স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও নারীর অগ্রগতি

পিংকু দাশ | রবিবার , ১৯ জুন, ২০২২ at ১১:১৭ পূর্বাহ্ণ

দুর্ভিক্ষ, মানব উন্নয়নতত্ত্ব, জনকল্যাণ অর্থনীতি ও গণদারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বিষয়ে গবেষণা ও উদারনৈতিক অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৮ সালে অমর্ত্য সেন অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে ব্যাংক অব সুইডেন পুরস্কার ( যা অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার হিসেবে পরিচিত) লাভ করেন। তাঁর মতে, উন্নয়ন মানে শুধু দেশের আয় ও ধনসম্পদ বৃদ্ধি নয়, বরং উন্নয়ন প্রকৃত অর্থবহ হয় স্বাধীনতায়। উন্নয়ন তাঁর কাছে মানব মুক্তি, মানুষের স্বাধীনতা। অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার কৃতিত্বও এ ভাবনাটির জন্য। কোনো দেশ যদি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে, কিন্তু তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই-তাহলে তাকে উন্নয়ন বলা যায় না।

অমর্ত্য সেনই জাতিসংঘের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য মানব উন্নয়ন সূচক আবিষ্কার করেন। অমর্ত্য সেনের মতে, ‘স্বাধীনতাতেই নিহিত উন্নয়ন’। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা’ (উবাবষড়ঢ়সবহঃ ধং ভৎববফড়স)। তিনি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে অভূতপূর্ব প্রাচুর্য-সমন্বিত এই পৃথিবীতে, ধনী ও দরিদ্র দেশগুলির কোটি কোটি মানুষ এখনও অ-স্বাধীনতার শিকার। এই বইতে তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্তরে যোগদান এবং নেতৃত্ব দানের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কোনও বিষয় নেই।
কিছুদিন আগ পর্যন্ত নারী আন্দোলনগুলির প্রাথমিক চাহিদা ছিল স্ত্রীজাতির প্রতি উন্নততর ব্যবহার ও যথার্থ আদান-প্রদান। এখন এই লক্ষ্যগুলির ক্রমবিবর্তন হয়েছে। এখন নারীরা কল্যাণমূলক ভাবনা থেকে শুরু করে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। নারীরা এখন আর পরোক্ষভাবে কারও সাহায্য গ্রহণ করে না। তারা পুরুষের পাশাপাশি সব কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে গতিশীল সামাজিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

মহিলাদের নিজের কাজ ছাড়া সুখস্বাচ্ছন্দ্য অসম্ভব। কারণ কাজকর্ম এবং সুখস্বাচ্ছন্দ্য একটি অপরটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অতীতে মেয়েদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য তাদের দুঃখকষ্টের উপর নির্ভর ছিল। পুরুষের তুলনায় মেয়েদের বঞ্চনাগুলি আজও পূর্বের ন্যায় বর্তমান। নারীর সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি ‘সমানস্তরের নিম্নে’ বলে অভিহিত করেছেন অমর্ত্য সেন।

সারা পৃথিবী জুড়ে আজও নারীরা সাংস্কৃতিকভাবে অবহেলার স্বীকার হচ্ছে। নারীআন্দোলনের মূল লক্ষ্য যে সমস্ত অবিচার নারীদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যে হানি ঘটায় তা দূর করা। সেনের মতে নারীদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি সম্ভ্রম ও সম্মান প্রদর্শন কতগুলি বিষয় দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়, তা হল-

১. স্বাধীন উপার্জনের ক্ষমতা, ২. ঘরের বাইরে কর্মসংস্থান, ৩. স্বত্বলাভের অধিকার এবং ৪. সাক্ষরতা এবং শিক্ষালাভ করে পরিবারের ভিতরে এবং বাইরে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা।

উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পুরুষদের তুলনায় নারীদের জীবিত থাকার যে দুর্গতি তা দৃঢ়ভাবে বিলোপ ঘটানো। নিজের গৃহবহির্ভূত কর্মসংস্থায় স্বাধীনভাবে আয় গৃহে এবং বাইরের সমাজে নারীর সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। পরিবারের সমৃদ্ধিতে তার অবদান প্রকাশ্য হয় এবং অন্যদের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাওয়ায় তার মতামতকে সম্মান জানানো হয়। বাইরের কর্মসংস্থানে অনেক কিছু শেখারও আছে। গৃহস্থালীর বাইরে পৃথিবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

নারী শিক্ষা স্ত্রীজাতিকে আরও কৌশলী, কর্মদক্ষ এবং বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে অবহিত করে। সম্পত্তির অধিকারীরূপে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী আরও শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণ করে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক মুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নারী শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের প্রভাবে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার বিষয়ে নারীর বক্তব্য শোনা যাবে। এর মধ্যে নারীর গর্ভধারণ এবং পরিবেশ উন্নয়ন অন্যতম।

খাদ্য বণ্টনে যে চিরন্তন অসমতা, দরিদ্র সমাজে সেটা নারীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট। পুরুষদের আপেক্ষিক কর্তৃত্বের মূলে রয়েছে, উপার্জনের অর্থনৈতিক শক্তি। নারী যদি গৃহের বাইরে উপার্জন করতে সক্ষম হয়, তাহলে গৃহস্থালীতে তার সম্মান বৃদ্ধি পায়। নারীরা গৃহে প্রতিদিন যে পরিমাণ কাজ করে তার জন্য কোনো পারিশ্রমিক ধার্য হয় না। এতে করে স্ত্রীর অবদান অবহেলিত হয়। কিন্তু সেই কাজ যখন গৃহের বাইরে করা হয় তখন মহিলাটি তার জন্য পারিশ্রমিক লাভ করে। তখন পরিবারের মধ্যে তার অবদান স্পষ্ট চোখে পড়ে। অন্যদের উপর নির্ভরতা কমার ফলে তার মতামতেরও মূল্য বৃদ্ধি পায়। নারীর এই বর্ধিত মর্যাদার ফলে একান্ত বঞ্চনা হ্রাস পায় এবং নারী স্বাধীনতা অর্জন করে। এই স্বাধীনতা আরও বহু স্বাধীনতার জন্মদান করে। যেমন, ক্ষুধা, রোগ এবং অন্যান্য বঞ্ছনা থেকে মুক্তি লাভের সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পায়।

অধিক জনসংখ্যা উন্নয়নশীল দেশে পরিবেশের সমস্যা সৃষ্টি করে। ঘনঘন গর্ভধারণ এবং শিশুপালন নারী স্বাধীনতার অন্তরায়। স্ত্রীজাতির সক্ষমতা লাভ লিঙ্গবৈষম্যকে সংকুচিত করে। যেসব দেশে লিঙ্গবৈষম্য বিদ্যমান বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলি ইউরোপ আমেরিকার তুলনায় অধিক মাত্রায় স্ত্রী মৃত্যুর হার সেখানে লক্ষ্যণীয়। নারীর শ্রমক্ষেত্রে যোগদান এবং সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেলে, শিশু উর্ধ্বতনের প্রতিবন্ধকতাগুলি সহজে অতিক্রম করতে পারে। দরিদ্র যখন প্রকট হয় দরিদ্রদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে অধিক হয়। জন্মহার হ্রাসের সঙ্গে নারীর মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধি পায়। শিক্ষিত মহিলাদের ক্ষেত্রে পারিবারিক প্রজননক্ষমতা জন্মদান বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারে। ভারতে তিনশত জনপদের তুলনামূলক চর্চায় প্রকাশ পায় যে স্ত্রীশিক্ষা এবং স্ত্রী কর্মসংস্থান প্রজননের হার হ্রাস করে। সর্বাধিক অগ্রগণ্য রাজ্য কেরালার অবস্থান এখানে উল্লেখযোগ্য। সেই রাজ্যে নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রজনন ক্ষমতার হ্রাস সাধিত হয়েছে। সমগ্র ভারতে যেখানে প্রজননের হার ৩ এরও অধিক সেখানে কেরালাতে ১.৭। স্ত্রীশিক্ষার মাধ্যমে এখানে প্রজননের নিম্নগতির সাধন সম্ভব হয়েছে। প্রমাণ পাওয়া যায় যে মৃত্যুর হার কমলে প্রজননের হারও কমে।

