বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী

মোস্তফা কামাল পাশা | মঙ্গলবার , ৬ এপ্রিল, ২০২১ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

আতঙ্কের কালো পর্দা আবারও নামছে মানচিত্র। ‘৭১এ পাকি হানাদারের ভয়ঙ্কর বর্বরতা, পবিত্র ইসলামের নামে জঘন্য অশ্লীলতা, আগুনে ঝলসে অসংখ্য মানুষ জীবন্ত রোষ্ট বানানোর দানবীয় উল্লাসের সাক্ষী প্রিয় দেশ। করোনা নামের অদৃশ্য ভাইরাসের মাঝে উদযাপন হলো বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর সাথে ১০ দিনব্যাপী স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। করোনা হামলার মুখেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ প্রতিবেশি দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা যোগ দিয়ে গৌরবান্বিত করেছেন জাতির মহান আয়োজন। ঝকঝকা ইস্পাত রঙা আকাশে সূর্য টানা তাপ ঢালছে। দেশে করোনায় মৃত্যুহার এবং আক্রান্তের সংখ্যা গরমেও রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। স্ট্রেইন বদল করায় টিকা কর্মসূচি চালু সত্ত্বেও এমন হচ্ছে। তবুও উৎসব-আয়োজন শেষ নেই। সরকারি প্রচার মাধ্যম, মিডিয়া, দল, প্রশাসন, প্রায় সব সংগঠন আয়োজন সাজিয়েছে। দুঃখজনক, বেশির ভাগ আয়োজনে সামাজিক দূরত্ব বা সুরক্ষা কিছুই মানা হচ্ছে না। সেল্ফিবাজি ও ভিড়েঠাঁসা লাইভ ফে বু শো’র প্রতিযোগিতা চলছেই। কিন্তু, ৯০% আয়োজনে বঙ্গবন্ধু বা স্বাধীনতার ‘মূল স্পিরিট ফোকাস পয়েন্টে’ নেই। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়ে বাচনিক হুল্লোড় বেশি। দেখেশুনে ‘ব্রেনের মেমরি সেল রিওয়াইন্ড’ হয়ে ফিরে গেল ৪৫ বছর পিছনে। তখন এক লাফে কৈশোর পার হওয়া দুরন্ত তারুণ্যের তেজ রক্তে।
টাইম মেসিন: ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলজুড়ে আতঙ্কের ভাইরাস! থমথমে মানচিত্র। মানুষ একটু জোরে কাঁশতেও ভয় পায়। হাঁচি পেলে মুখে রুমাল বা চাদর চাপায়। চারপাশে ওঁৎ পেতে আছে অদৃশ্য মৃত্যুদূত। কখন কার ঘাঁড়ে চুপচাপ থাবা বসায়, সবখানে এই আতঙ্ক! পুরো মানচিত্রজুড়ে হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস। পাক খাচ্ছে,তীব্র শীতভোরে গ্রামের পুকুরে ভেসে থাকা ভারী কুয়াশার চাদর হয়ে। ১৯৭৬ সালের ২৬ মার্চ দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টা বাকি। শেষরাতে হঠাৎ লাউড স্পিকারের তীব্র শব্দের ব্রাশফায়ারে ভয়ের চাদর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ধরমড়িয়ে জেগে উঠে কয়েক গ্রামের মানুষ। হাটহাজারির ধলই ইউনিয়নের কিছু গ্রামের কিছু পয়েন্টে ফজর আযানের আগেই বঙ্গবন্ধুর বজ্র হুংকারে সচকিত! ঐতিহাসিক ৭ মাচের্র বঙ্গবন্ধুর মুক্তির-স্বাধীনতার রক্তে নাচনতোলা, হৃদপিণ্ডের ভয় তাড়ানিয়া ভাষণ ঝংকার তোলে,
‘ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল-তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রেখ, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’! ভয়ের আবহে ঘুমভাঙা মানুষ কিছু বুঝতে পারে না। কিভাবে সম্ভব! বঙ্গবন্ধু কী ফিরে এসেছেন! জলপাই রঙের সামরিক জান্তার দিন কী শেষ! চারপাশেইতো সামরিক জান্তার এজেন্ট কালো চিতা ওঁৎ পেতে আছে। তাহলে-? ভাবনার তার ছিঁড়ে যায়,খানিক পর। ভারী বুটের আওয়াজ, হুংকারে। মাইকের তার জান্তব নিষ্ঠুরতায় ছিঁড়ে ফেলা হয়, সূর্য উঁকি দেয়ার পরপর। লাউডস্পিকারগুলো নামিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। কারা এমন দুঃসাহস দেখিয়েছে, খুঁজে বের করতে লণ্ডভণ্ড হয় কয়েকটি চিহ্নিত পাড়া। মাইকওয়ালাকে খুঁজে বের করতেও চলে চিরুনি অভিযান। লাউডস্পিকার বা সাউন্ড রেকর্ডারে কোন চিহ্ন না থাকায় পুলিশ ও বিশেষ বাহিনীর লোকজন আরো খেপে যায়।
