার কাছাকাছি চলে এসেছে, দুই কি তিনদিনের মাথায় আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাবো। হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেলো। আমার শরীর গরম তেলে ঝলসে গেলোজীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেলো।

প্রথমে জাহাজে তেলের ব্যাপারে একটু বলে নেই। লুবঅয়েল (পিচ্ছিল করার জন্যে ব্যবহার হয়); আর হাইড্রোলিকঅয়েল (হাইড্রোলিকমেশিনারিজ চালানোর জন্যে এর প্রেসার দিয়ে কাজ করানো হয়) এই দুই অয়েল নিয়ে বলছি না। জ্বালানি তেলের কথা বলতে চাই, কারণ আমার এক্সিডেন্টটা হয়েছিলো জ্বালানী তেল থেকেই। জাহাজে দুই ধরনের জ্বালানি তেল ব্যবহার হয় মেরিনডিজেল অয়েল এবং হেভি ফুয়েল অয়েল। মেরিনডিজেল বললাম এই কারণে যে, গাড়িট্রাক বা অন্য অনেক কিছুতে যেই ডিজেল ব্যবহার করে, জাহাজে তার থেকেও নিম্নমানের (কম পরিশোধিত ও সস্তা) ডিজেল ব্যবহার করা হয়। নিম্নমানের ও সস্তার ডিজেল বললাম বটে, কিন্তু হেভীঅয়েল তার থেকেও খারাপ যাচ্ছেতাই একটা জিনিস। ডিজেল তো তাও রিফাইনারিতে ডিস্টিলেশান করে পরিশোধিত করা হয়। কিন্তু, সেই ডিস্টিলেশান করার পরে যেই গাদ বা তলানীটুকু পড়ে থাকে, যার থেকে আলকাতরা বানানো হয় হেভি অয়েল হচ্ছে সেটারই সমগোত্রীয়। তার মানে বুঝতেই পারছেন কি জঘন্য একটা জিনিস। দামে মেরিনডিজেলের থেকেও সস্তা সঙ্গে মিশানো থাকে বালু, পানি, সালফার, ভ্যানাডিয়াম, সিলিকেট প্রভৃতি ক্ষতিকারক কেমিক্যাল। এগুলো খনি থেকে তেল আহরণের সময়ে স্বাভাবিকভাবেই মিশে থাকতে পারে; কিন্তু কিছু কিছু মুনাফালোভী তেল কোম্পানি, এরপরেও বালুপানি মিশায় বুঝতেই পারছেন কেনো। আর এসমস্ত কারণেই হেভিঅয়েল জ্বালালে পরিবেশের বেশ ক্ষতি হয়।

জাহাজের ইঞ্জিন dual-fuel ইঞ্জিন, ডিজেল আর হেভিঅয়েল দুই তেলেই চালানো যায়। স্বাভাবিকভাবেই খরচ কমানোর জন্যে হেভিঅয়েলেই চালানো উচিৎ। কিন্তু, আগেই বলেছি পরিবেশের ক্ষতির কথা তাই অ্যামেরিকাসহ অনেক দেশই আজকাল তাদের সমুদ্রসীমার মাঝে ঢুকলে, জাহাজে হেভিঅয়েল জ্বালানোর ব্যাপারে কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গভীর সমুদ্রে, উন্মুক্ত বাতাসে জ্বালানো যাবে। পরিবেশরক্ষা ছাড়াও, টেকনিক্যাল আরেকটা ব্যাপার রয়েছে। উন্মুক্ত সমুদ্রে জাহাজ ফুলস্পিডে সোজা চলছে, কোনো আকস্মিক পরিবর্তন নাই। কিন্তু বন্দরের কাছে আসলে, বা সরু নদীপথে ঢুকলে, জাহাজের স্পিড উঠানামা করাতে হয়, সামনেপিছে, ডাইনেবাঁয়ে নিতে হয় (জাহাজের ভাষায় ম্যানুভারিং)। তখন হেভিঅয়েলে চালালে ইঞ্জিনের ভীষণ ক্ষতি হতে পারে। তাই ম্যানুভারিংএর আগেই, জাহাজ চলন্ত অবস্থাতেই ধীরে ধীরে হেভিঅয়েল থেকে ডিজেলে বদলে দেওয়া হয়।

