কৈবল্যধাম ট্রেন অপারেশন

করিম আবদুল্লাহ | মঙ্গলবার , ৬ এপ্রিল, ২০২১ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

এ অপারেশনটি চট্টগ্রাম শহরে গুরুত্বপূর্ণ গেরিলা অপারেশন। কেননা, চট্টগ্রাম শহরে এটিই একমাত্র ট্রেন অপারেশন, যে ট্রেন মিলিটারিদের রসদ সরবরাহের কাজে ব্যবহার হয়।
অপারেশনটি আজিজ গ্রুপের রইসুল হক বাহারের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়েছে। অন্যান্যরা হলেন আনোয়ার, তফাজ্জল- মাহফুজুর রহমান গ্রুপের স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত ইমতিয়াজ উদ্দিন পাশা, মুসা খান, শহিদুল আলম ও বেলায়েত আলী বেলা।
বাহার এদেরকে নিয়ে যখন অপারেশন করার কথা ভাবছিলেন তখন তার কাছে মিলিটারিদের রসদ পরিবহনে নিয়োজিত এ ট্রেনটি সম্পর্কে খবর আসে। কাট্টলীর সীমান্ত রেখার পূর্বপাশ ঘেঁসে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেন লাইন। এ ট্রেনটি প্রতিদিন বটতলী রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ কৈবল্যধাম আশ্রম অতিক্রম করে ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজের উত্তর পাশে এপ্রিল মাস থেকে চালু হওয়া অস্থায়ী মিলিটারি ক্যাম্পে যায়। সেখান থেকে কুমিরা ক্যাম্প, বাড়বকুণ্ড ক্যাম্প হয়ে মীরসরাই ক্যাম্পে মিলিটারিদের রসদ পৌঁছে দিতে মীরসরাই স্টেশন পর্যন্ত যায়। এ সব ক্যাম্প বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিকরা চট্টগ্রাম থেকে পিছু হটে যাওয়ার পর এপ্রিল-মে মাস থেকে চালু হয়েছে।
গেরিলা যোদ্ধা রইসুল হক বাহার অপারেশন সার্থকভাবে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে ভালোভাবে রেকি (reconnaissance patrol) করার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি নিজেসহ পৃথক পৃথকভাবে আরো দু’মুক্তি দিয়ে একাধিকবার রেকি সম্পন্ন করেন। রেকি টিম অপারেশনের জন্যে কৈবল্যধাম ব্রিজকে টার্গেট হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। তারা রেল লাইনের যে কোনো স্থানে বোমা বসিয়ে ট্রেনটির ওপর আঘাত হানতে পারতেন। ব্রিজ টার্গেট করার উদ্দেশ্য হলো তারা ট্রেনটির ওপর আঘাত হানার পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও বেশি সময়ের জন্যে বিপর্যস্ত করে রাখতে চান।
অপারেশনের দিন ঠিক হয় ২৯ অক্টোবর, শুক্রবার। এ দিন হাটবার। হাটবারে কাট্টলীর মানুষ বাজার করতে থলে হাতে পাশের কর্নেল হাটে যায়। ফতেহ মোহাম্মদ চৌধুরী পাড়ার রুহুল আমিনের দেউড়িকে অপারেশনের আগমন কেন্দ্র(arrival centre) হিসেবে স্থির করা হয়। এ দেউড়ি এখানকার মুক্তিদের শেল্টার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এ শেল্টারে হিট্‌ গ্রুপের সদস্যরা বিকেল পাঁচটা থেকে জড়ো হতে শুরু করেন। বোমা তৈরির বিস্ফোরক সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত ও পরীক্ষা করে নিয়ে তারা যখন অপারেশন স্থলে যাত্রা শুরু করেন তখন গ্রামীণ এ জনপদ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। দু’এক মিনিট বিরাম দিয়ে একজন একজন করে অপারেশন টিম শেল্টার থেকে বেরিয়ে যায়, সবার হাতে বাজারের থলে। থলেতে রয়েছে যার যার দায়িত্ব অনুযায়ী প্রাপ্ত অস্ত্র ও বিস্ফোরক।