ঘন বসতির পাঁচ পয়েন্টে টেলিগ্রাফের খুঁটি ও গাছের ডালে লাউডস্পিকার বাঁধা পাওয়া যায়। এজেন্সির লোকজনের সাথে সামরিক জান্তার কিছু অনুচরও জুটে গেছে। তাদের ইঙিতে আওয়ামী লীগ ঘরানার নিরীহ কয়েক বয়স্ক মুরুব্বি ও তরুণকে বেদম মারধর করেও অভিযুক্ত শনাক্ত সম্ভব হয়নি। পুলিশের বঙ্গবন্ধু ভক্ত এক কর্তার হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ছাড়াই মুরুব্বিদের মুচলেকা নিয়ে পুরো বাহিনী গ্রাম ছাড়ে।
এটা ছিল আমাদের দ্বিতীয় সফল গোপন মিশন। নিজের গ্রাম বেছে নিয়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের শোধ নিতে ক্রোধের বারুদ জমা করছি, আগে থেকে। চারপাশে জান্তার অনুচর। কিন্তু বেপরোয়া আমরা। আমি,অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী, আবু হানিফ,মরহুম সৈয়দ আহমদ (ভাইস চেয়ারম্যান), নুরুল হুদা শরীফ, মরহুম গিয়াসউদ্দিন, ছাত্রলীগের শাহনেওয়াজ চৌধুরী, শাহাবুদ্দিন দুলাল, শহীদ জসীম, মোঃ সেকান্দর,শরীফ বাবু, গোলাম রব্বান, মালেকসহ আরো কয়েক জানবাজ সিনিয়র- জুনিয়র স্থানীয় নেতা-কর্মী। রাজনীতি সামরিক ফরমানে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। নেপথ্য থেকে আমাদের ‘মিশন ইমপজিবল’এ উৎসাহ দেন, স্থানীয় ইউ পি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি মামা মরহুম অ্যাডভোকেট আবুল বশর চৌধুরী। বেশ ক’দফা গোপন বৈঠক করে এর আগেও গ্রামে ৭ মার্চএর আগের রাতে একযোগে কয়েক পয়েন্টে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করি। প্রথম সাফল্যে সাহস আরো বাড়তি। এবার ভাড়ায় মাইক নেই। আগেরবার মিলাদের নামে মাইক ভাড়া নিয়ে প্রচুর কাফফারা গুণতে হয়। কারণ এই মিশনে মাইক পাওয়া ছিল, মঙ্গল গ্রহ জয়ের মতোই কঠিন। ঘোরতর বিপদে এগিয়ে আসেন নুরুল ইসলাম নামের তখনকার একজন বিমান কর্মী। মাইক কেনার বড় অঙ্ক তিনি যোগান দেন। বাকিটা অ্যাডভোকেট আবুল বশর চৌধুরী, প্রয়াত মোক্ষদা রঞ্জন দাশসহ কয়েকজনের সহযোগিতায় যোগাড় হয়ে যায়। খুবই গোপনীয়তায় মাইক কেনাও গোপনস্থানে রাখা হয়। আরো গোপনীয়তায় মাঝরাতের আঁধারে পয়েন্ট বাছাই করে লাউডস্পিকার ফিট ও মাইক চালু করা হয়। পরিণতি জেনেই অসম সাহসী মিশন এগিয়ে নিই। ভয়ডর বলতে কোন অনুভূতি মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু খুনের পরই মুছে গেছে। পরবর্তীতে নানা রাজনৈতিক মিশনে এর অসংখ্য প্রমাণ রেখেছি। এইরাত বা ৭ মার্চের মিশন ইতিহাসে স্থান পাবে না, জানি। বঙ্গবন্ধু নামটা যখন উচ্চারণ করা ছিল মৃত্যুদণ্ডতুল্য অপরাধ, সেখানে ১৯৭৬ সালের ভয়াল আতঙ্কের জনপদে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার কতোবড় অপরাধ বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওজন করা অসম্ভব! স্মৃতির মহাসড়কে ঘুরে আসার মানে