শুধুমাত্র ইঞ্জিন নয়, জাহাজের বয়লারও চলে হেভিঅয়েলে। আগেকার যুগের স্টিমশিপ বয়লার দিয়েই চলতো সেটাই ছিলো প্রধান চালিকাশক্তির উৎস। মডার্ন জাহাজ ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে চললেও, প্রায় সব জাহাজেই একটা করে বয়লার থাকে। বিশেষ করে অয়েল ট্যাঙ্কারে বয়লার খুবই প্রয়োজনীয়। স্টিম দিয়ে অনেক কিছুই করা হয় পানি গরম, তেল গরম, ট্যাঙ্কারের স্টিমটারবাইন পাম্প চালানো ইত্যাদি। আজকালকার যুগে কয়লা দিয়ে বয়লার চালানো হয়না, সেগুলোও চলে ডিজেল বা হেভিওয়েল পুড়িয়ে। আগেই বলেছি হেভিঅয়েল বেশ ভারী, গাদের মত বা আলকাতরা। সিটি কর্পোরেশান যখন রাস্তা মেরামতের জন্যে আলকাতরা ব্যবহার করে তখন দেখেছেন নিশ্চয়ই তারা আগুন জ্বালিয়ে সেটাকে গরম করে করে কিছুটা তরল করে নেয় ঢালবার সুবিধা হয়। জাহাজেও হেভিঅয়েলকে সেরকম গরম করে নিতে হয় প্রায় ১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খুবই গরম। তাহলে বুঝতেই পারছেন, আমি সেরকমই ১০০ ডিগ্রিরও বেশী গরম তেলে পুড়েছিলাম।

অন্যান্য সবদিনের মতই, সেদিনও ইঞ্জিনরুমে কাজ করছি। হঠাৎ উপরে ছাদের দিকের একটা হেভিঅয়েলের পাইপ বার্স্ট করে গরম তেল গলগল করে আমার উপরে পড়লো। কথায় বলে wrong time wrong place; আমারও ক্ষেত্রে তাই হয়েছিলো। যেই স্পটে দাঁড়িয়ে কাজ করছিলাম; ঠিক তার উপরেরই একটা পাইপ বার্স্ট করলো। প্রধান ধারাটা পড়েছিলো আমার বাম কাঁধ আর গলার দিকে; সেখান থেকে সারামুখে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছিটকে ছিটকে পড়েছিলো। প্রথম ধাক্কাটা একদম ছুরির ফলার মত লেগেছিলো, এরপরে আমার আর কোন অনুভূতি ছিলো না। পাগলের মত চিৎকার করে দৌড়ে সেই যে বাথরুমে পানির ট্যাপের তলায় শুয়ে গেলাম; এরপর আমি আর নিজেকে নিজে রাখিনাই। জাহাজের অন্যরাই আমার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলো।

ইতিমধ্যে, সারা জাহাজেই খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিলো। জাহাজে চঅ (পাবলিক এড্রেস) সিস্টেম খুবই ভালো। দিকে দিকে স্পিকার আছে, সব রুমে রুমে ফোন আছে, প্রায় সকলের সঙ্গেই ওয়াকিটকি আছে। ইমার্জেন্সিতে তো অবশ্যই, অন্য যে কোনো ব্যাপারেই গণহারে এনাউন্সমেন্ট করাটা খুবই সহজ, এবং মিনিটেই সকলে অবহিত হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে তাই সকলেই দৌড়ে এসেছে আমার কাছে, কে কীভাবে সাহায্য করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে। আমার বিপদে, তাদের উৎকণ্ঠিত চেহারা আমার আজও মনে আছে। গভীর সমুদ্রে একঘেঁয়ে দিনগুলোর মাঝে এরকম হঠাৎ করে একটা ঘটনা (দুর্ঘটনা) ঘটে যাওয়ায়, জাহাজের সকলেই ত্রস্তব্যতিব্যস্ত। জাহাজে, ক্রু এবং অফিসার সব মিলিয়ে, আমরা মাত্র বিশপঁচিশজন। দিনের পর দিন সেইল করলে, নিজেদের মধ্যেই একটা অন্যরকম আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে, যেখানে জাতধর্মবর্ণ কিছুই বাধা মানে না। আমরা সকলেই তখন সকলের আপন একটা পরিবার। সেই মুহূর্তে, আমি সেটা অন্তর থেকে অনুভব করতে পারছিলাম। তার উপরে জাহাজে ছিলো দুইজন মহিলা ক্যাপ্টেন এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী। জাহাজের বাইরেও খবর পাঠানো শুরু হলো কোম্পানির হেডঅফিস, অ্যামেরিকায় কোম্পানির লোকাল এজেন্ট, সবচেয়ে কাছের পোর্ট সবদিকেই। ইমার্জেন্সিতে কী হতে কী হয়, কেউই জানে না। আমার অবস্থার অবনতি ঘটলে যাতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

