কালজয়ী কাব্য

রেজাউল করিম | বুধবার , ২ মার্চ, ২০২২ at ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ

‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।’ গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথা ও অংশুমান রায়ের সুরে গানটি আজও বাঙালির হৃদয়ে আলোড়ন তোলে।
৭ মার্চ, ১৯৭১।
বাঙালি জাতির জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৯৭১ সালের এদিনে বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চের সেই ভাষণেরই সফল পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ। সেদিন মাত্র ১৮ মিনিটে তিনি অমর কাব্য শুনিয়েছিলেন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। যে কবিতাটি ছিল অলিখিত। এমন নজির বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। অথচ বিশ্বখ্যাত অপর ভাষণগুলো ছিল লিখিত। একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে। অতঃপর কবি এলেন। চারিদিকে জয়ধ্বনি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত জনসমুদ্র। ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’
বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্সের লাখো জনতার সভামঞ্চে আসেন তখন মাথার ওপর আকাশে ঘুরছিল পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান। এমনই এক সন্ধিক্ষণে তিনি ১৮ মিনিটের সংক্ষিপ্ত অথচ জগদ্বিখ্যাত ভাষণটি প্রদান করেন। ইতিহাসখ্যাত শ্রেষ্ঠ ভাষণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর কাব্যিক গুণ- শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে- যা হয়ে ওঠে গীতিময় ও শ্রবণে চতুর্দিকে অনুরণিত। ৭ মার্চের ভাষণটি ঠিক অনুরূপ, যে কারণে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত হন পয়েট অব পলিটিক্স বা রাজনীতির কবি। শ্রেষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিত ইতিহাসখ্যাত ভাষণের অপর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আকারে নাতিদীর্ঘ। আব্রাহাম লিংকনের গিটেসবার্গ অ্যাড্রেসের শব্দ সংখ্যা ২৭২, সময় ৩ মিনিটের কম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সময় ১৮ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১১০৫, অপরদিকে মার্টিন লুথার কিংয়ের আই হ্যাভ এ ড্রিম অ্যাড্রেসের সময় ছিল ১৭ মিনিট, শব্দ সংখ্যা ১৬৬৭। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাঙালিদের অবস্থা ব্যাখ্যা করেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালিদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ তুলে ধরেন। শান্তিপূর্ণভাবে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের চেষ্টার কথা বলেন। অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সারা বাংলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ প্রদান করেন। প্রতিরোধ সংগ্রাম শেষাবধি মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার ইঙ্গিত ছিল তার বক্তৃতায়। শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বনের কথাও বললেন তার বক্তৃতায়। যে কোনো উসকানির মুখে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এমন বক্তব্যের পর তিনি ঘোষণা করেন : ‘… ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে … এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ঢাকায় তখন বিদেশি সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য সেটি ছিল এক অন্তিম মুহূর্ত। অপরদিকে, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শৃঙ্খল ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত সংগ্রামের আহ্বান।
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। গবেষণা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পেয়েছে। ইউনেস্কো এই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো নেতার ভাষণ সেদেশের মানুষ শ্রবণ করে আসছে কিনা সন্দেহ। এটি এমনই ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও গীতিময় যে, যতবার শ্রবণ করা হয়, ততবারই মনে হবে এই প্রথমবার শোনা হল, কখনও পুরনো মনে হয় না। এই ভাষণ একটি জাতি-জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি, এক মহাকাব্য। বহুমাত্রিকতায় তা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ভাষণের বড় বৈশিষ্ট্য হলো- এর সর্বজনীনতা এবং মানবিকতা। বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে এই ভাষণ প্রেরণা জুগিয়ে যাবে যুগে যুগে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমামার বিয়ে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই বিতরণ