কর্নেল হাট এলাকার লোকসমাগম এড়িয়ে যেতে তারা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড পার হন কর্নেল হাটকে সিকি মাইল দক্ষিণে রেখে। রাস্তা পেরিয়েই তারা আবাদবর্জিত ধান ক্ষেতের উপর সজিব-চঞ্চল হয়ে ওঠা আদিগন্ত বিস্তারিত এক নিঝুম প্রান্তরের সঙ্গী হয়ে যান।
একটু পরে নির্জন অন্ধকারে একাকিত্ব নিয়ে শুয়ে থাকা রেললাইন তাদেরকে পেয়ে যেন খুশি মনে চলতে শুরু করে, পৌঁছে দেয় কৈবল্যধাম ব্রিজের উপর। কৈবল্যধাম ব্রিজ কৈবল্যধাম আশ্রমের পশ্চিম পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইন দিয়ে গেলে আশ্রম থেকে সিকি মাইল উত্তরে।
বাহার এই কৈবল্যধাম ব্রিজের উপর দিয়ে সমান্তরালভাবে চলে যাওয়া দু’টি রেলবিটে পাশাপশি দু’টি Cutting Charge বসান। ব্রিজ ধ্বংস করা হয় সাধারণত Pier Footing Charge পিলারের গোড়ায় বসিয়ে। কিন্তু কৈবল্যধাম ব্রিজের দৈর্ঘ মাত্র ২০ ফুট। এর নিচে কোনো পিলার নেই। তাই তিনি সেতুর উপর রেল বিটের পার্শ্ব দেশে বিস্ফোরক বসিয়ে দু’টি Cutting Charge তৈরি করেন। Cutting ChargeIPE-2 (Plustic Explosive02) অথবা TNT(tri-nitro-tolu-ene) নামক বিস্ফোরক স্ল্যাব অথবা GC(gun-cotton) নামক বিস্ফোরক স্ল্যাব দিয়েও তৈরি করা যায়।
কৈবল্যধাম ব্রিজ ধ্বংসের জন্যে বাহার ব্যবহার করেছেন TNT-স্ল্যাব। এ TNT স্ল্যাব-এর প্রত্যেকটির ওজন ৫০০ গ্রাম করে। TNT বিস্ফোরক PE-2 থেকে দ্বিগুণেরও বেশি শক্তিশালী, এমনকি GC বিস্ফোরক থেকেও শক্তিশালী। দু’টি রেল বিটে তিনি দু’টি Cutting Charge- এ তিনটি করে মোট ছয়টি TNT-স্ল্যাব বসান। বিটের একপাশে দু’টি ও অন্য পাশে একটি করে TNT-স্ল্যাব বসিয়ে তিনি দু’টি cutting charge তৈরি করেন। যদিও Cutting Charge তৈরির নিয়ম হলো লক্ষ্যবস্তুর দু’পাশেই আড়াআড়িভাবে সমান শক্তিসম্পন্ন বিস্ফোরক ব্যবহার করা। এ নিয়মটি না মানার কারণে বৈদ্যুতিক টাওয়ার বা খুঁটি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম শহরে প্রশিক্ষণে বা অপারেশনে যতগুলো Cutting Charge ব্যবহার করা হয়েছে কোনোটিই লক্ষ্যবস্তুকে দু’টুকরা করে ফেলতে পারেনি। সবগুলোরই পরিণতি হয়েছে একই রকম। যে পাশে বিস্ফোরক বেশি ব্যবহার করা হয়েছে সেদিকে কাত হয়ে গেছে।
বাহার কৈবল্যধাম ব্রিজের প্রতিটি charge- এর দু’টি TNT স্ল্যবকে এক সাথে Cordtex নামক, যা শক্তিশালী বিস্ফোরক-pentaerythritol trtranitrate (PETN) নামক রসায়নিক দিয়ে তৈরি, নমনীয় বিস্ফোরক দড়ি দিয়ে বেঁধে ওগুলোর সাথে একই দড়ি দিয়ে দেড়-দু ফুট ব্যবধানে অপর TNT স্ল্যাবটিকেও বেঁধে জুড়ে দেন।
দু’টি charge-কে একই Cordtex দিয়ে বিস্ফোরিত করার উদ্দেশ্যে দু’টি charge-কে একই Cordtex দিয়ে বেঁধে তৈরি করেন। এতে তিনি একটিমাত্র detonator দিয়ে দু’টি charge-এর বিস্ফোরণ ঘটাতে পারছেন। Cordtex দেখতে ডিশের ক্যাবল লাইনের তারের মতো। Cordtex-এর বিস্ফোরণের গতি প্রতি সেকেন্ডে ৬০০০ থেকে ৭০০০ মিটার। প্রতিটি charge-এর জন্যে একটি Cordtex ব্যবহার হওয়ায় Cordtex-এর সাথে ব্ল্যাক ট্যাপ দিয়ে একটি ধাক্কা খাওয়া (shok receiver) detonator যুক্ত করে দেন। detonator স্প্রিং যুক্ত স্ট্রাইকার যন্ত্রের ছিদ্রের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। স্ট্রাইকার বিশেষ ধরনের একটি Safety Pin দিয়ে আঁটকে দেয়া হয়েছে। Safety Pin-এর মাথা একটি চিকন দড়ি দিয়ে এমনভাবে বাধা হয়েছে যাতে দড়িতে টান পড়লে খুলে যায়।
