কিডনি ও লিভার পাচার চক্রের টার্গেট দরিদ্র মানুষ

মোটা অংকের টাকার চুক্তি হলেও ঠকানো হয় দাতাকে

ঋত্বিক নয়ন | রবিবার , ১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৩৯ পূর্বাহ্ণ

প্রতিদিনই বাড়ছে কিডনি রোগীর সংখ্যা। এ রোগীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে দেশব্যাপী সক্রিয় ভয়ঙ্কর কিডনি ও লিভার পাচার চক্র। এই চক্র আর্থিক সঙ্কটে পড়া লোকদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে কিডনি ও লিভার সংগ্রহ করে। রোগীর আত্মীয়ের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের দেখানো হতো দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্কের জাল কাগজপত্র। অর্থের বিনিময়ে শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেচাকেনা অবৈধ হওয়ায় চক্রটি আগ্রহী দাতাদের সঙ্গে গ্রহীতাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে এমন ভুয়া প্রমাণপত্রের মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করে। মাঝে মধ্যে র‌্যাবের অভিযানে কখনো চট্টগ্রাম আবার কখনো ঢাকায় চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও থেমে নেই তাদের অপতৎপরতা। অভিযোগ রয়েছে কিডনি ডোনার হিসেবে তারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে। তাদের সাথে মোটা অংকের অর্থের চুক্তি হয়। কিন্তু কিডনি দানের পর ঠকানো হয় দাতাকে। দেওয়া হয় প্রতিশ্রুত অর্থের চেয়ে অনেক কম। এই ক্ষোভ থেকে অনেকে পৃথক গ্রুপ তৈরি করে এধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

র‌্যাবের তথ্য মতে আনিছুর তেমনই একটি সিন্ডিকেটের প্রধান। ২০১৯ সালে ভারতে গিয়ে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন। একজন দালাল তাকে প্রলুব্ধ করেছিলেন। যাকে তিনি কিডনি দিয়েছেন, তার কাছ থেকে যত টাকা নেওয়া হয়, তার চেয়ে তাকে দেওয়া হয় অনেক কম। প্রতারিত হয়ে নিজেই একটি চক্র গড়ে তোলেন। র‌্যাব১ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনে রোগীদের ব্যাপক চাহিদা আছে ভেবে পরে নিজেই একটি চক্র গড়ে তোলেন আনিছুর। ভারতে যারা এই কারবারে জড়িত, তাদের সঙ্গে গড়ে তোলেন সখ্য। অনলাইনে বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে ডোনার সংগ্রহ করে বৈধ ও অবৈধভাবে বিমানে বা স্থলপথে ২০১৯ সাল থেকেই ভারতে পাঠাতে শুরু করেন আনিছুর।

লেফট্যানেন্ট কর্নেল মোস্তাক জানান, কিডনি গ্রহীতা বিত্তশালী হলে কিডনি প্রতি ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকাও নেওয়া হত। কিন্তু কিডনিদাতাকে দেওয়া হত ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। ভারতের চক্রটি বাকি টাকার প্রায় অর্ধেক নিয়ে যেত। আর বাকি টাকার বেশিরভাগ রাখতেন আনিছুর। তিনি বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষকে টার্গেট করে টাকার লোভ দেখাত এরা। অসুস্থদের বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা বলেও ফাঁদ ফেলতো।

একই ভাবে গত বছর র‌্যাব৭ এর হাতে ধরা পড়ে চট্টগ্রামে ডোনেশনের নামে ভারতে কিডনি ও লিভার পাচার করে আসা সংঘবদ্ধ আরেকটি চক্র। এ চক্রের দলনেতা ডালিম। জিজ্ঞাসাবাদে মানবদেহের কিডনি ও লিভার পাচারকারী সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক চক্রের বিভিন্ন তথ্য দেয় তারা। এর আগে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর রাজধানী ঢাকা ও জয়পুরহাটে অভিযান চালিয়ে কিডনি কেনাবেচায় জড়িত একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব২।

র‌্যাব৭ এর তথ্যমতে, ২০২২ সালে চট্টগ্রামে ধরা পড়া ডালিম কিডনিলিভার পাচার চক্রের বাংলাদেশের প্রধান। রনি ও আলম এই চক্রের সহযোগী। ঢাকা ও জয়পুরহাটে ধরা পড়া শাহরিয়ার ইমরান, মেহেদী হাসান, সাইফুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান ও তাজুল ইসলাম কিডনি ও লিভারের ডোনার সংগ্রহ করে। তাদের ভারতে পাচারের ব্যবস্থা করে ডালিম, আলম ও রনি। ভারতে অবস্থান করা শাহিন ডোনারদের তত্ত্বাবধান করে। শাহিনের মাধ্যমে প্রতিজন দাতার বিপরীতে ১৫২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আসত ডালিম চক্রের কাছে। অথচ ২৪ লাখ টাকায় কিডনিলিভার বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলত ডোনারদের। প্রতারণার শিকার হওয়া কয়েকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব২ কিডনি ও লিভার ডোনেশনের আড়ালে কেনাবেচা চক্রের তথ্য সংগ্রহে নামে। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগী কিডনি দাতাদের পাসপোর্ট, মেডিকেল চিকিৎসার জন্য বিশেষ পাসপোর্ট ও ভিসা সম্পর্কিত বেশ কিছু নথিপত্র, মোবাইল ফোন ও দেশিবিদেশি মুদ্রা জব্দ করে।

চক্রটি কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করে জানিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, একটি দল সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আরেকটি দল অভাবে থাকা মানুষের সঙ্গে কথা বলে, তৃতীয় গ্রুপ রোগীদের ভারতে পার করে। তারা বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে জাল কাগজপত্রও তৈরি করে।

মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন১৯৯৯’ এ উল্লেখ আছে, ‘নিকটাত্মীয়’ অর্থাৎ পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাইবোন ও রক্ত সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা ও স্বামীস্ত্রী ছাড়া অন্য কারও শরীরের অঙ্গ নেওয়া যাবে না। আইনে বলা আছে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্রয়বিক্রয় বা উপহারের বিনিময়ে কোনো প্রকার সুবিধা লাভ এবং সেই উদ্দেশ্যে কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোভাবে প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বেই উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে কিডনিজনিত সমস্যা। আর বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি বিকলের শিকার হন। চিকিৎসকরা জানান, চাহিদার তুলনায় দাতা কম বলে কিডনির বাজারমূল্যও উচ্চ। কিডনি রোগীদের বেঁচে থাকতে হয় ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে; যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিডনি প্রতিস্থাপন অনেক ব্যয়বহুল ও জটিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছাগল চরাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু নিয়ে রহস্য
পরবর্তী নিবন্ধমহেশখালী-মাতারবাড়ি শিল্প ও বাণিজ্যিক অঞ্চল আইন হচ্ছে