গভীর সমুদ্রে হুট করে তো আর ডাক্তারনার্স পাবেন না। ম্যুভিসিনেমায় হয়তো দেখে থাকবেন, প্যাসেঞ্জার ক্রুজশিপে ডাক্তার থাকে; কিন্তু কার্গোশিপে একজন ফুলটাইম ডাক্তার রাখা অনেক খরচের। মেরিনাররা সবকিছুতেই অত্যন্ত দক্ষ না হলেও, অনেক কিছুই জানা থাকতে হয়। সকলকেই অল্পকিছুটা হলেও মেডিক্যাল ট্রেনিং নিতে হয়, যাতে করে সাধারণ ফার্স্টএইডের চাইতেও একটু বেশী চিকিৎসা করতে পারি। প্রায় জাহাজেই একটা মেডিক্যাললকার থাকে যেখানে অনেক ঔষধপত্রই থাকে, রেগুলার ফার্স্টএইডের উপরেও অন্যান্য অনেক ইমার্জেন্সিতেও যাতে কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। মেডিক্যাললকার ছাড়াও, কোনো কোনো জাহাজে একটা স্পেয়ার কেবিন থেকে, যেটাকে হাসপাতাল বা sick-ba হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সেকেন্ডঅফিসার মেডিক্যাললকারের দায়িত্বে থাকে। ছোটখাটো অসুখবিসুখে, জ্বরসর্দিকাশি ইত্যাদিতে সেইই ঔষধ দেয়। এখন আমার অবস্থা অনেক অনেক শোচনীয়।

অনেক কষ্টে, কয়েকজন মিলে ধরে, সাবধানে আমাকে আস্তে আস্তে তুললো। কিন্তু, এরপরে কী হবে? আমাকে তো উপরে একোমোডেশানে তুলতে হবে। সমুদ্রগামী জাহাজগুলো প্রায় দশবারোতলা বিল্ডিংএর মতই; এবং সেযুগে জাহাজে লিফট ছিলোনা। নীচের সাতআটতলা হলো ইঞ্জিনরুম (যার তিনচারতলা সবসময়েই পানির তলে থাকে); আর উপরের তলাগুলোতে আমাদের কেবিন (একোমেডেশান)। সবচেয়ে উপরে জাহাজ চালানোর জায়গা নেভিগ্যাশানাল ব্রিজ। আমার এক্সিডেন্ট তো হয়েছে ইঞ্জিনরুমে; আমি ব্যথায় কান্ডজ্ঞান হারিয়ে, দৌড়ে দুই তলা উঠে এসেছিলাম। এখন সকলের দুশ্চিন্তা কীভাবে আরো ছয়সাততলার সিড়ি ভেঙ্গে উপরে সিকবে পর্যন্ত নিয়ে যাবে। কোথায়ও ঘষা খেয়ে, বা অন্য কোনোভাবে আমি আবারো ব্যথা পেতে পারি কিনা কেউই বুঝছে না।

এবারে আমি নিজেও ধীরে ধীরে বাস্তবজগতে ফিরে আসা শুরু করেছি। নিজের থেকেই একটু নড়াচড়ার চেষ্টা করলাম। হাঁড়গোড় তো ভাঙ্গে নাই, আর কোমরের তলা থেকে নীচে পা দুইটা তো সবল ও অক্ষত রয়েছে। আমি সাহস করে বললাম, আমি সিঁড়ি বেয়েই উঠতে পারবো। তারপরেও, সকলে খুবই যত্ন করে, আলতো করে আমাকে ধরে রাখলো। একটু পরপর থেমে নিয়ে বিশ্রাম নিতে বললো। অনেক সময় নিয়ে, সকলে মিলে আমাকে একদম উপরের তলায়, সিকবে পর্যন্ত এনে, সকলের মনে স্বস্তি ফিরে এলো। আমিও সেখানে একটা বিছানার উপরে নেতিয়ে পড়ে গেলাম।

(চলবে)

টলিডো, ওহাইও, ২০২৩

refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রায় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, অন্তরঙ্গে দেখা মাটি ও মানুষ
পরবর্তী নিবন্ধচসিকের কোভিড ভ্যাক্সিন কেন্দ্রে মিলছে ৪র্থ ডোজের টিকা