চিরাচরিত বিশ্বাসে পুরুষ অধিকারভুক্ত বিষয়ে যখন নারী প্রবেশের সুযোগ পায় তারা সেই সুযোগসুবিধাগুলির সদ্ব্যবহারে পুরুষের থেকে কম সাফল্য লাভ করে না। বস্তুত বর্তমানে পৃথিবীতে নারীকে আরও ক্ষমতাদান হলো বিভিন্ন দেশের উন্নতির মূল বিষয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে স্ত্রীশিক্ষা, তাদের মালিকানার প্রকৃতি, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং শ্রমজগতে কার্যধারা। নারীর কর্মলাভের সুযোগসুবিধা, নারীর অর্থনৈতিক কাজকর্মের প্রতি সামগ্রিকভাবে পরিবার ও সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা।

অমর্ত্য সেন বলেন, উন্নয়নের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। মানুষ যেন খেতে চাইলে খেতে পায়, শিক্ষিত হতে চাইলে শিক্ষিত হতে পারে, অসুখ হলে চিকিৎসা পায়। এই স্বাধীনতাই উন্নয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

তিনি পাঁচটি স্বাধীনতার কথা বলেন, যথা- ১. রাজনৈতিক স্বাধীনতা-গণতন্ত্র ও সভাসমাবেশের অধিকার, ২. অর্থনৈতিক কার্যসিদ্ধির সহায়তা-মুক্ত শ্রমবাজার, কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান সুযোগ প্রাপ্তি, ৩. সামাজিক সুযোগ সুবিধা-শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অধিকারসহ সব ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য রোধ করা, ৪. স্বচ্ছতার আশ্বাস- দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়া আর ৫. সংরক্ষণকারী নিরাপত্তা-পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাতা ও কোটার ব্যবস্থা করা।

অমর্ত্য সেনের মতে এই পাঁচটি স্বাধীনতা নিশ্চিত করা মানেই সমাজের উন্নতি লাভ করা। শুধু অর্থনৈতিক জিডিপি বা দেশের আয় বৃদ্ধি পেলেই যে স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল কোফি আনান বলেন, ‘পৃথিবীর দরিদ্র ও সম্পদহীন মানুষের জন্য অমর্ত্য সেনের চেয়ে অধিক ঋদ্ধ ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ আর কেউ নেই। আমাদের জীবনযাত্রার মানের পরিমাপ যে সম্পত্তির দ্বারা নয়, হওয়া উচিৎ স্বাধীনতার দ্বারা, এটা দেখিয়ে তাঁর রচনাগুলি উন্নয়নের তত্ত্ব ও প্রয়োগকে বৈপ্লবিক করে তুলেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ তাঁর উন্নয়নমূলক কাজে অধ্যাপক সেন এর দৃষ্টিভঙ্গির প্রজ্ঞা ও মঙ্গলবোধের দ্বারা প্রভূতভাবে উপকৃত হয়েছে’।

নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য উদাহরণ বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। দেশে মোট দেশজ উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতায় বড় অবদান রেখেছেন নারীরা। জনপ্রশাসন, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকোশলী, বিজ্ঞানী, সশস্ত্র বাহিনী, সিভিল এভিয়েশন, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন শাখায় শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে কর্মচারী পদে কাজ করছেন নারীরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৪ সালে দেশে কর্মক্ষেত্রে নারী ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে নারী অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেশের মোট শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে ৪ কোটি ২২ লাখ পুরুষ আর নারী ১ কোটি ৮৭ লাখ।

তথ্যসূত্র : উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা- অমর্ত্য সেন।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধকুরবানী ও সামাজিক ধারণা