চট্টগ্রামে কোনো অপারেশনে ধাক্কা খাওয়া detonator-যুক্ত আর কোনো Charge বা বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়নি। কেন না এ অপারেশন ছাড়া অন্য যে-সব অপারেশনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে সবগুলোরই লক্ষ্যবস্তু ছিল স্থির বা অনড়। শুধু এ অপারেশনেরই মূল লক্ষ্যবস্তু হলো চলমান। চলমান লক্ষ্যবস্তুকে লক্ষ্য করে রাস্তায় বা রেল লাইনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে হলে সেটার আগমনের সাথে যুক্ত নির্দিষ্ট সময়ে বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে হয়। তা হলেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা সম্ভব হয়।
গেরিলা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গেরিলাদের হামলার আশঙ্কায় ট্রেনের নিরাপত্তার জন্যে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সব ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে দু’টি খালি বগি জুড়ে দেয়ার রীতি প্রচলন করে। মিলিটারিদের রসদবাহী এই ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনেও দুটি খালি বগি থাকে। বাহারের আরেকটি উদ্দেশ্য; এই অপারেশনের মাধ্যমে ট্রেনের বগি নয় ইঞ্জিনেরই ক্ষতি সাধন করা। কারণ বগির চেয়ে ইঞ্জিনের মূল্য ও প্রয়োজন অনেক বেশি। তাই তিনি বোমার উপর দিয়ে ইঞ্জিনের সামনের বগি অতিক্রমের সময় charge-এর সেফটিপিন মুক্ত না করে ইঞ্জিন যাওয়ার সময়েই দড়ি টেনে charge-এর সেফটিপিন মুক্ত করেন।
ব্রিজের নিচের অংশ ফাঁকা থাকায় এ বিস্ফোরণ থেকে উর্ধ্ব ও নিম্নমুখী প্রচণ্ড কোনো বায়ু চাপ সৃষ্টি হতে পারেনি। কিন্তু রেলবিট দু’পাশে আঁকাবাঁকা হয়ে সরে যাওয়ায় ব্রিজের স্লিপারগুলো নিচের দিকে ছিটকে পড়ে যায়। ট্রেনটির স্টীম ইঞ্জিনের ভার চাকার উপর বহন করার মতো ব্রিজের মাঝে কোনো বিট যথাস্থানে না থাকায় ধীর বেগে চলা ইঞ্জিনটির সামনের দিক লাইনচ্যুত হয়ে খাদের উপর আটকে যায় এবং অনতি-দীর্ঘ ট্রেনটির ইঞ্জিনের পেছনকার দু’টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে কাত হয়ে যায়। এ অপারেশন এ রসদবাহী ট্রেন ও রেলওয়ের ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও শত্রু বাহিনীর মনোজগতের ভিতের ওপর অনেক গুণ বেশি অমোচনীয় ধ্বংসলীলা চালায়।
সূত্র ও অভিজ্ঞতা সংগ্রহ: অপারেশনে অংশগ্রহণকারী ইমতিয়াজ উদ্দিন পাশা, চৌধুরী বেলায়েত আলী বেলা ও শহীদুল আলম বাদল। সহায়ক তথ্যসূত্র : ডা. মাহফুজুর রহমান। (লেখাটিতে একাত্তরের ঘটমান বর্তমান কাল ব্যবহার করা হয়েছে)।
লেখক : প্রাবন্ধিক, মুক্তিযোদ্ধা

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিঃশর্ত ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী