কুরবানী ও সামাজিক ধারণা

মোঃ ছাকী হোসেন | রবিবার , ১৯ জুন, ২০২২ at ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ

“কুরবানী” শব্দ শুনলেই মুসলমানদের মনে “ঈদ-উল-আযহার” গরু কুরবানীর কথা সবার মনে পড়ে। যে কোন কুরবানীর ঈদের দিন বা তৎপরবর্তী ২য় ও ৩য় দিনে লক্ষ লক্ষ গরু কুরবানী করা হয়। কুরবানীর পশু হিসাবে মহিষ, ছাগল ও ভেড়া মনোনীত হলেও মনোনয়ন তালিকায় গরু প্রথম। বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, কুরবানী বা ঈদ-উল-আযহার মূল মর্ম কথা উপলব্ধি করলেও সামাজিক ধ্যান ধারণা লালন পালন করে কুরবানীর ঈদ উদ্‌যাপন করা হয়।

কুরবানী উপলক্ষ্যে বড় আকারের গরু, দামী গরু বা চোখে পড়ে এমন গরু বাজার থেকে কিনতে হবেই। সমাজের ধনী লোক, মোড়ল, রাজনৈতিক নেতা, গ্রাম্য হোমড়া-চোমড়া প্রায় প্রত্যেকের মনে লোক দেখানো মনোভাবটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে। একটি গরু বড় সাইজ এবং আরেকটি গরু ছোট সাইজ। কুরবানীর ক্ষেত্রে কিন্তু ছওয়াব সমান। নাম অন্তর্ভূক্ত করণেও সংখ্যা সমান। দামে পার্থক্য। কেউ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছে কেউ কিনেছে এক লক্ষ টাকা। কিন্তু ইসলামিক আদর্শ মতে সবচেয়ে ভাল হয় নিজে লালন পালন করেছে এমন গরু কুরবানী দেয়া, কিন্তু এ ব্যবস্থা গ্রামের কতিপয় কুরবানীদাতার বেলায় সহজ হলেও শহুরে রবানীদাতার জন্য খুবই কঠিন একটি কাজ। তাইতো শহরের বাসিন্দারা আল্লাহকে খুশী করার উদ্দেশ্যে কুরবানীর গরু ক্রয়ের জন্য বড় বড় শহরে বা গঞ্জে বিভিন্ন গরুর হাটে গিয়ে মোটাতাজা গরু ক্রয়ের উদ্যোগ নেন। এ অবস্থায় কুরবানীর ঈদের ২/৩ দিন পূর্ব থেকে উজ্জ্বলভাবে সবাই কামিয়াব হন। অন্যদিকে গরু বিক্রেতারা ও সমানভাবে খুশী হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকৃত দরে আবার কেউ কেউ মোটা তাজা করণের সুবাধে লাভবান। যে সকল বিক্রেতারা কুরবানীর পশু বিক্রী করে ভাল টাকা উপার্জন করার চিন্তা করেন তাদের অধিকাংশের মাথায় মোটাতাজা করণের পদ্ধতি বসবাস করে। গ্রামে মোটাতাজাকরণের মেকানিজম কম। ঐখানে তেল মর্দন করতঃ চকচকে ঝকঝকে রং করণের সহজ পদ্ধতিটাকে কাজে লাগায় বিক্রেতারা।

সমাজের কিছু লোক আছে ৪/৫ টা গরু জবাই করে কুরবানী উপলক্ষ্যে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেন- এটা ভালো চিন্তা। সাংবাদিক ডেকে উপলক্ষটাকে “সংবাদ” আকারে দৈনিক পত্রিকায় স্থান করণের ব্যবস্থাও কম নয়।

ইদানীং শহরে ও গ্রামে কুরবানীর গরু নিয়ে মৌসুমী ব্যবসা চালু হয়েছে। যেমন এক বা দুই লক্ষ টাকা কারো কাছ থেকে নিয়ে সস্তা দামে গরু কিনে বেশী দামে বিক্রী করে লাভের অংশ ভাগাভাগি অথবা এত টাকা বিনিয়োগ এত টাকা লাভ ইত্যাদি। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ যে সমস্ত তরুণ ভালো বুঝেন এবং আয়ত্তে এনেছেন তারা কুরবানীর গরু অথবা ছাগল অন লাইনে বেচাকেনা করেন। এতে ঘরে বসে একজন খরিদদার তথা কুরবানীদাতা পশু পছন্দ করতে পারবেন। দরদামে পছন্দ হলে ঘরে বসেই পেয়ে যাবেন কুরবানীর গরু অনায়াসে।

কুরবানীর পশু যিনি কিনেছেন তিনি ঘরে না ফেরা পর্যন্ত স্বস্তিতে নেই। কারণ শহরে হোক আর গ্রামে হোন গরুটিকে বাড়ি আনার পথে অন্তত ১০/২০ জন উৎসুক ব্যক্তি এটির দাম জিজ্ঞেস করবেন। ক্রেতা ও চরিত্র বুঝে সঠিক দাম বলবেন অথবা বাড়িয়ে বলবেন। বাড়িয়ে বললে পিছনে হয়ত বাহবা বা বড়লোকী ভাবখানা জেগে উঠতে পারে। গরুটি যদি হয় উঁচু, মোটাসোটা শিং লম্বা এবং সাথে যদি গলায় ফুলেরমালা থাকে তা হলেতো কথাই নেই। ইদানীং কুরবানীর গরুর সাথে সেলফি তুলার প্রবণতাও লক্ষ্য করা গেছে। এই ঈদ-উল-আযহা যে শুধু গরু/ছাগলের ব্যবসা হয় তা নয় সাথে আছে খড়, কাঠালপাতা, আম পাতা ও ঘাস। অপরদিকে কুরবানীর দিন যাতে স্বাচ্ছ্যন্দে গরু জবাই করা যায় সে জন্য দা, ছুরি, বটি ইত্যাদির বেচা বিক্রীও কম যায় না। ঈদ সুযোগ করে দেয় বিভিন্ন ব্যবসা। প্রতিটি পশু জবাই করে হুজুররাও টুপাইস কামানোর সুযোগে থাকে। যদি নিজের কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা যায় সেটাই উত্তম। এ বিষয়ের মূল ধারণা এসেছে আমাদের আদি পিতা ইব্রাহীম (আঃ) থেকে। নিজ হাতে নিজ পুত্রকে কুরবানীর উদ্দেশ্যে জবাই করার উদ্যোগ। কিন্তু তিনি যেভাবে মায়াভরা পুত্রকে জবাই করার চেষ্টা করেছেন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, আমরা কিন্তু পুত্রের বদলে গরু/ছাগল/ভেড়া জবাই করার সাহস নিজে করি না। হুজুর না হলে কুরবানীই হবে না এমন একটি ধারণা পোষণ করা হয়। অথচ নিজ হাতে জবাই করাটা উত্তম। এখানে ভয়ের কিছু নাই।

এবার আসি কুরবানীর নাম নিয়ে, যাদের উপর যাকাত ফরজ আছে তাদেরকেই কুরবানী দিতে হবে এবং তার উপর ওয়াজিব। তবে এটা শরিয়ত মোতাবেক সমাজে প্রচলন আছে। কিন্তু যাদের উপর ওয়াজিব নয় যেমন- আয়বিহীন পারিবারিক সদস্য, নাবালক সন্তান, মৃত ব্যক্তির নামেও কুরবানী দেয়া হচ্ছে। এটা উচিৎ নয়। দেখা যায় টাকা আছে তাই ২/৩ টা গরু কিনে ১৪/২১ নাম সংগ্রহ করে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের লোকজনের নাম দেয়া হচ্ছে যা ঠিক নয়। মৃত ব্যক্তির নাম যোগ করলে সেটার অংশ ছদকা হয়ে যাবে। ঐ মাংসের অংশ সম্পূর্ণভাবে গরীব মিছকিনদেরকে বিলিয়ে দিতে হবে এটাই নিয়ম। আরেকটি বিষয় সমাজে মারাত্মকভাবে প্রচলন হয়ে গেছে যেমন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বেশী অংশে দেখা যায় যে, তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় কিন্তু সমাজের লোকজন কি বলবে বা পরিবার নিয়ে কুরবানী উপলক্ষ্যে মাংস খাওয়া ইত্যাদি বিষয়। অভিজাত পরিবারে আরেকটি বিষয় প্রচলন হয়ে গেছে। তা হলো কুরবানীর সময় সংগৃহীত নিজের অংশ বা আত্মীয় থেকে পাওনা অংশ ডীপ ফ্রিজে জমা রেখে সারা বছর খাওয়ার উপায় হাতে নেয়া। অন্য দিকে দেখা যায় কুরবানীর ঈদ পরবর্তী কয়েকদিন বাজারে তেমন গরু বা ছাগল জবাই করা হয় না। কারণ প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই মাংস থাকে। কতিপয় ভিক্ষুক বিভিন্ন বাসা-বাড়ি থেকে মাংস সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রী করে নগদ টাকা হাতে নেয়। গরীবের জন্য কুরবানী ওয়াজিব নয়। কিন্তু শখের শেষ নেই। চাই সমাজে প্রচার। তাই আল্লাহ গরীবের কুরবানীর দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন। অর্থাৎ গরীব ব্যক্তি শখের বশবর্তী হয়ে অথবা লোক দেখানোর জন্য যদি একটি গরু বা ছাগল ক্রয় করে এবারে সেটা চুরি হয়ে যায় তাহলে চুরিকৃত পশুটি পরবর্তীতে পাওয়া গেলে নতুন পশু তো কুরবানী দেবেই, তার সাথে পুনরায় পাওয়া পশুও কুরবানী দিতে হবে। অর্থাৎ আক্কেল সেলামী। আল্লাহ যেখানে নিষেধ করেছেন সেখানে অতি উৎসাহী হতে কুরবানী করা উচিত হয় না।

সর্বোপরি কুরবানী গরু বেচাকেনার জন্য সরকারী ও বেসরকারীভাবে হাট বসানোর টেন্ডার নিয়েও ঝগড়া-ঝাটি বা টেন্ডারবাজী কম হয় না। সোজাকথা ঈদ-উল-ফিতরে জামা কাপড় ক্রয় বিক্রয় নিয়ে মুসলমান সম্প্রদায় থাকে মহাব্যস্ত আর ঈদ-উল-আযহায় একই সম্প্রদায় থাকে গরুর হাট বা ছাগলের হাটের ব্যবসা বাণিজ্য, পশু ক্রয়, পশু কুরবানী, দাওয়াত ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে।

লেখক : ডাইরেক্টর (জেনারেল এডমিনিস্ট্রেশন), চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা, উন্নয়ন ও নারীর অগ্রগতি
পরবর্তী নিবন্ধদিনে শনাক্ত কমলেও তিনশ’র উপরে