কোন সরকারি সুবিধা বা ইতিহাসের রেকর্ডবুকে নাম তোলা নয়। রাজনীতির সেকালের সাথে একালের বিভাজন রেখা কতো বিশাল, তা তুলে ধরার ক্ষীণ প্রয়াস মাত্র। শুধু ৭৬ এর ৭ বা ২৬ মার্চ নয়, একই বছর ১৫ আগস্ট ও পরের বছর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার পরেও প্রতি বছর ৭ ও ২৬ মার্চ, ১৫ আগস্ট, ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারের ঐতিহ্য ধারাবাহিকভাবে চালু রাখি। প্রমাণ খুঁজতে চাইলে ইতিহাস গবেষকরা ধলই ইউনিয়ন রাজনীতির ‘৭৫ পরবর্তী পর্ব যাচাই-বাছাই করতে পারেন। আজ পরম সুদিনে ওসব ভয়াল দিনের অদম্য সহযোদ্ধারা কেউ পরপারে, কেউ বিদেশ বা ব্যবসায়ে আবার কেউবা এখনো সক্রিয় রাজনীতিতে। কিন্তু কেউ রাজনীতিকে বৈষয়িক স্বার্থে ব্যবহার করেননি। এটাই আমাদের অহংকার। আসলে মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পোশাকি বা কর্পোরেট আয়োজন দেখে ভয়াল অতীত স্মৃতি উঠে আসল।
এখন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের মত বিশাল জাতীয় অর্জনগুলো শো’পিস হয়ে গেল কেন? নানা অপকর্মে জড়িয়ে মানসিক ভীতির তীব্র লাভাস্রোতের টানে নয়তো? আশা করি, শিগগিরই সুলুক সন্ধান হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর আহবানে এত রক্ত দিলাম, ভয়াল রাক্ষসের মুঠো থেকে ছিনিয়ে আনলাম স্বাধীনতা! করোনা ভীতি সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিকতার ঘেরাটোপে জাতীয় পতাকার দণ্ডে শ্যাওলা কেন, কেন প্রাপ্তি লোভের সেলোফেন মোড়ক হয়ে গেলেন, বঙ্গবন্ধু! স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসব প্রশ্ন বিষমাখা তিরের ফলা হয়ে বুকে বড় বেশি বিঁধছে।
আসলে আওয়ামী লীগ রাজনীতির সদরে-অন্দরে এখন সুখ পায়রার বাক বাকুম! সাংগঠনিক কাঠামোও যাচ্ছে তাই। ভাগ্য গড়াপেটার সেরা সেক্টর ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু, জননেত্রী শেখ হাসিনা কীর্তনের ঢোলের বাজনা যত তীব্র, প্রকৃত নীতি-আদর্শের ধারা শুকিয়ে জৈষ্ঠ্যের শুকনো ফাটা মাঠ! স্বাভাবিক কারণে সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। গণতন্ত্র দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। কর্পোরেট বাণিজ্যের সাথে ‘শেকহ্যান্ড’ করে চলছে রাজনীতি! কিছু মন্ত্রী-নেতার স্ববিরোধী আবোল-তাবোল শুনে বোঝা যায়, আমরা পথ হারিয়েছি। ভাগ্য শিকারি নব্য ধনীরা গলায় বঙ্গবন্ধুর তাবিজ ঝুলাতে দীর্ঘ লাইনে-! সাথে চাটুকার,চামচার কান ঝালাফালা করা কিচির মিচির! পুরানোদের অনেকেও কর্পোরেট ঘরানা ভালই বোঝেন। ঝলমলে কনভেনশন সেন্টার, তারকা হোটেল, ক্লাব, আর বাতানুকুল ড্রয়িংরুমে আটকে গেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ-কর্ম! এ’ অবস্থায় হানা চলছে অদৃশ্য করোনার! কর্পোরেট আড়ম্বর আর বর্ণাঢ্য আয়োজেেনর ঘোলাস্রোতের ঘূর্ণাবর্তে কী আমরা দিশাহীন? করোনা রাজনৈতিক দৃঢ় অঙ্গীকারে মোকাবেলা সম্ভব। কিন্তু জনকের নীতি-আদর্শ কর্পোরেট রঙিন ফেনার বুদবুদে মিশে গেলে কীভাবে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন? কোনভাবেই মেয়াদোত্তীর্ণ ঘিলুতে ঢুকছেনা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৈবল্যধাম ট্রেন অপারেশন
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল